কর্ম বা গৃহক্ষেত্রে অশান্তি মনঃকষ্ট হতে পারে। পেশাদারী কর্মে সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
বেলপাহাড়ির পথে চলেছি। শিয়ারবিদা মোড় থেকে আমাদের গাড়ি বাঁদিকে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল কাঁচা রাস্তায়। সড়কের দু’পাশে শাল, পিয়াল, কেন্দু, মহুয়া, ফেলাই, আসন, পলাশ আর অর্জুন গাছের ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলকে স্থানীয় অধিবাসীরা সিংলহরের জঙ্গল বলে ডাকেন। দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম লালজল পাহাড়ে। এর উচ্চতা আনুমানিক ২০০ মিটার। অমসৃণ কালো পাথরের চাঁই পেরিয়ে বেশ কিছু খাড়াই পথ পেরিয়ে চলে এলাম লালজল গুহাকন্দরে। এর ভেতরে একসময় প্রস্তর যুগের নিদর্শন মিলেছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একসময় এই গুহা নিয়ে কাজ আরম্ভ করলেও বর্তমানে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে সাধক রামস্বরূপ দেবশর্মা প্রতিষ্ঠিত আশ্রম। তাই লালজল পাহাড় কারও কারও কাছে ‘দেবী পাহাড়’ নামেও পরিচিত।
দোমোহানী মোড় ঘুরে গাড়ি প্রবেশ করল বারিঘাটি টোলায়। নির্জন পথে মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা নিয়ে চলেছেন স্থানীয় মহিলারা। গ্রামবাসীরা মাটির ঘরের দাওয়ার সামনে বাবুই ঘাস শুকাচ্ছেন। মাঝেমাঝে জঙ্গলযুদ্ধে নিহত সংগ্রামী যোদ্ধাদের আবক্ষমূর্তি। সর্পিল পথ ধরে পৌঁছে গেলাম খাঁদারানি ড্যামে। ‘খাঁদা’ অর্থ উপেক্ষিতা। পাহাড় আর জঙ্গলের রানি সত্যিই যেন অবহেলিতা। যতদূর চোখ যায়, রোদের গন্ধ জড়ানো সুবিস্তৃত জলরাশি। দূরে পর্বতশ্রেণি আর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা জঙ্গল। স্থানীয় এক অধিবাসী জানালেন, ড্যামের জল কৃষিকার্যেও ব্যবহৃত হয়।
বেলপাহাড়ি মানে কেবল হাতেগোনা কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট নয়। বেলপাহাড়ি মানে অকৃত্রিম প্রাকৃতিক শোভা আর সুপ্রাচীন ইতিহাসের অপার মেলবন্ধন। ভারতের প্রথম তামার তৈরি কুঠার মিলেছিল বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা অঞ্চলের তামাজুড়ি গ্রামে। গাড়রাসিনি পাহাড়ের সুপ্রাচীন প্রস্তর কন্দরগুলো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনকে বহন করে চলেছে।
দেখতে দেখতে পৌঁছালাম গাড়রাসিনি পাহাড়ের পাদদেশে। এই পাহাড়ি এলাকার পাদদেশে ব্রহ্মর্ষি সত্যানন্দ সন্ন্যাস আশ্রম। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। আশ্রম দর্শনের পর গাড়রাসিনি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর অক্লান্ত প্রচেষ্টা। শীর্ষদেশে পৌঁছতে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগে। পাহাড় চূড়ায় গুহার ভেতর একটা মন্দির। ওঠা বেশ কষ্টকর হলেও এখানে না এলে বেলপাহাড়ি ভ্রমণের একটা দিক অপূর্ণই থাকত। এখান থেকে সমগ্র বেলপাহাড়ির অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ, দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়, ধানজমি, অরণ্য, নীচের রাস্তা...আরও কত কিছুই যে দেখা যায়! চলে এলাম বেলপাহাড়ি মোড়ে। এখান থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে তারাফেনি ড্যাম। কংসাবতী নদীর ওপর ছোট্ট এই ব্যারেজের জল অধিবাসীদের পানীয় জলের প্রধান উৎস। তারাফেনি নদীর জল মূলত মুকুটমণিপুর থেকে আসে। তারাফেনির আদিবাসী গ্রাম পেরিয়ে মোরাম বিছানো লাল রাস্তা ধরে চলে এলাম ঘাগরা জলপ্রপাতে। জনশ্রুতি আছে যে, বেলপাহাড়িতে থাকাকালীন ফ্রেডরিক রাইস সাহেব ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে এই নির্ঝরিণীর সন্ধান পান। ব্রিটিশ সাহেবরা বনভোজনের উদ্দেশে এখানে আসতেন। ১৯৭৭ সালে অমল দত্ত পরিচালিত ‘বেহুলা লখিন্দর’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং এখানেই হয়েছিল। জলপ্রপাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে ভূমিরূপ। ‘ঘাগরা’ শব্দটির উৎপত্তি ‘গাগরা’ থেকে। যার অর্থ কলসি। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে বিভিন্ন ছোট বড় অশ্বক্ষুরাকৃতি গহ্বর। পাথরের মাঝখান থেকে প্রপাতের জল আসার সময় মাঝেমাঝেই পাথর ক্ষয়ে গর্ত হয়েছে। গ্রাম্য সুরম্য পরিবেশ, ঝোপঝাড় আর পাথুরে জলপ্রপাতের শৃঙ্খলমুক্ত সৌন্দর্য আপনার মন কাড়তে বাধ্য।
জঙ্গল যদি সত্যিই ভালোবাসেন, তাহলে আপনার পরের গন্তব্য হবেই হবে কাঁকড়াঝোড়। ‘কাঁকড়া’ শব্দের অর্থ পাহাড়, আর ‘ঝোড়’ অর্থাৎ অরণ্য। জায়গায় জায়গায় সূচিভেদ্য অন্ধকার। অনেক জায়গায় মোবাইল কাজ করে না। চিন্ময় রায় অভিনীত ‘চারমূর্তি’ সিনেমার শ্যুটিং এখানেই হয়েছিল। স্বর্গতুল্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে সঙ্গী করে ফিরে চললাম রিসর্টের পথে।
এখানে একটা কথা পর্যটকদের উদ্দেশে জানিয়ে রাখি, হাতে সময় থাকলে আমলাশোল ও হুদহুদি ঝরনা বা ঢাঙিকুসুম ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। অবশ্যই টর্চ, মোবাইল চার্জার, ওষুধ, মোমবাতি সঙ্গে রাখার চেষ্টা করবেন।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ট্রেনে ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেলপাহাড়ি। সড়কপথে কলকাতা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা।
কোথায় থাকবেন: বেলপাহাড়িতে থাকার সরকারি লজ, বেসরকারি আবাস, হোম স্টে রয়েছে। আগে থেকে বুকিং করে যাবেন।