গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
এই কথা শঙ্কর মতে পারমার্থিক সত্য। ইহা ছাড়া আর একটি সত্য আছে ব্যাবহারিক সত্যে ঈশ্বর আছেন, সৃষ্ট্যাদি কার্যে আছেন। মায়ারহিত ব্রহ্মই ঈশ্বর। ঈশ্বর সগুণ সবিশেষ। তিনি সৃষ্টিকর্তা কর্মফলদাতা।
শঙ্কর আবার বলেন, সৃষ্ট্যাদির কর্তা কর্মফলদাতা একজন ভগবান্ আছেন ইহা যুক্তিসিদ্ধ নহে। কারণ ভগবান্ যদি পূর্ণতম হন আপ্তকাম হন তাহা হইলে তাঁহার সৃষ্টির কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না। আর যদি পূর্ণতম না হন তাহা হইলে অপূর্ণ ভগবানে আর জীবে পার্থক্য থাকে না। শঙ্করের এই যুক্তি হইতে মনে হয় তিনি ঈশ্বর মানেন না। কিন্তু ইহা সত্য নহে। শঙ্কর বলেন, ঈশ্বরকে যুক্তি দ্বারা মানা যায় না। তবে মানি কেন? বেদ বলিয়াছিলেন, ঋষিরা বলিয়াছিলেন। বেদবাক্য ও বিদ্বদনুভূতি ঈশ্বরসত্তার প্রমাণ।
নিরুপাধি পরব্রহ্ম সৃষ্ট্যাদির কর্তা নহেন। সোপাধিক ঈশ্বর তিনি সৃষ্ট্যাদির কর্তা। ব্রহ্ম মায়া দ্বারা উপাধিবিশিষ্ট হন। তখন ঈশ্বর হইয়া সৃষ্ট্যাদি করেন। বৈষ্ণবাচার্যেরা শঙ্করের সঙ্গে একমত নহেন। তাঁহারা বলেন ব্রহ্ম মায়াতীত সুতরাং মায়া তাঁহাকে আবরণ করিতে পারেন না। মায়োপধি ব্রহ্ম ঈশ্বর ইহা কাল্পনিক। বৈষ্ণবাচার্যেরা মায়া মানেন। তাঁহারা বলেন মায়া দ্বারা উপাধিযুক্ত হয় জীব। জীব মায়ার আবরণে আত্মতত্ত্ব ভুলিয়া—দেহকেই আত্মা মনে করে। এই জন্য জীব দেহাত্মবাদী হইয়া ঈশ্বরকে ভুলিয়া অশেষ দুঃখ ভোগ করে। শুধু জ্ঞান দ্বারা এই দুঃখ যায় না। একমাত্র ভক্তির উদয় হইলে মায়ার আবরণ কাটিলে সে যে ঈশ্বরের দাস এই অনুভূতি জাগে। দাস-ভাবে সেবা দ্বারা তার দুঃখ দূর হয় ও মুক্তিলাভ হয়। জীব ব্রহ্ম নহে। জীব মায়াবশ। ব্রহ্ম মায়াতীত। পণ্ডিতগণ তিন প্রকার ভেদের কথা বলিয়াছিলেন। সজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত। একটি গরু ও ঘোড়ায় যে ভেদ তাহা সজাতীয়। একটা গরু ও মানুষে যে ভেদ তাহা বিজাতীয়। একটা গরুর হাত পা চোখ কানের মধ্যে যে ভেদ তাহা স্বগত ভেদ।
আচার্য শঙ্কর বলেন ব্রহ্মে সজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ কোনটিই নাই। তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ এবং ‘একরসম্’। রামানুজাচার্য মতে ব্রহ্মে সজাতীয় বিজাতীয় ভেদ নাই বটে কিন্তু স্বগত ভেদ নিশ্চয়ই আছে। স্বগত-ভেদ বিশিষ্ট ব্রহ্মই ঈশ্বর। তাহাতে দুইটি ভেদ জীব ও জগৎ—চিৎ ও অচিৎ। চিজ্জড় বিশিষ্ট ব্রহ্ম। তিনিই ঈশ্বর। পরমেশ্বরই বিষ্ণু।
ব্রহ্ম পারমার্থিক সত্য আর ঈশ্বর ব্যাবহারিক সত্য। মায়াবৃত ব্রহ্মই ঈশ্বর। শঙ্করের এই সব সিদ্ধান্ত রামানুজ একেবারেই গ্রহণ করেন নাই। তিনি বলেন, ও সব মায়াবাদীদের কল্পনা মাত্র। ঈশ্বর সবিশেষ; চিৎ এবং জড় তাঁর দুই বিশেষ। ঈশ্বর সগুণ—তিনি অনেক কল্যাণ গুণের খনি। তাঁহাতে গুণ নাই অর্থ অগুণ নাই। প্রত্যেকটি জীব ঈশ্বরের অভিব্যক্তি। তাঁহারই পরম চৈতন্যের অংশ কণা। “মমৈবাংশোজীবলোকে”—গীতা এই কথাই স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন। বিশ্বজগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি, বেদান্ত সূত্রই বলিয়াছেন—“জন্মাদ্যস্য যতঃ”; বিশ্বের জন্ম-স্থিতি-লয় যাহা হইতে তিনিই ঈশ্বর।