গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
গ যুগ ধরে জারি রয়েছে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা। এলিয়ানের রহস্য উদ্ঘাটনে বিস্তর গবেষণা করে ফেলেছেন গবেষকরা। চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছতে না পারলেও কিছু আঁচ করতে পেরেছেন তাঁরা। মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে কি না তা নিয়ে একের পর এক গবেষণা চললেও যথাযথ প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে গবেষণার কাজ তাতে থেমে থাকেনি। লাল গ্রহের ভূপৃষ্ঠে হন্যে হয়ে প্রাণ খুঁজছে নাসার পাঠানো মহাকাশযান। কিন্তু এরই মাঝে মঙ্গলের গবেষণাকে ছাপিয়ে খবরের শিরোনামে এখন শুক্রগ্রহ।
শুক্র পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ। উভয়ের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪ কোটি কিলোমিটার। আকারে ছোট হলেও এর গঠন পৃথিবীর মতো। অনেক সময় পৃথিবীর ‘যমজ বোন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ পৃথিবী ও শুক্রের মধ্যে গাঠনিক উপাদান এবং আচার-আচরণে বড় রকমের মিল রয়েছে। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে, উভয় গ্রহের একটি সাধারণ জন্ম উৎস রয়েছে। প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে একটি ঘনীভূত নেবুলোসিটি থেকে একই সময়ে দু’টি গ্রহ গঠিত হয়েছিল। তখন শুক্রে জলের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শুক্রের জল সৌরবায়ু থেকে প্রাপ্ত তাপশক্তি নিয়ে মহাকাশে হারিয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান শুক্র গ্রহেও পৃথিবীর অভ্যন্তরের মতো অতীতে টেকটনিক প্লেট ছিল। পৃথিবীর মতো শুক্রগ্রহে একসময় পাত সঞ্চালন হতো। সেখান থেকেই আরও একটি ধারণা উঠে এসেছে, শুক্রগ্রহে কোনও সময় কি প্রাণের অস্তিত্ব ছিল?
তবে অন্যান্য দিক থেকে এটি পৃথিবীর থেকে একেবারে আলাদা। সূর্যের থেকে দূরত্বের বিবেচনায় সৌরজগতে এটি দ্বিতীয় গ্রহ। পৃথিবী তৃতীয়। রোমান দেবী ভেনাসের নামে নামকরণ করা হয়েছে এটির। এই গ্রহটি যখন ভোরের দিকে পৃথিবীর আকাশে দেখা যায় তখন একে শুকতারা এবং সন্ধ্যার সময় এটিকে সন্ধ্যাতারা বলা হয়।
১৬২০ সালে ইতালির পাদুয়া শহরে নিজের তৈরি দূরবিনে চোখ রেখে গ্যালিলিও বলেছিলেন, শুক্র কেমন যেন দুর্ভেদ্য, মনে হয় মেঘে ঢাকা, তাই তার মাটি দেখা যায় না। তাহলে শুক্রের চারপাশে ঘিরে আছে ঘন মেঘ? আর মেঘ মানে বৃষ্টি। তাহলে নিশ্চয় শুক্রতে খুব বৃষ্টি হয়। তার মানে শুক্রের ভূপৃষ্ঠ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ডোবা আর জলাভূমি। আর চারদিকে যখন এত জলাভূমি তখন কি আর গাছপালা বা জীবজন্তুরা থাকবে না? নিশ্চয় থাকবে। কয়েক শতক ধরে এই বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আধুনিক গবেষণার ফলাফল থেকে বহু চেষ্টা করেও শুক্রের মেঘে-ঢাকা আকাশের উপরের স্তরে জলীয় বাষ্পের সন্ধান পাওয়া যায়নি। শুক্রের মাটি থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উপর পর্যন্ত যে ঘন মেঘের বলয় আছে, তা সালফিউরিক অ্যাসিডের বাষ্পে (ঘনত্ব ৯০ শতাংশ) ভর্তি অর্থাৎ অত্যধিক আম্লিক পরিবেশ। তাছাড়া বায়ুমণ্ডলে ৯৬ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভর্তি।
শুক্র গ্রহ পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের কাছে বলে এর তাপমাত্রা অনেক বেশি। মনে হবে শুক্রের মাটি যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গড় তাপমাত্রা ৪৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া তার ঘন বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর ৯০ গুণ। এসব তথ্যের অকাট্য প্রমাণ মিলল সাতের দশকে, যখন শুক্রকে প্রদক্ষিণ করল মার্কিন পায়োনিয়ার মহাকাশযান আর শুক্রের মাটিতে অবতরণ করল সোভিয়েত রাশিয়ার ভেনেরা মহাকাশযান। সত্যি, শুক্র যেন এক ভয়ঙ্কর নরককুণ্ড, যেখানে কোন প্রাণের বিকাশ হওয়া অসম্ভব এবং কোনও প্রাণীর পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-প্রচারক কার্ল সাগান ১৯৬৭ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় লেখেন, শুক্রের মাটি থেকে প্রায় ৪৮-৬০ কিলোমিটার উপরের বায়ুমণ্ডলের পরিবেশ মন্দ নয়। গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি আর বায়ুমণ্ডলের চাপও পৃথিবীর মতো। তাছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড আছে, সূর্যের আলোরও অভাব নেই। এমনকী কিছুটা জলীয় বাষ্প আর মেঘে বরফের কণাও আছে। আর সেখানে অন্য কিছু না হোক, ব্যাকটেরিয়া জাতীয় অণুজীবী বাসা বেঁধে থাকলেও থাকতে পারে। তারাই হচ্ছে প্রাণের আণুবীক্ষণিক প্রতিনিধি। সাগানের সমর্থনে কিছু বিজ্ঞানীর মতামত হল— প্রায় ১০০ কোটি বছর আগে শুক্রের পরিবেশ আজকের মতো এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না। জল ছিল। তারপর পরিবেশে ঘটেছিল নানারকম ওলট-পালট, বিলুপ্ত হয় প্রাণ। হয়তো যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় প্রজাতি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, তারাই হয়তো এখনকার শুক্রের বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের বাসিন্দা। শুক্রের মেঘের বাইরের দিকের স্তরে রয়েছে ফসফিন গ্যাস। এখন প্রশ্ন হল—কী এই ফসফিন গ্যাস? তিনটে হাইড্রোজেন পরমাণু ও একটি ফসফরাস পরমাণু মিলে তৈরি করে একটি ফসফিন গ্যাসের অণু। বিবর্ণ এই গ্যাসের গন্ধ রসুন ও পচে যাওয়া মাছের মতো। অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া অথবা ক্ষয়ে যাওয়া জৈব পদার্থ থেকে উৎপন্ন হতে পারে এই ফসফিন গ্যাস। পেঙ্গুইনের মতো প্রাণীর অন্ত্রেও মিলেছে এই ফসফিন। বিষাক্ত গ্যাস বলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখনও পোকামাকড় মারতে কাজে লাগে। প্রকৃতিতে ফসফিন খুবই কম পরিমাণে মেলে। কারণ, পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশে কোনও অজৈব প্রক্রিয়ায় ফসফিন তৈরি করা খুবই কঠিন। তাহলে শুক্রের বহির্মেঘমণ্ডলের স্তরে ফসফিন গ্যাস এল কেমন করে? বিজ্ঞানীরা তন্ন তন্ন করে খুঁটিনাটি সবকিছু খতিয়ে দেখছেন। শুক্রের আগ্নেয় শিলা উল্কা বা ধাতবখণ্ডসহ বিভিন্ন অজৈব উপাদানের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেও হতাশ হতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। এখন বিজ্ঞানীরা শুক্রে ফসফিনের অস্তিত্বকে ধরে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। পৃথিবীতে অবায়ুজীবী কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া সাধারণ তাপমাত্রাতেই ফসফিন তৈরি করতে পারে। যেসব পরিবেশে অক্সিজেন একদম নেই, সেখানেই এদের বাস। যেমন কাদা, পাঁক এবং জলাভূমি ইত্যাদি। সালমোনেল্লা অ্যারিজোনি, ইশ্চেরিশিয়া কোলি, ক্লসট্রিডিয়াম স্পোরোজেন্স, ক্লসট্রিডিয়াম কচলারিয়াম প্রভৃতি অবায়ুজীবী ব্যাকটিরিয়া ফসফিন গ্যাস উৎপন্ন করতে পারে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা, শুক্রে প্রাকৃতিক বা অজৈব উপায়ে ফসফিন গ্যাসের সরবরাহে থাকা সম্ভব না হলে তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে যে, গ্রহটিতে কোনও জৈব উপায়ে ফসফিন তৈরি হচ্ছে। জৈব উপায় বলতে একমাত্র ফসফিন উৎপন্নকারী অণুজীবীর উপস্থিতি। যার মাধ্যমে ক্রমাগত ফসফিন তৈরি হতে পারে। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতে পারে শুক্র গ্রহের এমন প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও সেখানে অন্য কোনও অবায়ুজীবী বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকলেও থাকতে পারে যা আমাদের পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী ক্লারা সুসা-সিলভা মন্তব্য করেছেন, ‘শুক্রে প্রাণ থাকলে, তার স্বরূপ কী হবে, তা অনুমানের চেষ্টা করছি। একেবারে বাসযোগ্যহীন গ্রহটিতে অন্য কোনও প্রাণের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। যদি থাকে, তবে তাদের সবকিছুই চেনা প্রাণ থেকে আলাদা হবে।’ বিজ্ঞানীদের আরও অনুমান পাত সঞ্চালনের জন্য অতীতে শুক্রগ্রহের যে উষ্ণতা ছিল তাতে পৃথিবীর মতো অণুজীব, কীটপতঙ্গের অস্তিত্ব এখানে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে এই রহস্যের সমাধান করতে হলে শেষ পর্যন্ত শুক্রতে মহাকাশযান পাঠাতেই হবে, যা নমুনা সংগ্রহ করবে। মঙ্গল, চন্দ্র ও সৌর অভিযানের সাম্প্রতিক অসাধারণ সাফল্যের পর ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে, তার দৌলতে এখন শুক্র অভিযানের দিকে নজর দিয়েছে। ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ গত ২৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমিতে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, মহাকাশ সংস্থা সৌরজগতের উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় গ্রহ শুক্রের অন্বেষণের জন্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ‘শুক্রযান-১’ নামে পরবর্তী মিশন ও অরবিটারের কাজ চলছে। শুক্রের মিশনটি ইতিমধ্যেই কনফিগার করা হয়েছে। শুক্র মিশনের জন্য পেলোড ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে, যার ওজন হবে ১০০ কিলোগ্রাম এবং সঙ্গে থাকবে ৫০০ ওয়াট-এর একটি উপলব্ধ পাওয়ার সাপ্লাই। সুইডেন ভারতের আসন্ন শুক্র মিশনে (শুক্রযান-১) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। প্রাথমিক পরিকল্পনা মাফিক শুক্রযান-১-এর অরবিটটি শুক্রগ্রহের চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথ অনুসরণ করবে। এই মিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল— শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠের স্তরগুলি এবং এর নীচের গভীরতায় অনুসন্ধান করা। সেই সঙ্গে লক্ষ্য হল সালফিউরিক অ্যাসিডের মেঘের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় ঘটনাটি উন্মোচন করা। বিজ্ঞানীরা জানতে চায় শুক্রের বাতাসের রাসায়নিকগুলির সম্পর্কে, কারণ শুক্রের বায়ুমণ্ডল কীভাবে চলে এবং কেন এটি পরিবর্তিত হয়— তা বোঝা সম্ভব হয়নি। শুক্র অভিযানে যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তা হয়তো সেখানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনাকে আরও দৃঢ় করবে। সব মিলিয়ে অনেক বছর অবহেলিত থাকার পর শুক্র নিয়ে কাহিনি আবার জমজমাট।