বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
অক্ষয় তৃতীয়া ১৪৩১
 

অক্ষয় তৃতীয়া ও শ্রীকৃষ্ণ
সমুদ্র বসু

 

অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে যা কিছু করা হয় তা অক্ষয় হয়ে থাকে বলে জনমানসে বিশ্বাস। শ্রীকৃষ্ণকে জড়িয়ে মহাভারতে এই তিথিতে ঘটেছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কী সেই ঘটনাবলি? মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ এক নির্মম ছবি। ভরা রাজসভায় রাজকুলবধূ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা মহাভারতের মহাযুদ্ধের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল। বলে পাশা খেলায় ছলনার আশ্রয় নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে হারান দুর্যোধন, শকুনি। অহংকারী দুর্যোধন দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসার জন্য ভাই দুঃশাসনকে নির্দেশ দেন। তাঁর বস্ত্রহরণের নির্দেশ দেন। যখন দ্রৌপদীকে বাঁচাতে কেউ এল না, তখন নিজেই এক হাত দিয়ে নিজের লজ্জা আবৃত করেছিলেন এবং অন্য হাত ওপর করে কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন—‘হে গোবিন্দ আমার লাজ রক্ষা কর।’
পরমেশ্বর ভগবান চোখের পলকে এসে দ্রৌপদীর লজ্জা রক্ষা করেন। তাঁর আশীর্বাদে দ্রৌপদীর শাড়ি হয় অক্ষয়। যে তিথিতে মহাভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী এই ঘটনা ঘটে সেটিই অক্ষয় তৃতীয়া। তাই হয়তো দ্রৌপদীর শাড়ি অক্ষয় হয়েছিল।  
এখানেই শেষ নয়। মহাভারতে দ্রৌপদী ও কৃষ্ণকে জড়িয়ে আবারও একবার উপলব্ধ হয় অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য। পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা বনগমন করলে অগণিত ব্রাহ্মণ ও মুনি-ঋষি তাঁদের সঙ্গ নেন। যুধিষ্ঠির পড়েন বিপাকে। তাঁরা সব কিছু ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছেন। রাজধর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ ও অতিথির সেবা একান্ত কর্তব্য। কী করে তিনি অতিথিদের সেবা করবেন, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে পুরোহিত ধৌম্যের শরণাপন্ন হন যুধিষ্ঠির। ধৌম্যের কথা মতো যুধিষ্ঠির সূর্যদেবের পুজো করলেন। সূর্য তুষ্ট হয়ে তাঁকে এক তামার পাত্র দান করলেন এবং বললেন, ‘বনবাসের দ্বাদশ বৎসর এই তাম্রস্থালিই তোমাদের অন্ন দেবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত দ্রৌপদী আহার করছেন, ততক্ষণ এই পাত্রের আহার্য ফুরবে না।’ সূর্যের কাছ থেকে সেই পাত্র লাভ করে যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত মনে বনবাসী হয়ে সাধুসঙ্গ ও অতিথি সেবা করতে লাগলেন। সূর্যের দেওয়া পাত্রের কথা কৌরবদেরও কানে পৌঁছল। তাঁরা পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করার নানা উপায় খুঁজছিলেন। দুর্যোধন ঠিক করলেন, দুর্বাসাকে সশিষ্য বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে পাঠালে তাঁরা জব্দ হবেন। শকুনির পরামর্শে তিনি দুর্বাসাকে বললেন, পাঞ্চালির ভোজন হয়ে যাওয়ার পর অপরাহ্নে তিনি যেন পাণ্ডবদের আতিথ্য গ্রহণ করে আহার্য চান। দুর্বাসা রাজি হয়ে বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে শিষ্যদের নিয়ে উপস্থিত হন। দুর্বাসা বললেন, তিনি স্নান সেরে আসছেন। ফিরে যেন আহার্য পান।
পাঞ্চালি পড়লেন মহা বিপদে। উগ্রতেজা মুনিকে তুষ্ট করতে না পারলে পাণ্ডবরা ভস্ম হয়ে যেতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি তাঁর প্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, তিনি নিজেই দারুণ ক্ষুধার্ত। কৃষ্ণা যেন তখনই তাঁর আহারের ব্যবস্থা করেন। পাঞ্চালী জানালেন, সব আহার্য নিঃশেষিত। দ্রৌপদী পাত্রটি নিয়ে এলে কৃষ্ণ দেখলেন, তার কানায় সামান্য শাকান্ন লেগে রয়েছে। তিনি সেটুকুই খেয়ে বললেন, ‘বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন। তুষ্ট হন।’ তার পর সহদেবকে বললেন, দুর্বাসাদের ভোজনের জন্য ডেকে আনতে। দুর্বাসাদের আহ্নিক তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু তাঁরা টের পেলেন, উদর পরিপূর্ণ। তাঁদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। দুর্বাসা প্রমাদ গুনলেন। তিনি সশিষ্য পলায়ন করলেন। সূর্যপ্রদত্ত তাম্রপাত্রকে যে দিন অক্ষয়পাত্রে পরিণত করেছিলেন কৃষ্ণ, পৌরাণিক কাল থেকে মনে করা হয় সেই দিনটিই ছিল অক্ষয় তৃতীয়া।
শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে থাকাকালীন সময় সেখানে এক পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিল। সুদামা বিপ্র তার নাম।  সে ছিল কৃষ্ণের সখা। আমরা জানি শ্রীকৃষ্ণ কংস বধের জন্য বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা চলে গিয়েছিলেন। আর তারপর তিনি যখন বুঝলেন যে মথুরাতে থাকা যাদবদের জন্য অসুরক্ষিত তখন তিনি যাদবদের রাজধানী দ্বারকাপুরীতে স্থানান্তরিত করে সেখানে শান্তিতে বসবাস শুরু করলেন। এদিকে এত কষ্টের দিন যাপন করতে করতে একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সুদামা পত্নীর। সে সুদামাকে বারবার বলতে থাকে একবার শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে নিজের কষ্টের কথা বলতে। পত্নীর বারবার পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে শেষে সে মনস্থির করল দ্বারকা যাওয়ার জন্য।  
দ্বারকায় যেতে মনস্থ করে সে পত্নীর কাছে জানতে চাইল, কৃষ্ণকে দেওয়ার জন্য গৃহে কিছু আছে কি না, কেননা সখার জন্য অবশ্য কিছু উপহার নেওয়া চাই। অবিলম্বে সুদামা পত্নী চার মুঠো চাল প্রতিবেশী বান্ধবীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে একখণ্ড কাপড়ে বেঁধে কৃষ্ণকে উপহার দেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে দিল। শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করবার উদ্দেশ্যে উপহারটি নিয়ে, ব্রাহ্মণ সুদামা তক্ষুণি দ্বারকার দিকে যাত্রা করল। যাদব রাজন্যবর্গের প্রাসাদে উপস্থিত হওয়া অবশ্য খুবই কঠিন, কিন্তু বৃন্দাবন থেকে আসা সেই হতদরিদ্র ব্রাহ্মণকে তবু রাজদর্শনের সুযোগ দেওয়া হল। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীদেবীর পালঙ্কে বসেছিলেন। বেশ কিছুটা দূরে হলেও ব্রাহ্মণকে তাঁর গৃহের দিকে আসতে দেখে, তার সখা বলে তিনি চিনতে পারলেন। তক্ষুণি আসন ত্যাগ করে সখাকে স্বাগত জানাতে শ্রীকৃষ্ণ এগিয়ে গেলেন। তার কাছে উপস্থিত হয়ে দুবাহু দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণকে আলিঙ্গন করলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ শয্যায় ব্রাহ্মণকে বসালেন। একজন পূজনীয় অতিথিকে যেভাবে অভ্যর্থনা করা উচিত ঠিক সেই রকম ভাবে ব্রাহ্মণকে অর্পণের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নানা রকম ফল ও পানীয় নিয়ে এলেন। কৃষ্ণপত্নী রুক্মিণী স্বয়ং চামর দিয়ে তাকে ব্যজন করতে লাগলেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণকে ওইভাবে অভ্যর্থনা করায় প্রাসাদের অন্যান্য রমণীরা অবাক হয়ে যান। অপরিচ্ছন্ন দীন-বেশযুক্ত এই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং কীভাবে অভ্যর্থনা করলেন রমণীরা অবাক হয়ে তা ভাবতে লাগলেন। কিন্তু তখন তারা একথাও বুঝতে পারলেন যে, এই ব্রাহ্মণ একজন সাধারণ জীব নন—তিনি নিশ্চয় বহু পুণ্যকর্ম করেছেন। তা না হলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কেন তাঁকে এমনভাবে সাদরে অভ্যর্থনা করবেন? তার উপর ব্রাহ্মণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শয্যায় উপবিষ্ট দেখে তারা আরও বিস্মিত হলেন। অগ্রজ শ্রীবলরামকে যেভাবে আলিঙ্গন করেন, কৃষ্ণ ব্রাহ্মণকেও সেইভাবে আলিঙ্গন করায় তারা বিশেষভাবে অবাক হলেন কেননা শ্রীকৃষ্ণ তার অগ্রজ বলরামকেই শুধু সেইভাবে আলিঙ্গন করেন, অন্য কাউকেই করেন না।
ছোটবেলার নানা স্মৃতি ও গল্পে সুদামার সঙ্গে মশগুল হয়ে পড়েন শ্রীকৃষ্ণ। তারপর তিনি  হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রিয় বন্ধু, আমার জন্য তুমি কি এনেছ? তোমার স্ত্রী কি আমার জন্য কোনও উপাদেয় খাবার তোমার সঙ্গে পাঠিয়েছে?’ বন্ধুর উদ্দেশ্যে এই কথা বলার সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্ৰীকৃষ্ণ অত্যন্ত প্রীতিসহকারে হাসছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন, ‘প্রিয় সখা, গৃহ থেকে তুমি নিশ্চয় কিছু উপহার আমার জন্য এনেছ।’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে খাওয়ার অনুপযুক্ত অতি তুচ্ছ চাল দিতে সে ইতস্তত  করছে। তাই সুদামার মনোভাব বুঝতে পেরে ভগবান বললেন, ‘বন্ধু, নিঃসন্দেহে আমার কোনও অভাব নেই, কিন্তু ভক্ত যদি প্রীতি ভরে আমাকে কোনও দ্রব্য দান করে, তা অতি তুচ্ছ হলেও, পরম প্রীতি সহকারে আমি তা গ্রহণ করি।’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, গৃহ থেকে আনা চাল তিনি অত্যন্ত আনন্দ সহকারে গ্রহণ করবেন, তবু অত্যন্ত লজ্জাবশত সুদামা ওই চাল তাঁকে দিতে খুবই দ্বিধাবোধ  করলেন। তিনি তখন ভাবতে থাকলেন কীভাবে সে শ্রীকৃষ্ণকে এই অতি তুচ্ছ দ্রব্য অর্পণ করবে। এই রকম ভেবে সে লজ্জায় মাথা নত করে রইল।
অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই হৃদয়ের ভাব জানেন। তিনি জানতেন যে চরম দারিদ্র পীড়িত হয়ে পত্নীর অনুরোধে সে তাঁর কাছে এসেছে। একই আশ্রমের সহপাঠী প্রিয় সখা সুদামার কথা চিন্তা করে, তিনি জানতেন সখারূপে তাঁর প্রতি সুদামার অনুরাগ কখনওই জড় বাসনাময় ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে ভাবলেন যে পত্নীর অনুরোধে তাঁকে পরিতুষ্ট করবার জন্য সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে—তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা করতে সে এখানে আসেনি। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রেরও কল্পনাতীত বিপুল ঐশ্বর্য সুদামা বিপ্রকে প্রদান করতে ইচ্ছা করলেন। তারপর দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাধে ঝুলন্ত পুটলিতে রাখা চাল কৃষ্ণ ছিনিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সখা, এ কী? তুমি আমার জন্য উপাদেয় চমৎকার চাল এনেছ।’ সুদামাকে অনুপ্রাণিত করে তিনি আরও বললেন, ‘এই চাল শুধু আমাকেই সন্তুষ্ট করবে না, সমগ্র বিশ্বকে তা তুষ্ট করবে।’
শ্রীকৃষ্ণের কথাতেই যেন লুকিয়ে ছিল অক্ষয় হওয়ার গল্প।  আসলে সেদিনটা ছিল অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় মানে, ‘অবিনশ্বর’ বা ‘যা কখনও হ্রাস পায় না।’ 

10th     May,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ