শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
সেদিন সন্তানদের আশ্বস্ত করলেও মনের গভীরে কষ্টের সেসব দিনের কথা রদ্রিগেজের মনে এখনও যেন জীবন্ত। ভীষণ অর্থের প্রয়োজন ছিল তাঁর। নিজেদের বাড়িটা হারিয়েছিলেন। অথচ, ওই বাড়ির ঋণেই তাঁর দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল। সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে করলে এখনও গলাটা ধরে আসে তাঁর। ২০০৮ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা হাজার হাজার মানুষের মতো তাঁর জীবনও পাল্টে দিয়েছিল। রদ্রিগেজ এখন ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি শহরে একটি ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক লহমায় লেম্যান ব্রাদার্স নামে বৃহৎ মার্কিন সংস্থাটি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। সরকারি সাহায্য, পৃষ্ঠপোষকতায় যে সংস্থা দিব্যি ফুলেফেঁপে উঠছিল, তা হঠাৎ করে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া যে কত বড় ঘটনা, গোটা দুনিয়া সেটা টের পেল এক মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে। ২০০৮ সালের আগের পাঁচ বছরের কথা মনে রাখলে এই ঘটনার আকস্মিকতা আরও স্পষ্ট হবে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতেই জোয়ার এসেছিল। কার্যত সব দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারই ঊর্ধ্বগামী হয়েছিল। যে দেশগুলি এখন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃত, তাদের উত্থানও এই পর্বেই। ২০০৮ সালের মন্দার ধাক্কা সব দেশের গায়েই লাগল। ধাক্কা লেগেছিল জেসাস রদ্রিগেজের মতো লাখো লাখো পরিবারের গায়েও।
২০০৫ সালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভেনেজুয়েলা থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন রদ্রিগেজ। অল্প দিনেই ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনেন তিনি। আমেরিকার মতো দেশে নিজের বাড়ি থাকায় নিজেকে অসম্ভব সৌভাগ্যবান বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন তিনি। ওই সময় একটি ছাপার দোকানে চাকরি করে বছরে ১৫ হাজার ডলার পেতেন রদ্রিগেজ। এত অল্প বেতনের চাকরি অথচ বাড়ির মালিক হয়েছেন, এ যেন এক স্বপ্ন পূরণই ছিল তাঁর কাছে। ওই সময়টায় রদ্রিগেজের মতো অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনেছিলেন। রদ্রিগেজের এক প্রতিবেশী যিনি ঘরে ঘরে পিৎজা পৌঁছানোর চাকরি করতেন, তিনিও ঋণ নিয়ে কিনে ফেললেন বাড়ি। তবে তাঁদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
গোলযোগের সূত্রপাত ২০০৮ সালে, যখন বোঝা গিয়েছিল আমেরিকার অনেক ব্যাঙ্ক বেপরোয়া ধার দিয়েছে আর বিভিন্ন জটিল সিকিয়োরিটির মোড়কে পুরে ঋণ আদায়ের ভার পাচার করেছে অন্যান্য আর্থিক সংস্থার ঘাড়ে। ঋণের বেনোজল ঢুকে বাড়িঘরের দাম ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। সেই ফানুসটা যখন ফাটতে শুরু করল আর ঋণ গ্রহীতারা দেউলিয়া হতে আরম্ভ করলেন, আমেরিকার যাবতীয় ব্যাঙ্ক আর আর্থিক সংস্থার নাভিশ্বাস উঠল। ব্যবসায় টাকাপয়সার লেনদেন নিতান্তই জরুরি। ভয়ে ভাবনায় সেটাই গেল প্রায় বন্ধ হয়ে। এ থেকেই মন্দার সূত্রপাত। নব্বইয়ের দশকে বিল ক্লিন্টন এবং রিপাবলিকান কংগ্রেসের জমানায় ব্যাঙ্কিংয়ের নিয়মকানুন অনেক শিথিল করা হয়েছিল। এই বিপর্যয়ের পিছনে তার খানিক অবদান আছে, সে সন্দেহ অমূলক নয়। তবে, দুর্নীতি আর লোভের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে বসে থাকলে ভুল করা হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্থির জলাশয়ের মতো নয়, সেখানে ঢেউয়ের ওঠাপড়া চলবেই। পুঁজির নিয়মই হল, মুনাফার লোভে নতুন বিনিয়োগ, নতুন কর্মকাণ্ডের পিছনে ধাওয়া করে বেড়ানো। কোথায় উৎপাদনশীল কাজ পুঁজির অপেক্ষায় আটকে রয়েছে, আর কোথায় মিথ্যা আশার হাতছানি দেখা যাচ্ছে, এটা অনেক সময়েই আগে থেকে স্পষ্ট বোঝা মুশকিল। যাঁরা ব্যাঙ্কদের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন, তাঁরা কিন্তু প্রায় কেউই ঘটনার আগে টের পাননি যে ঘরবাড়ির দাম বুদবুদের মতো ফুলে উঠেছে ফাটকাবাজির খেলায়। চোর পালানোর পর অনেকেরই বুদ্ধি বেড়েছে। যাবতীয় আর্থিক দুরাচার যদি বন্ধ করাও যায়, তা হলেও কিন্তু কখনও সখনও পুঁজির বাজারে সংকট আর অর্থনৈতিক মন্দার আবির্ভাব ঠেকানো যাবে না। তবে কিছু কিছু ব্যবস্থা নিলে ঝাপ্টাটা কম লাগতে পারে, মন্দার খপ্পর থেকে বেরনো যায় তাড়াতাড়ি। মুশকিল হল, রোগীকে ঠিকঠাক দাওয়াইটা দেওয়া হচ্ছে না, বরং মাঝে মধ্যে ভুল ওষুধ খেয়ে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এর পিছনে সাধারণ মানুষ আর রাজনীতিকদের অর্থনৈতিক বোধের অভাব কিছুটা কাজ করছে। বাকিটা রাজনীতির খেলা। কিন্তু যখন এই আবাসন খাতের বুদবুদ ছাপিয়ে পড়ল, তখন বাড়ির দামও কমে গেল। আর বন্ধকি ঋণের সুদের হারও রাতারাতি বেড়ে গেল। একেকজনের ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা বেড়ে গেল বহু গুণ। অনেকেই ঋণ পরিশোধের কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। রদ্রিগেজের ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়ে গেল। ২০০৮ সালে এসে তাঁর ২ লাখ ৪০ হাজার ডলারের সম্পত্তির দাম কমে হল মাত্র ৪৯ হাজার ডলার। ব্যস, সব শেষ!
ব্যাঙ্কগুলো যখন ঋণের সামঞ্জস্য করা শুরু হল, তখন অনেকেই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। পুরো বিষয়টি অর্থনীতিতে একধরনের তরঙ্গ প্রভাব ফেলে। অনেকটা পুকুরে পাথর ফেলে তরঙ্গ সৃষ্টি করার মতো। একদিকে বন্ধকি জমির দখল নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন করে বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করেছে মানুষ। এই কারণে বাড়ির দাম পড়তে শুরু করে। আবাসন খাতের সঙ্কট ছড়িয়ে গেল আর্থিক ক্ষেত্রে। আর্থিক ক্ষেত্রে ও অর্থনীতিতে মন্দা এভাবে শুরু হওয়ার পর তা ছড়িয়ে পড়ে ওই সব শিল্পে, যেগুলো আর্থিক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের পর ওটাই ছিল মার্কিন মুলুকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা।
সব কিছু খুইয়ে রদ্রিগেজ এখন একটি বিমা কোম্পানির আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। নিজের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষা তিনি অন্য মানুষকে দেন। সবাইকে তাঁর মতো ঋণের ভারে না জড়ানোর পরামর্শ দেন রদ্রিগেজ। কিন্তু রদ্রিগেজ কি জানেন, তাঁর দেশে এখন সরকারি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ২২ ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে দাঁড়িয়েছে। গোটা দুনিবার মতো আমেরিকার অর্থব্যবস্থাতেও অনিশ্চয়তা বেড়ে চলেছে। ২০১০-এ যে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তা যেন ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনেক সমস্যা। অঢেল খরচ করা হয়েছে ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’-এর নামে। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি বলা চলে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না। বেকারত্বের হার বাড়ছে। ভোগব্যয়ও তলানিতে। সরকারি ঋণের বোঝা জাতীয় আয়ের সমান সমান। কংগ্রেস অনুমতি না দিলে নতুন করে আর ঋণ করার উপায় নেই। হয়তো সরকার অনুমোদন পাবে, কিন্তু তা হলেই ঋণের বোঝা যে আরও বাড়বে। তাহলে কি আমেরিকার অর্থব্যবস্থা আরও একটি বিপর্যয়ের অপেক্ষায়? সেই সেই মন্দার দুঃস্বপ্ন আজও যে তাড়া করছে। বার বার আঁতকে উঠছেন ৫৮ বছরের রদ্রিগেজ!