বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
বিদ্যুৎ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে সূচনা করেন অনুষ্ঠানের। ভারতবর্ষে নীরব অভিনয়ের জনক তাঁর বন্ধুপ্রতীম যোগেশ দত্ত সম্পর্কে দু’চার কথা বলে, স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের কর্মশালা ও কাজকর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সম্পাদিকা প্রকৃতি দত্ত। তাঁর কণ্ঠে হংসধ্বনি রাগ আলাদা মাত্রা দেয়। এবারে পদাবলি সম্মান দেওয়া হয় বিখ্যাত নট-নাট্যকার চপল ভাদুড়িকে। স্মারক, ও সাম্মানিক তুলে দেন শোভনবাবু। চপলবাবু বলেন, খালেদ চৌধুরীকে আমি কখনও দেখিনি। তবে আমার জ্যাঠামশাই শিশির ভাদুড়ি, দিদি কেতকী দত্তের কাছে ওঁর কথা শুনেছি। নিজের অভিনয়-জীবনের কথা সকলের সঙ্গে ভাগ করে ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নাটকে তাঁর অভিনীত চরিত্রের কিছু অংশ অভিনয় করে দেখান চপল চৌধুরি।
শেষে যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির মূকাভিনয় সংকলন ‘আর রক্ত নয়’, ‘রাবারের পুতুল’ ‘থার্ড আম্পায়ার’, ‘ফুচকাওয়ালা’, ‘যন্ত্র মানব’, ‘হস্তশিল্প’ উপস্থাপন করে অরিন্দম বর্মন, শুভ চট্টোপাধ্যায়, দিশারী মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, প্রিয়তোষ ধর ও দিলীপ ভট্টাচার্য। প্রতিটিরই রচনা ও পরিচালনায় যোগেশ দত্ত, আবহ সঙ্গীত শুচিতা দত্ত ও প্রকৃতি দত্ত।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল পদাবলীর প্রযোজনায় ‘ক্ষুদিরাম’। শুরুতে খালেদ চৌধুরীর শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে শুচিতা দত্ত স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন সৌম্য চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্রায় ছ’দশক (৮ থেকে ৬৪ বছর বয়স) আমি খালেদকাকুর সঙ্গে ছায়ার মতো কাটিয়েছি। আমার মনে হয় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের আলোচনাই সেরা হবে। ১৯৫৮ সালে আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় খালেদ চৌধুরীর। তারপর মাঝে মাঝেই দেখা হতো। বাড়ি থেকে পালিয়ে মুসলমান নাম গ্রহণ করেন তিনি। বিজ্ঞান মানসিকতায় বিশ্বাসী খালেদকাকু ধর্ম মানতেন না। তাঁর লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বহু বই রয়েছে। উনি ১০০-র বেশি নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার মনে আছে আমি ওঁকে ‘রক্তকরবী’ নাটকে পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করতে দেখেছি। উনি ওই নাটকে সেট, পোশাক ডিজাইন করেছিলেন। আমার যখন ১৫ বছর বয়স তখন উনি আমাকে একটা দোতারা দিয়ে ভাওয়াইয়া গান বাজাতে বলেন। আমি যখন ব্যর্থ হলাম আমাকে নিয়ে ব্যর্থতার একটা গান বাঁধলেন। পরে আমাকে অসমের গোয়ালপাড়ায় নীহার বরুয়ার কাছে দোতারা শিখতে পাঠিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু লোকের লোক সঙ্গীত সংগ্রহ করে রাখেন উনি। ফোক মিউজিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট করেছিলেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্বরলিপি নিজে করেন তিনি। পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন। ওঁর সমস্ত সংগ্রহ পরে সরকারকে দেওয়া হয়। বক্তব্যের শেষে তাঁর লেখা ‘আমার শেষ ইচ্ছা’ বই থেকে পড়ে শোনান সৌম্যবাবু। যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির প্রযোজনায় মূকাভিনয় ‘ক্ষুদিরাম’ পরিবেশিত হয় এরপর।
উনিশ শতকের শুরুতে গোটা ভারতবর্ষ উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। এই আন্দোলনে শামিল হয় অনেক সাধারণ মানুষ, কিশোর, যুবক, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে সকল ভারতীয়রা। বালক ক্ষুদিরামও মাতৃভূমিকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনে। ক্ষুদিরামের রাজনীতি, বিপ্লবী কার্যকলাপ, ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া এসব কিছুই ধরা পড়ে মূকাভিনয়ে। সেই সময় একদিন পুলিস স্টেশনে বোমা ছোঁড়ার জন্য অ্যারেস্ট করা হয় ক্ষুদিরাম বসুকে এবং প্রফুল্ল চাকি নিজেই আত্মহত্যা করেন। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এই মর্মগাথা ইতিহাস সারা ভারতবাসীর মনে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯০৮ সালে ১১ আগস্ট মজফ্ফরপুরে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করে চিরতরে বিদায় নেওয়ার ঘটনাও উঠে আসে অভিনয়ের মাধ্যমে। আবহসঙ্গীত, বাঁশির সুরে বিষয়টিকে বিন্যাস করা হয়। অসাধারণ নীরব অভিনয় জানা গল্পের উপস্থাপনা সত্যিই সকলকে অবাক করে দেয়। ক্ষুদিরামের চরিত্রে অরিন্দম বর্মন এককথায় অনবদ্য। তাঁর ভাষাহীন অভিব্যক্তি ও অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসটি মনে রাখার মতো। অভিনয়াংশে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন দিশারী মুখোপাধ্যায়, শুভ্র চট্টোপাধ্যায়, তৃষা হোড়, সম্পৃক্তা, রাহুল সরকার, প্রিয়তোষ ধর, সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপম মণ্ডল, মুক্তেন্দু মণ্ডল, অনিকেত মণ্ডল, রমেশ মণ্ডল, উদ্দীপন ভট্টাচার্য, সৈকত স্বর্ণদীপ, দিলীপ ভট্টাচার্য ও শান্তিময় রায়। দিলীপ ভট্টাচার্য ও শান্তিময় রায়ের পরিচালনায় সঙ্গীতে প্রকৃতি দত্ত এবং আলোর বৈচিত্র্যে গৌতম হালদার নাটকটিকে সার্থক রূপ দেয়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগ পরিবেশিত মূকাভিনয়ে ‘মডার্ন এডুকেশন’ ছিল পরের উপস্থাপনা। এটির পরিচালক ছিলেন তরুণ প্রধান।
পদাবলির ৪১তম উৎসবের প্রতিদিনই সকালবেলা কর্মশালা ভিত্তিক মূকাভিনয়, যোগাভ্যাস, শরীরবিদ্যা ও অঙ্গসঞ্চালন, সঙ্গীত থার্ড থিয়েটার, নাটকের খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
কলি ঘোষ