গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
অঙ্কের নাম শুনলে আমাদের অনেকেরই ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। অঙ্কের পরীক্ষা শেষ হলেই মনে হয় যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আবার অনেকে অঙ্ক করতে দিব্যি ভালোবাসে। কিন্তু যদি বলা হয় মানুষের মতোই অঙ্কে পারদর্শী একটি ঘোড়া। শুনে অবাক হচ্ছ তো বন্ধুরা? আজ থেকে একশো বছরের বেশি সময় আগে অঙ্ক করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল একটি ঘোড়া। আর প্রাণীটিকে এমন অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছিলেন উইলহেলম ভন ওস্টেন। পেশায় অঙ্কের শিক্ষক হলেও ওস্টেনের বেশিরভাগ সময় কাটত হান্স নামক এই ঘোড়াটিকে নিয়ে। শুধু যোগ বা বিয়োগের অঙ্ক করা নয়, দিনের হিসেব থেকে শুরু করে মানুষের মতো একাধিক কাজ করতে পারত এই আশ্চর্য ঘোড়া। স্থানীয়রা তাই ঘোড়াটির নাম দিয়েছিলেন ‘ক্লেভার হান্স’। অবিশ্বাসীর সংখ্যাও অবশ্য কম ছিল না। হান্সের এই দক্ষতার পরীক্ষা নিতে জার্মানিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় ঘোড়াটি পাশ করতে পেরেছিল? তার জন্য ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখতে হবে অঙ্কে পারদর্শী হান্সের অবাক করা কাহিনি।
বিশ শতকের শুরুর দিকের গল্প। আম জনতার সামনে নিজের ক্ষমতার প্রমাণ দিতে এল হান্স। ঘোড়ার পাশাপাশি এটা তার শিক্ষকের পরীক্ষাও বটে। ঘোড়ার কেরামতি দেখতে ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ওস্টেন পর পর প্রশ্ন করতে থাকলেন। আর মাটিতে দিব্যি পা ঠুকে সঠিক জবাব দিতে থাকল হান্স। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের হিসেব সহজেই বাতলে দিল প্রাণীটি। সংখ্যার খেলার পাশাপাশি ওস্টেন নাম জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। শিক্ষক একটি শব্দ বললেন। হান্সও মাটিতে পা ঠুকে বর্ণমালা বুঝিয়ে দিল। যেমন ‘এ’ মানে ১, ‘বি’ মানে ২। এরপর নিজের স্নেহের ছাত্রটিকে একটি মজার প্রশ্ন করলেন ওস্টেন। জানতে চাইলেন, মঙ্গলবার যদি মাসের অষ্টম দিন হয় তাহলে শুক্রবার কত তারিখ হবে? প্রশ্ন শুনে তো সকলে অবাক। অথচ এগারোবার খুরের শব্দ করে অক্লেশে উত্তর দিল হান্স। সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠল উৎসাহী জনতা।
এরপর আর ফিরে তাকাননি এই ঘোড়ার মালিক। একাধিক জায়গায় মানুষকে মুগ্ধ করে ওস্টেনের এই গণিতবিদ ঘোড়া। কিন্তু হান্সের এই কাজের জেরে ওস্টেনের প্রচুর শত্রু তৈরি হল। এদিকে, পশুপাখির দক্ষতা নিয়ে মানুষের আগ্ৰহের সীমা নেই। হান্সের কেরামতি সকলকে অবাক করে দিয়েছিল।
তাকে নিয়ে আগ্ৰহ দেখাতে শুরু করলেন বহু মনোবিদ, পশুবিদ।
খবর পৌঁছল জার্মানির শিক্ষাদপ্তরের কাছে। ঘোড়ার কীর্তির রহস্য একবার খতিয়ে না দেখলেই নয়। কোনওরকম চালাকি ধরতে পারলেই ওস্টেনের ভণ্ডামি সামনে চলে আসবে। এই সুযোগ তো সহজে ছাড়া যায় না। এই কাজের জন্য শিক্ষাদপ্তর নিযুক্ত করল বিশিষ্ট দার্শনিক ও মনোবিদ কার্ল স্টাম্ফকে। একাধিক সদস্যকে নিয়ে গঠন করা হল ‘হান্স কমিশন’। যেখানে ছিলেন সার্কাসের মালিক, স্কুল শিক্ষক, বার্লিন চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর সহ একাধিক ব্যক্তি। কিন্তু বহুবার পরীক্ষা করেও হান্সের দক্ষতায় কোনও ভণ্ডামি ধরতে পারল না কমিশন। ১৯০৪ সাল নাগাদ তারা জানাল, ঘোড়াটি সত্যিই খুব বুদ্ধিমান।
এতে অবশ্য থেমে থাকল না কাজ। এবার হান্সের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তরুণ মনোবিদ অস্কার ফাঙ্গস্টকে নিযুক্ত করল কমিশন। দায়িত্বভার পাওয়ামাত্র কাজে নেমে পড়লেন অস্কার। ঘোড়ার দক্ষতার প্রমাণ নিতে তৈরি করলেন হরেক রকমের প্রশ্ন।
শুরু হল হান্সের জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা। সকলে দেখতে পেলেন, ওস্টেনের উপস্থিতি ছাড়াও অঙ্ক কষে দিচ্ছে হান্স। তাই ভণ্ডামির বা চালাকির কোনও অবকাশ নেই। তবে প্রশ্নকারী নিজে উত্তর জানলে হান্সের সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর প্রশ্নকর্তা উত্তর না জানলে মাত্র ৬ শতাংশ প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিতে পারছে ঘোড়াটি। খানিক দূর থেকে প্রশ্ন করা হলেও উত্তর দিতে পারছে না সে। ফাঙ্গস্ট দেখলেন, প্রশ্নকর্তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গির উপর নির্ভর করেই উত্তর দিচ্ছিল হান্স। মানুষের মধ্যে থাকা চাপা উত্তেজনা সে অনুভব করতে পারত। একাধিক পরীক্ষার পর ফাঙ্গস্ট জানালেন, এই ঘোড়ার বুদ্ধি যথেষ্ট তীক্ষ্ণ। কিন্তু মানুষের সমান নয়। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠল ওস্টেনের ঘোড়ার অঙ্ক করার ক্ষমতা নিয়েও। তাতে হান্সের অবশ্য কোনও ক্ষতি হল না।
ফাঙ্গস্টের পরীক্ষার পরেও তার জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও। গণিতবিদ ঘোড়াকে নিয়ে জার্মানি জুড়ে প্রদর্শনী করতে থাকলেন ওস্টেন। ১৯০৯ সালে মারা যান হান্সের গুরু। তারপর ঘোড়াটির কী হল? জানা যায়, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে হান্সকে সেনায় নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার আগে অবশ্য একাধিকবার মালিক বদল হয়েছিল তার। ইতিহাস বলছে, ১৯১৬ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছিল ঘোড়াটির। মৃত্যুর এত বছর পরেও মানুষের কৌতূহলের অন্যতম বিষয় এই চতুর প্রাণীটি।