গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
বাস্তব ও কিছু প্রশ্ন
২০০৬ সাল। পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন কাই বার্ড এবং মার্টিন জে. শেরউইন। ‘আমেরিকান প্রমিথিউস—দি ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্রাজেডি অব জে রবার্ট ওপেনহাইমার’ বইয়ের জন্য। এই বই অবলম্বনে ক্রিস্টোফার নোলান তৈরি করেছেন তিন ঘণ্টার জীবনী-আলেখ্য ‘ওপেনহাইমার’। ১৯৮৬ সালে, রিচার্ড রোডসের ‘দি মেকিং অব দি অ্যাটমিক বম্ব’ও পুলিৎজার পায়। পরমাণু বোমার পাপবোধ থেকে আমেরিকা বেরতে পারছে না বলেই কি এত পুরস্কারের ঘটা? কোনও উপন্যাস বা বায়োপিককে রুপোলি পর্দার প্রয়োজনে কিঞ্চিৎ কাটছাঁট করতেই পারেন পরিচালক। মেশাতে পারেন আপন মনের মাধুরী। কিন্তু শুরু থেকেই যদি জোরকদমে ইতিহাস বিকৃতি ঘটতে থাকে, তাহলে পরিচালকের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই কি সংশয় জাগে না?
কেমব্রিজে পড়ার সময়, পদার্থবিদ্যার শিক্ষক প্যাট্রিক ব্লেকেটকে আপেলে বিষ মাখিয়ে খুন করতে চেয়েছিলেন ওপেনহাইমার। ঘটনাটি সত্য। কিন্তু ব্লেকেটের সঙ্গে ওপেনহাইমারের পরিচয় নিলস বোর করিয়ে দেননি। দিয়েছিলেন অ্যার্নেস্ট রাদারফোর্ড। ট্রিনিটি বিস্ফোরণের যে চিত্র নোলান এঁকেছেন, তাও গোলমেলে। অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই বিকট কানফাটানো আওয়াজের উৎপত্তি হয় না, হয় বেশ কিছুটা পরে। ‘ট্রিনিটি অ্যান্ড বিয়ন্ড’ তথ্যচিত্রটি প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের নিখুঁত দলিল। সেখানে দেখানো হয়েছে, ঠিক কতটা সময় পরে পিলে-চমকানো শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল ট্রিনিট্রিতে। তাছাড়া ‘মাশরুম ক্লাউড’ যে কোনও পারমাণবিক বিস্ফোরণের অঙ্গ। নোলানের ছবিতে কোথায় ব্যাঙের ছাতার স্তূপীকৃত কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার মেঘ? হিরোশিমা-নাগাসাকির দলাপাকানো লাশের সারির ছবিই বা কোথায়?
ম্যানহাটনের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এবং ওপেনহাইমারের ছায়াসঙ্গী, ইসিডর আইজ্যাক রবি লিখছেন,‘ট্রিনিটির সফল পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করে ওপেনহাইমার যখন গাড়িতে উঠছেন, মনে হচ্ছে তিনি যেন সাক্ষাৎ ভগবান।’ আর সিনেমাটির কস্টিউম ডিজাইনার অ্যালেন মিরোজিনিকের মতে, ‘এ রকস্টার ইজ বর্ন।’ সিনেমায় হিরোশিমা বিস্ফোরণের খবর মেলার পর, সাংবাদিক সম্মেলনে বিজ্ঞানীরা যেভাবে পড়িমরি করে একে অন্যের পা মাড়িয়ে ছুটলেন ‘চিয়ারলিডার’ ওপেনহাইমারের পাশে দাঁড়িয়ে পোজ দেবেন বলে, তা নিউক্লিয়ার ফিসনের দুর্বার গতিকেও হার মানাবে। প্রথমে সিগারেট, পরে সিগার খেতেন; খুব ভালো মার্টিনি বানাতেন ওপেনহাইমার। ছিলেন ছুপা রুস্তমও। সিনেমায় লাস্যময়ী ক্যাথরিন ‘কেটি’ পুনিংকে (এমিলি ব্লান্ট) বিয়ে করার পরেও প্রতিশ্রুতিমান বিজ্ঞানী জাঁ ট্যাটলকের(ফ্লোরেন্স পাগ) সঙ্গে চলেছে তাঁর গোপন প্রেম। বিশেষ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে আশ্লেষিত কণ্ঠে ওপেনহাইমার কবুলও করেছিলেন যে, ট্যাটলকের জন্য তিনি কমিউনিস্ট হতেও রাজি।
ওই একবারই কমিউনিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন ওপ্পি। বাকি জীবনে ঘুণাক্ষরেও কমিউনিজমের নাম মুখে আনেননি। স্ত্রী কেটি এবং প্রেমিকা ট্যাটলক ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির দাপুটে সদস্য। তাঁদের সৌজন্যেই সন্দেহভাজন কমিউনিস্টের তকমা জুটেছিল ওপেনহাইমারের। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সেই বিষয়গুলিও উপেক্ষিত নোলানের সিনেমায়। ১৯৫৩-৫৪ সালের ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের’ বিচার নামক প্রহসনের মোড়কে নোলান দেখালেন কিছু বস্তাপচা আখ্যান। নৌবিজ্ঞানী জন এরিকসনের প্রসঙ্গ তুলে ওপেনহাইমারের রাশিয়ান কমিউনিস্ট যোগ প্রমাণে মরিয়া ছিলেন অ্যাটর্নি রজার রব। যদিও রজার রব, এডওয়ার্ড টেলর বা রয় কনদের যাবতীয় প্রচেষ্টা বিফল হয়ে যায়। ওপেনহাইমার চেয়েছিলেন, পরমাণু অস্ত্র যেন শুধু আমেরিকার ভাঁড়ারেই শোভাবর্ধন না করে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সোচ্চার হয়েছিলেন বলেই শাস্তি পেতে হয়েছিল তাঁকে। আশ্চর্যের, নোলান প্রকৃত তথ্যের ধারেকাছেও ঘেঁষলেন না।
অস্কার ও নেপথ্যের রাজনীতি
ওপেনহাইমার কখনই দেশদ্রোহী ছিলেন না। চারিত্রিক দুর্বলতা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা তাঁর চরিত্রের অভিজ্ঞান। সেই দোলাচলতা কিলিয়ান মার্ফি কি আদৌ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন? তাছাড়া ৬৪০ জন মহিলা বিজ্ঞানী ম্যানহাটন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথাও বা কী করে ভুলে গেলেন নোলান? পদার্থবিদ মারিয়া গোয়েপার্ট মেভার তো নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। জানা যায়, আসলে অ্যাকাডেমির ৯৪% সদস্য সাদা চামড়ার ‘ককেশীয়’, ৭৭% পুরুষ। তাই কি অস্কারের কথা ভেবে নোলান জেনেবুঝে ওপেনহাইমার ছবিতে ব্রাত্য করে রাখলেন মহিলাদের? ১৯২৯ সালে রুজভেল্ট হোটেলে, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কসের হাত ধরে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের সূচনা। ১৯৩৯ সালে অস্কার নামকরণ। ২২ ক্যারাট সোনার, সাড়ে আট পাউন্ডের, সাড়ে তেরো ইঞ্চি পুরস্কারটির গায়ে জন্মলগ্ন থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাজনীতি ওবিতর্ক।
রাজনীতির সোহাগে ওয়াল্ট ডিজনি ২৬ বার অস্কার বগলদাবা করেছেন। কিন্তু অ্যালফ্রেড হিচককের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। জর্জ. সি স্কট, মার্লন ব্র্যান্ডো, উডি অ্যালেন, আসগর ফারহাদি বা মাইকেল মুরের মতো বিখ্যাত অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, পরিচালকরা মার্কিনি দুনিয়ার এই একপেশে রাজনীতিকে গালমন্দ করেছেন। তাতেও ‘দি অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স’ নির্বিকার। একাধিক জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অস্কার জিততে এক-একটি সিনেমার জন্য এখন ২০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ করছে। ‘ওপেনহাইমার’ কি তাই? নাহলে বিজ্ঞানীর প্রেম-বিরহ, আইনস্টাইন এবং নিলস বোরের মতো সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনকে বাদ দিয়ে কীভাবে তাঁর বায়োপিক পূর্ণতা পেতে পারে? দুনিয়াজুড়ে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলছে... রুশ-ইউক্রেন, ইজরায়েল-হামাস। ঠিক সেই মুহূর্তে অস্কারে ওপেনহাইমারের জয়যাত্রা কি বর্তমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ায় পরমাণু বোমার বিজ্ঞাপন নয়?
পূর্বাশ্রমে ওপেনহাইমার
অ্যাটম বোমা তৈরির মূল কারিগর ছিলেন ওপেনহাইমার। সেই বোমা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ফেলার নেপথ্যেও তিনি। কিন্তু যে মুহূর্তে দলাপাকানো ঝলসানো লাশের সারির ছবি দেখলেন, তাঁর মনে হল, ‘হাতে রক্তের দাগ আর মুছবে না।’ ট্রুম্যান তাঁকে বলেছিলেন ‘ক্রাইবেবি।’ আসলে অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিলেন ওপেনহাইমার। কেমব্রিজে শিক্ষক ব্লেকেটকে খুন করতে গিয়েছিলেন। একবার এক বন্ধু তাঁকে বিয়ের নিমন্ত্রণ করেছিল। বিয়ের রাতে হঠাৎ সেই বন্ধুকেই গলায় ফাঁস দিয়ে প্রায় যমের দুয়ারে পাঠাচ্ছিলেন।
১৯২৯ সালে ক্যালটেকে যখন যোগ দেন, ওপেনহাইমার তখন অনেক স্থিতধী। প্রচুর পরিমাণ লঙ্কা দিয়ে ডিমের অমলেট বানিয়ে বন্ধুদের খাওয়ানোর নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বন্ধুরা সেই অমলেটের নাম দিয়েছিলেন ‘এগস আ লা ওপ্পি’। ঘনঘন সিগারেট, বামপন্থী মতাদর্শ—খুব তাড়াতাড়ি ছাত্রমহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ওপেনহাইমার। তবে মাথার পোকা নড়ে উঠত মাঝেমধ্যেই। একবার ক্রাইসলার গাড়ি চালিয়ে প্রেমিকা ন্যাটলি রেমন্ডের সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছেন। পাশে রেললাইন দিয়ে ছুটছে ট্রেন। শখ জাগল গতিতে সেটিকে হারাবেন। রেস খেলতে গিয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। গাড়ি ভেঙে চুরমার। ন্যাটলি সাতদিন কোমায়। প্রাণে বেঁচে ফেরার পর ওপেনহাইমারের বাবা সেজনের আঁকা একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন ন্যাটলিকে।
বিজ্ঞান ইতিহাস বলবে, অটো হান এবং ফ্রিটজ স্ট্রাসম্যান ছিলেন নিউক্লিয়ার ফিসন বা পরমাণু বিভাজনের মূল কারিগর। আর প্লুটোনিয়াম বিস্ফোরণের হোতা ছিলেন রবার্ট ক্রিস্টি। নাগাসাকিতে যে বোমাটি ফেলা হয়, তা ‘ক্রিস্টি গ্যাজেটেরই’ সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লস অ্যালামস নয়, ম্যানহাটন প্রজেক্টের ৯০ শতাংশ অর্থই তখন খরচ হতো ওয়াশিংটনের ‘হ্যানফোর্ড’ বা টেনেসির ‘ওক রিজ’ ল্যাবে। সেখানেই চলত প্লুটোনিয়াম মন্থন বা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ। নিলস বোর বা লিও জিলার্ড যখন পরমাণু বোমার বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন, তখন ওপেনহাইমার তাঁদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন নাৎসি বা রুশ বাহিনীর ভয় দেখিয়ে। পরমাণু বোমা নিয়ে বিরোধিতার কারণে নোবেলজয়ী লিও জিলার্ডকে ম্যানহাটন প্রজেক্ট থেকে ছেঁটে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ম্যানহাটনের অধিকর্তা লেসলি গ্রুভস। জেনেও চুপ ছিলেন ওপেনহাইমার।
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন ৩৫টি সংস্থার মাথায় বসেছিলেন এই বিজ্ঞানী। সংবাদমাধ্যম জুড়ে শুধুই তাঁর ছবি আর বক্তব্য। সেইসময়ে, অর্থাৎ ১৯৫৩-৫৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে উঠল দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। বলা হল, তিনি রাশিয়ার চর। মূল কলকাঠি নেড়েছিলেন জোসেফ ম্যাকার্থির মুখ্য উপদেষ্টা রয় কন। ১৯ দিন ধরে চলল বিচার। ভোটের রায় ২-১। সিদ্ধান্ত হল ওপেনহাইমার দেশদ্রোহী নন। ক্যান্সারে ভুগছিলেন দীর্ঘকাল। একরাশ অসম্মান আর অপমান বুকে করেই১৯৬৭ সালের১৮ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স তখন ৬২। মৃত্যুর সময় তাঁর ওজন ছিল মাত্র ৫২ কেজি। ২০১৪ সালে, ১৯ খণ্ডের দলিল-দস্তাবেজের ধুলো ঝেড়ে, যাবতীয় অভিযোগ থেকে ওপেনহাইমারকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন ওবামা।
আইনস্টাইন ও পরমাণু বোমা
১৯৩৮সাল। ইউরেনিয়াম পরমাণুর সফল বিভাজন ঘটালেন বার্লিনের কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউটের দুই বিজ্ঞানী। দুই জার্মান গবেষকের সাফল্যের খবরে প্রমাদ গুণলেন হিটলারের অত্যাচারে জার্মানি থেকে একটা স্টিমারে গাদাগাদি করে আমেরিকায় পালিয়ে এসে প্রাণ বাঁচানো এক প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী। জার্মানির লিওপোল্ড ব্লুম স্কুলে পড়ার সময় তাঁর গ্রিক ভাষার শিক্ষক বলেছিলেন, ‘এর দ্বারা কিছু হবে না।’ গ্রিক ভাষার পরীক্ষা উতরোতে ব্যর্থ সেই ছাত্রের নাম অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁরই সৃষ্টি পদার্থবিজ্ঞানের সব পেয়েছির সূত্র ‘দি থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’। এবং পরমাণু বোমার প্রাণভোমরা, E= mc2।
১৯৩৩। নিউজার্সিতে প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের বিস্তীর্ণ ছায়াঘেরা প্রান্তরে আইনস্টাইন ও নিলস বোরের বিকেলবেলা কাটছে অ্যাটম বোমার ভূত-ভবিষ্যত আলোচনায়। হিটলারের তাড়া খাওয়া তিন তরুণ হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ইউজিন পি. উইগনার, এডওয়ার্ড টেলর এবং লিও জিলার্ডও অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে এসে জুটেছেন প্রিন্সটনে। তাঁরাও সমান উদ্বিগ্ন। ওয়িগনার বা জিলার্ড—কারও সাহস নেই আইনস্টাইন বা বোরের সামনে সশরীরে হাজির হয়ে নিজেদের ভয়-আশঙ্কা-উদ্বেগের কথাটা পাড়েন! ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে ছুটিতে লং আইল্যান্ডের পেকনিক উপসাগরে মাছ ধরতে গিয়েছেন আইনস্টাইন। ৩০ জুলাই, রবিবার ডজ গাড়ি চেপে দুই বন্ধু জিলার্ড আর উইগনার দুরুদুরু বক্ষে পাড়ি জমালেন কাচোকের দিকে। পথ ভুল করে ঢুকে পড়লেন পাচকে। গাড়ি ঘুরিয়ে তড়িঘড়ি ওল্ড গ্রুভ রোডে ঢুকে একটা বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন আইনস্টাইনের বাড়ির হদিশ। ছেলেটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, সারা বিশ্বের লোক চেনে আইনস্টাইনের বাড়ি আর তোমরা খুঁজে পাচ্ছ না! বাড়ি খুঁজে পেয়ে ধন্য দুই তরুণ বিজ্ঞানী। বাক্যহারাও। আইনস্টাইন একটা টি-শার্ট আর গোটানো প্যান্ট পরা অবস্থায় তাঁর দুই তরুণ সহকর্মীকে নিয়ে বসালেন প্রশস্ত খাবার ঘরে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন দুই বিজ্ঞানী, হিটলারের হাতে ইউরেনিয়াম কি বিপদ ঘটাতে পারে, তা সবিস্তারে জানিয়ে যদি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটা চিঠি লেখেন আইনস্টাইন। শুনেই রাজি গৃহকর্তা। হাতে যেন চাঁদ পেলেন দুই তরুণ বিজ্ঞানী। আইনস্টাইন বলে চলেছেন, উইগনার লিখছেন। একসময় উইগনারের কলম থেমে গেল। কোনও মানুষ এরকম হীরক-শুভ্র ভাষায় চিঠি লিখতে পারে! হঠাৎ আইনস্টাইনের চোখ পড়ল তাঁর দিকে, ‘কী ব্যাপার চুপ করে বসে আছ যে, লিখছ না কিছুই! আমি যে বকেই চলেছি।’ থতমত উইগনার আবার লেখা শুরু করলেন। বেলা গড়িয়ে দুপুর। মধ্যাহ্নভোজনের পালা সাঙ্গ করে জিলার্ড-উইগনারকে প্রিন্সটনের দিকে রওনা করিয়ে দিয়ে আইনস্টাইন আবার ছুটলেন মাছ ধরতে। পরদিন সকালে উইগনারের অফিসে বসেই চিঠি টাইপ করে ফেললেন জিলার্ড। এবার আইনস্টাইনকে দিয়ে সই করানোর পালা।
২ আগস্ট, বুধবার আবার লং আইল্যান্ডের দিকে ছুটলেন জিলার্ড। এবার আর উইগনার নন, গাড়ি চালাচ্ছেন ৩১ বছরের পদার্থবিদ, হাইড্রোজেন বোমার জনক এডওয়ার্ড টেলর। দু’-একটা ছোটখাটো পরিমার্জনের পর আইনস্টাইনের অফিসে বসেই সেই চিঠি টাইপ করে, তাঁকে দিয়ে দস্তখত করিয়ে জিলার্ড ফিরে চললেন প্রিন্সটনে। ১৫ আগস্ট শেষ হল পত্রলিখন পর্ব। এবার চিঠিটা রুজভেল্টের হাতে পৌঁছনোর পালা। চমকপ্রদ ও ঐতিহাসিক এই সমস্ত ঘটনাই অনুপস্থিত নোলানের সিনেমায়।
অপ্রস্তুত পৃথিবী ও পরমাণু বোমা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন লেম্যান কর্পোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা রাশিয়ান অর্থনীতিবিদ আলেকজান্ডার স্যাকস। জিলার্ড আর স্যাকস নিজেরা বসে আলোচনা করলেন, কীভাবে চিঠিটা রুজভেল্টের কাছে পেশ করা যায়। ১১ অক্টোবর সকালে চিঠিপত্র সমেত প্রেসিডেন্টের খাসতালুকে পৌঁছলেন স্যাকস। জরুরি মিটিং থাকায় তাড়াহুড়ো করে চিঠির অর্ধেক কথা শুনলেন রুজভেল্ট, বাকি অর্ধেক কানেও তুললেন না। বিকেলে আবার আসতে বললেন স্যাকসকে। ইউরেনিয়াম-জার্মানি-হিটলারের সব খবরই রাখতেন রুজভেল্ট। তিনি বলে উঠলেন, ‘অ্যালেক্স তুমি দেখ, যাতে নাৎসিরা আমাদের উপর পরমাণু হামলা চালাতে না পারে!’ পাশের ঘর থেকে সেক্রেটারি জেনারেল এডউইন এম. ওয়াটসনকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, তখনই ইউরেনিয়াম কর্মকাণ্ডের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গড়ে দিতে। ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডসের অধিকর্তা ডঃ লিম্যান জে ব্রিগসের নেতৃত্বে রাতারাতি তৈরি হল সেই উপদেষ্টা কমিটি।
ফের্মি ল্যাবে গ্রাফাইটের চুল্লিতে এক কিলো ইউরেনিয়ামের ‘চেন রিঅ্যাকশন’ শুরু করার জন্য সাকুল্যে ছ’হাজার ডলার মঞ্জুর করল সেই কমিটি। গোটা পরমাণু প্রকল্পের দু’বিলিয়ন ডলার বাজেটের তুলনায় যা নিতান্তই নগণ্য। কেটে গেল একটা বছর। তিতিবিরক্ত হয়ে উইগনার পরবর্তীকালে কংগ্রেসে বলেছিলেন, অহেতুক সময় নষ্ট না হলে আমেরিকা আরও একবছর আগেই পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে পারত। ১৯৪৫ সালের পরিবর্তে ১৯৪৪ সালে পরমাণু বোমা তৈরি হলে রুজভেল্ট কিছুতেই তা জাপানে ফেলার অনুমতি দিতেন না। কিন্তু গোল বাধল ১২ এপ্রিল, ১৯৪৫-এ রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পরেই। জাপানে পরমাণু বোমা ফেলবেন বলে আগাগোড়াই বদ্ধপরিকর ছিলেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। জাপানের তখন বেহাল দশা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা নিরর্থক। কিন্তু সেকথা ট্রুম্যানকে বোঝাবে কে! জিলার্ড-উইগনাররা জাপানের উপর পরমাণু বোমা ফেলার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ট্রুম্যান ছিলেন অনড়, অনমনীয়।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট নিউইয়র্কের সারানাক লেকে একটা ডিঙিতে চড়ে আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন আইনস্টাইন। এক সাংবাদিক তাঁর কানে হিরোশিমার খবরটা দিতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান তিনি। বিস্ফারিত চোখে সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি ঠিক বলছ তো!’ তারপরেই স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘দি ওয়ার্ল্ড ইজ নট রেডি ফর ইট।’ শোকাহত আইনস্টাইন হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলার বছরখানেক বাদে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, যদি তিনি কোনওভাবে আঁচ পেতেন যে জার্মানি পরমাণু বোমা বানাতে অপারগ, তাহলে কিছুতেই রুজভেল্টকে তা বানানোর পরামর্শ দিতেন না। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল মৃত্যু হয় আইনস্টাইনের। তার কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিরক্ষা মানে শুধুই অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, আওয়ার ডিফেন্স ইজ ইন ল অ্যান্ড অর্ডার।’
সভ্যতার বিকাশে প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মর্ত্যকে উপহার দিয়েছিলেন। ওপেনহাইমাররা সেই আগুনকে শতগুণে বাড়িয়ে বড় এক বিপদের পথে ঠেলে দিলেন পৃথিবীকে। লঘু অপরাধে প্রমিথিউস শাস্তি পেলে ওপেনহাইমাররা কেন নন? ক্রিস্টোফার নোলান কি লঘু করে দিলেন না শতাব্দীর ঘৃণ্যতম একটি অপরাধকে?