সন্ন্যাসের প্রাক্কালে শুদ্ধানন্দ আলমোড়াতে স্বামী নিরঞ্জনানন্দজীর সহায়তায় বেশ কিছুদিন ধ্যান-ভজন ও তপস্যাদিতে কাটাইয়াছেন। এই সময়ের স্মৃতি-প্রসঙ্গে তিনি উত্তরজীবনে জনৈক সন্ন্যাসীকে এক পত্রে লিখিয়াছিলেন,—“ঐ সময়ে তাঁহার (নিরঞ্জনানন্দজীর) সঙ্গে আমার অনেক কথা হইত।...এবং আমাকে তপস্যার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল কালীকৃষ্ণ মহারাজকে (বিরজানন্দকে) মঠ হইতে লইয়া আসিয়া, আমরা তিনজন একসঙ্গে থাকিব এবং কোথাও একান্তে সাধন ভজন করিব। তিনি আমাকে কালীকৃষ্ণ মহারাজকে লিখিতে বলিয়াছিলেন—আমি লিখিয়াও ছিলাম—কিন্তু ঠিক সেই সময়ে তাঁহার আসিবার সুবিধা হয় নাই। সেই সময়ে তিনি (নিরঞ্জনানন্দজী) নিজেকে ঠাকুরের কথিত ঈশ্বরকোটির মধ্যে অন্যতমরূপে বলিয়াছিলেন বলিয়া আমার স্মরণ আছে। যাহা হউক ১৮৯৮ সালের বোধ হয় সেপ্টেম্বর মাসে তাঁহার সঙ্গে আমি কাশী নামিয়া আসি।” তাঁহার লেখা এই দীর্ঘপত্র হইতে জানিতে পারা যায় যে, নামিবার কালে আলমোড়া হইতে কাঠগুদাম পর্যন্ত ৩৭ মাইল পথ তিনি পায়ে হাঁটিয়াই আসিয়াছিলেন। কাঠগুদাম হইতে অবশ্য উভয়ে ট্রেন ধরিয়াছিলেন। মাদার সেভিয়ার উভয়ের পাথেয় বাবদ পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়াছিলেন তখন, কেবল নিরঞ্জনানন্দজীর জন্য লালা বদরী শা’ একটি ঘোড়ারও ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন কাঠগুদাম পর্যন্ত। পথে শুদ্ধানন্দের শরীর খুব খারাপ হইয়াছিল—পেটের অসুখের জন্য বেশ কষ্ট ভুগিতে হয়।
কাশীধামে আসিয়া বংশীদত্তের বাগানে শুদ্ধানন্দ পুনরায় নিরঞ্জন মহারাজের সাহচর্যে থাকিয়া কঠোর তপস্যায় রত হন। বাগানের একটি জীর্ণ দোতলা বাড়ীতে তাঁহাদের আসন হইয়াছিল—শরীর যাত্রা নির্বাহ হইত ছত্রের ভিক্ষায়। শুদ্ধানন্দের উত্তরকালীন স্মৃতিপ্রসঙ্গ: “আমি নিরঞ্জন মহারাজের সঙ্গে এই বাড়ীতে আড়াই মাস বাস করিয়াছিলাম। নিরঞ্জন মহারাজ একটা নীচের ঘরে থাকিতেন—দোতলার ঘরে আমি থাকিতাম। প্রথমদিন সরকার মহাশয় (বাগানের তত্ত্বাবধায়ক) আমাদিগকে খাওয়ান—পরের দিনেই নিরঞ্জন মহারাজ ও আমি ওখান হইতে এক মাইল দূরে ছত্রে প্রত্যহ যাইতে আরম্ভ করি। পূর্বে অদ্বৈতানন্দজী থাকিতেন—তাঁহার মাধুকরীর জন্য ভিক্ষাপাত্র ছিল। নিরঞ্জন মহারাজ আমার ও তাঁহার জন্য দুইটি ঐরূপ পাত্র এবং রুটি বা ভাত লইবার জন্য ঝুলি যোগাড় করেন—এক এক পয়সা দিয়া দুইটি মাটির থালাও কেনা হয়—তাহাতেই আমরা খাইতাম, আবার ধুইয়া রাখিতাম। মাধুকরী ছত্রে হইত—রুটি ও অরহড় ডালই বেশীর ভাগ পাওয়া যাইত। তখন পাঁচ-ছয়টি ছত্র ছিল—এক-আধটি ছত্রে রুটি ডালের উপর একমুঠা ভাত পাওয়া যাইত—তরকারি না’র মধ্যে। লেবু যোগাড় করিয়া নুনে জরাইয়া, টাকনা দিয়া খাওয়া হইত।”
স্বামী অব্জজানন্দের ‘স্বামীজীর পদপ্রান্তে’ থেকে