পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
গান গেয়ে পেলাম একশো পঁচিশ টাকা
হৈমন্তী শুক্লা
প্রতি বছর নববর্ষে সুরের অঞ্জলি দিয়ে আমার বর্ষবরণ। বয়স বেড়েছে। এখন আর কোথাও যাই না। সে এক দিন ছিল। পুজো সেরে নতুন শাড়ি পরে বসুশ্রীতে নববর্ষের উৎসবে যেতাম। প্রথমে, কিশোরী বেলায় শ্রোতা হিসেবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়সহ নক্ষত্রখচিত সেইসব সকাল। মঞ্চ আলো করে উত্তমকুমার গাইছেন, ‘এই মন জোছনায়’। স্বপ্ন দেখতাম আমিও একদিন গাইব। মিল্টু ঘোষের সৌজন্যে সুযোগ এল। গান শুনে খুশি হয়ে দিলেন একশো পঁচিশ টাকা। নববর্ষের সকালে সেই আমার প্রথম রোজগার।
সেই কোন ছোটবেলায় বাবা হাতে তানপুরা তুলে দিয়েছিলেন। এমনই এক নববর্ষের সকালে। মা পুজো করে নিজের হাতে নানারকম পদ রান্না করতেন। সন্ধের আকর্ষণ ছিল লাল রঙের ঠান্ডা শরবত। কোন দোকান থেকে কী ধরনের মিষ্টি এল, তাই নিয়ে আমাদের ছোটদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। একটু বড় হতে পুজো সেরেই গান গাইতে বেরিয়ে পড়তাম। তখন কত সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হতো। ইদানীং যেসব অনুষ্ঠান হয় সেখানে আমার মতো শিল্পীদের আর মানায় না। গানের চেয়ে নাচানাচি বেশি হয়। এখন লোকে গান শুনতে নয়, দেখতে যায়। আমি মনে করি ফুল চন্দন দিয়ে পুজো করার চেয়ে ঠাকুরের সামনে বসে একটু গান গাও, মন শুদ্ধ হবে, দেবতাও প্রসন্ন হবেন। নববর্ষে এটাই আমার প্রার্থনা।
বৈশাখের গরমে গলদঘর্ম হয়েও বাংলা ছবি দেখত
চিরঞ্জিত
ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ দিনটা ভীষণ রোমাঞ্চকর ছিল। প্রথমে থাকতাম ঢাকুরিয়া, পরে গোলপার্কে। গোটা জীবনটা প্রায় দক্ষিণ কলকাতায়। পয়লা বৈশাখে উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানা দক্ষিণে পাওয়া যায় না। তবে বর্ষবরণে দক্ষিণ কলকাতারও একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। ছোটবেলায় নতুন জামাকাপড়, খাওয়া দাওয়াই ছিল প্রধান আকর্ষণ। থিয়েটার করার সময় তপন থিয়েটারে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণকুমারদের সঙ্গে হইহই করে দিনটা কেটে যেত। সিনেমায় আসার পর মহরতে মেতে থাকতাম। আমার বহু ছবির মহরত হয়েছে পয়লা বৈশাখে।
তখন টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়ার এটাই রেওয়াজ ছিল। পয়লা বৈশাখের শুভদিনে গণেশ পুজোর সঙ্গে ক্ল্যাপস্টিক, ক্যামেরা, চিত্রনাট্যর খাতা পুজো করা। তারপর ভুরিভোজ। ছবির রিলিজও হতো। তখন পয়লা বৈশাখে নতুন বাংলা ছবি দেখার একটা উন্মাদনা ছিল। মনে রাখা দরকার তখন কিন্তু বেশিরভাগ হলে এসি ছিল না। পাখা ঘুরত। তাতেও হাউসফুল হয়েছে। বৈশাখের গরমে মানুষ গলদঘর্ম হয়েও বাংলা ছবি দেখত।
এখন পয়লা বৈশাখে বাংলা সিনেমার অনুষঙ্গটা ফিকে হয়ে গেছে। আমি তো বারাসতের বিধায়ক। তাই ওই দিন বেশিরভাগ সময়টা কাটে বারাসতেই। ওখানে একটা পুরসভায় গণেশ পুজো হয়। তবে পয়লা বৈশাখের সাবেক বৈভব বাঙালি জীবনে বজায় আছে। সেটা এখন রূপ বদলেছে সমাজ মাধ্যমের দৌলতে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে বাংলায় প্রচুর সুন্দর সুন্দর শুভেচ্ছা বার্তা দেখি। বাঙালি কাগজ-কলমে লেখে না, মোবাইলে দিব্যি টাইপ করে।
আর একটা বিষয় খুব ভালো লাগে বাঙালি জীবনের সঙ্গে সাজুয্য রেখে রেস্তরাঁর নামে। সেইসব রেস্তরাঁয় বিশেষ করে রকমারি বাঙালি রান্নার আয়োজন। এমনকী অনেক হারিয়ে যাওয়া রেসিপিও ওঁরা ফিরিয়ে আনছেন পয়লা বৈশাখে।
বাঙালি এখনও বাঙালিই আছে
সোহিনী সেনগুপ্ত
প্রতি পয়লা বৈশাখে মায়ের কাছ থেকে একটা শাড়ি উপহার পেতামই। মা তো আর নেই। তবে শাশুড়িমা আমাকে একটা করে লালপাড় শাড়ি দেন। সেইসঙ্গে বাবা (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত), বর (সপ্তর্ষি), শ্বশুরমশাইও শাড়ি দেন। এইভাবেই ছোটবেলার পয়লা বৈশাখ বেঁচে আছে। দিদিমা শিখিয়েছিলেন পায়ে আলতা পরতে। সধবাদের নাকি পরতে হয়। পয়লা বৈশাখের সকালে। আমি পরি। বাবার ওই দিন লুচি মাস্ট। সপ্তর্ষিও বাবার মতো লুচিপ্রিয়। ফলে পয়লা বৈশাখের সকালে বাড়িতে একপ্রকার লুচি উৎসব হয়। যদিও খাওয়ার ব্যাপারে আমি বরাবরই সংযমী। তখন আমাদের বিবেকানন্দ রোডের আশপাশে বড় জোর তিন-চারটে দোকান ছিল যেখানে কাটলেট, চাইনিজ বা মোগলাই পাওয়া যেত। এখন প্রচুর খাবার দোকান। বাঙালির খাবারে আর কোনও সংযম নেই। এর বাইরে ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাঙালি আজও বাঙালিই।
বাঙালির মস্তিষ্ক আজও ভীষণ সচল এবং সচেতন। তবে আমি বদলের পক্ষে। সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই সমাজের প্রবাহমানতা। আমার লালপাড় শাড়ি আর আলতা পরা যেমন বদলায়নি, তেমনই চিঠি লেখার চেয়ে ই-মেল বা হোয়াটসঅ্যাপে অন্যদের মতো আমিও স্বচ্ছন্দ। পাশাপাশি ‘ম্যাম’-এর চেয়ে ‘দিদি’ সম্বোধনটাই বেশি ভালোলাগে। বাঙালি যদি স্বভাব একটু বদলাতে পারে তাহলে হয়তো আরও সম্ভ্রমের আসন পেতে পারে। আমাদের সাবেক সংস্কৃতিতে সংযমের একটা সূচিপত্র ছিল। সেটা যদি এই পয়লা বৈশাখের আবহে একটু পেছন ফিরে পড়ে নেওয়া যায়, তাহলে গোটা জাতির পক্ষেই লাভ। ছোটবেলায় মাকে দেখেছি, দিদাকে দেখেছি, এখনও সপ্তর্ষি বা শ্বশুরমশাইকে দেখি নিজের খাবার থেকে কিছুটা খাবার পশু পাখির জন্য সরিয়ে রাখতে। এই প্রবণতা মানুষকে সহমর্মী করে তোলে। আমি বাঙালি হয়ে বাঙালির মধ্যে এই ধরনের সংবেদনশীলতা প্রত্যাশা করি।
বাঙালিআনা যেন ষোলো আনা বজায় থাকে
গৌরব চট্টোপাধ্যায়
একটা সময় ছিল ভবানীপুরের চ্যাটার্জি বাড়ি বিভিন্ন পুজো পার্বনে গমগম করত। অবশ্যই মধ্যমণি ছিলেন আমার দুই দাদু, উত্তমকুমার ও তরুণকুমার। সে সব গল্প বাবার (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) মুখে শুনতাম। পয়লা বৈশাখের সকালে বসুশ্রী সিনেমা হলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে দাদু থাকতেন শো স্টপার। আমি অবশ্য ছোটবেলায় এই সবের কোনও কিছুরই আঁচ পাইনি। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তমকুমার ছিলেন সূর্যের আলো। তা তো হাতেকলমে বুঝতে পারলাম ‘অতি উত্তম’ রিলিজ হওয়া থেকে। মানুষ এখনও উত্তমকুমারকে দেখতেই হল ভরিয়ে দিচ্ছেন। যাইহোক, নববর্ষে আলাদা করে বাড়িতে কোনও হইহুল্লোড় হয় না। এমনিতেই আমার মা বা আমি বরাবর একটু আড়ালে থাকাই পছন্দ করি। বাবাও তাই করতেন। যদি ছুটি পাই, দেবলীনাকে (স্ত্রী) নিয়ে কোথাও খেতে যাব। এদিন বাইরে কোথাও খেলে আমরা লাঞ্চ বা ডিনারে বাঙালি রান্নাই খাই।
তবে মাথায় রাখতে হবে সব কিছুরই গ্লোবালাইজেশন হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রান্তে এখন বাঙালির বসবাস। ফলে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আমাদের অভ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে চলেছে ক্রমাগত। তাই হয়তো পয়লা বৈশাখে দেখা যাবে বিরিয়ানির দোকানে দারুণ ভিড়। আমি চাইব, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আপন করেও বাঙালিয়ানা যেন ষোলো আনা বজায় থাকে।
একান্নবর্তী পরিবারটাকে আজও মিস করি
দিতিপ্রিয়া রায়
ক্যালেন্ডার, কোল্ড ড্রিংক আর মিষ্টির বাক্সে ম ম করত ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে আমার দুনিয়া। আমাদের খুব বড় পরিবার। সেই একান্নবর্তী পরিবারে অসংখ্য আত্মীয় স্বজন। তাঁদের অনেকেই ব্যবসা করতেন। আমরা ভাই-বোনেরা সেই সব গদিতে হালখাতা করতে যেতাম। আমরা থোড়াই হালখাতা করতাম। ওসব বড়দের ব্যাপার। আমরা ঘুরঘুর করতাম মিষ্টি আর কোল্ড ড্রিঙ্কের লোভে। বাড়িতে প্রচুর আত্মীয় স্বজন আসতেন। সকাল থেকে এক হাঁড়িতে রান্না হতো। দুপুরে কাকা, জ্যাঠা সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে বসতাম। আমি কোনও কালেই রেস্তরাঁর খাবার পছন্দ করি না। বাড়ির খাবারই ভালো লাগে। ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে থেকেছি। বাবা আলাদা বাড়ি করার পর সেই মজাটা হারিয়ে গেল। এখনও পয়লা বৈশাখের ওই একসঙ্গে খাওয়া আর গল্পটা মিস করি।
রানি রাসমণি ধারাবাহিক করার পর পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ক্ষেত্র বদলালেও আমার ভেতরের আমিটা কিন্তু একই রয়ে গিয়েছে। এবারেও মায়ের নতুন শাড়ি পরব। মায়ের হাতে রান্না করা খাবার খাব। বদল বলতে হয়তো কোথাও কোনও দোকান বা অনুষ্ঠানে উদ্বোধন করতে বা অতিথি হয়ে যেতে পারি। তারপর ফের বাড়ি ফেরা। ভাই বোনেরা এলে দেদার আড্ডা আর ঘরোয়া খাওয়া দাওয়া।
আর একটা ব্যাপার মিস করব। মনের মানুষটি কর্মসূত্রে থাকে অন্য রাজ্যে। পয়লা বৈশাখে আসতে পারবে না হয়তো। মজার ব্যাপার হল, সবাই জিজ্ঞাসা করছেন কবে বিয়ে করছি আমরা? শুনে এত হাসি পায়! আমরা এখনও অনেক ছোট। আমি সবে একুশ, আর ও তেইশ। সামনে এখন কেরিয়ার। বিয়ে অবশ্যই করব। তবে কোন দিন, কতগুলো পয়লা বৈশাখের পর সেটা আমরা কেউ জানি না।