বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

লড়াইয়ের অপর নাম মানসী

ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। দুর্ঘটনায় হারান একটি পা। কিন্তু হেরে যাননি। তারপর থেকে ব্যাডমিন্টনই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মনের অদম্য শক্তিতে ভর করে সাফল্যের শিখর ছুঁয়েছেন মানসী। সেই অনুপ্রেরণার গল্পই শোনালেন সৌগত গঙ্গোপাধ্যায়

২০১১ সালের ২ ডিসেম্বর! প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল অফিস বেরিয়েছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মানসী যোশি। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মেরেকেটে ৭ কিলোমিটার। তবুও মুম্বইয়ের ট্রাফিক! কোনও ভরসা নেই। তাই ২২ বছর বয়সি তরুণী স্কুটিতেই যাতায়াত করেন। সেদিনও অন্যথা হয়নি। কিন্তু যাত্রা শুরুর ১০ মিনিটেই মানসীর জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। উড়ালপুলের তলায় ইউ-টার্ন নেওয়ার সময় উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসা এক ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারে তরুণীর স্কুটিতে। কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচলেও, বাঁ পা পিষে দেয় দৈত্যকার ট্রাক। সঙ্গে সঙ্গে পথচারীরা ছুটে আসেন। কিন্তু কী করবেন খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। শেষ পর্যন্ত পুলিস এসে স্ট্রেচারে করে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা। পরিকাঠামো না থাকায় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। দুর্ঘটনা ঘটে সকাল ৮-৩০ মিনিটে। চিকিত্সা শুরু হতে বিকেল পাঁচটা! আর তাতে আশঙ্কাটা সত্যি হয়। পরের ৪৫ দিনে মোট ছ’টি অস্ত্রোপচারের পরেও হার মানেন চিকিত্সকরা। মানসীর বাঁ পা কেটে বাদ দিতে হয়।
সেদিন যদি মানসীকে আরও আগে হাসপাতালে ভর্তি করা যেত! আরও আগে যদি চিকিত্সা শুরু হতো! হয়তো তাঁর পা-টা বাঁচানো যেত!...কিন্তু মানসী যোশি যে লড়াইয়ের অপর নাম! আফশোস করে বাড়িতে বসে থাকার মেয়ে নন। বরং প্রতিবন্ধকতাকে শক্তি বানিয়ে জীবনে নতুন দিশা খুঁজে নিয়েছেন। বর্তমানে ভারতের অন্যতম সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদ তিনি। ২০১৯ সালে প্যারা ব্যাডমিন্টনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী। ভারতের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের কভারে তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়!
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসেছিলেন মানসী। সেখানে একান্ত সাক্ষাত্কারে তারকা ক্রীড়াবিদ বলছিলেন, ‘প্রথমেই আমার মা-বাবাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ওই দুর্ঘটনা ছিল ওঁদের কাছে বড় ধাক্কা। কিন্তু কখনও আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেননি। বরাবর আমার পাশে থেকেছেন। ভরসা জুগিয়েছেন। ওঁরা বলতেন, ১০০ শতাংশ উজাড় করে দে। মা-বাবা-ই আমার জীবনের অনুপ্রেরণা।’ মানসীর ব্যাডমিন্টনেও হাতেখড়ি করিয়েছিলেন তাঁর বাবা। মাত্র ছ’বছর বয়সে মেয়ের হাতে র‌্যাকেট ধরিয়ে দেন ভাবা অ্যাটমিক সেন্টারের বিজ্ঞানী গিরীশচন্দ্র যোশি। এরপর স্কুল, কলেজ ও জেলাস্তরেও ব্যাডমিন্টন খেলেছেন মানসী। তবে খেলাধুলো ছিল তাঁর হবি। আসল লক্ষ্য ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। স্বপ্নপূরণে সফলও তিনি। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ের মতো পথ দুর্ঘটনা তাঁর জীবনকে ওলটপালট করে দিল। তারপর প্রস্থেটিক পায়ে রিহ্যাবের সময় ব্যাডমিন্টন খেলতেন মানসী। এই খেলার প্রতি প্রেম যে সেই ছোটবেলা থেকে! তাই প্রতিদিনই অবসর সময়ে কোর্টে নেমে পড়তেন তিনি। প্রস্থেটিক পায়ে হাঁটা রপ্তের পর অফিসের বিভিন্ন কর্পোরেট টুর্নামেন্টেও খেলতেন। সেখানে তাঁর প্রতিভা চোখে পড়ে প্যারা ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার নীরজ জর্জের। মানসীকে পেশাদারভাবে ব্যাডমিন্টন খেলার পরামর্শ দেন তিনি। বন্ধুর কথামতো ২০১৪ সালে প্যারা এশিয়ান গেমসের জন্য ট্রায়াল দেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থ হন। তবে হাল ছাড়েননি। সেবছরই ডিসেম্বরে কেরিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে রুপো জেতেন। পরের বছর অংশ নেন স্প্যানিশ প্যারা ব্যাডমিন্টনে। সেখানে অবশ্য কোনও পদক জেতেননি তিনি। তবে আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়তে থাকে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি। শুরুর দিকে চাকরি ও খেলাধুলো একসঙ্গে চালানো সম্ভব হয়ে উঠছিল না। ২০১৬ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যাডমিন্টনে মনোনিবেশ করেন। তবে মানসীর কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ২০১৮ সালে গোপীচাঁদ অ্যাকাডেমিতে যোগদান। দক্ষ কোচেদের তত্ত্বাবধানে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে তাঁর। ফলও মেলে হাতেনাতে। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের বেসিলে প্যারা ব্যাডমিন্টনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। এরপর ২০২০ সালে প্রথম ভারতীয় অ্যাথলিট হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের ‘দ্য নেক্সট জেনারেশন লিডার’ রূপে সম্মানিত হন। ২০২২ সালের মার্চে মহিলা সিঙ্গলস এসএল-৩ বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে আসেন তিনি। মানসী বলছিলেন, ‘ব্যাডমিন্টনকে ছোট থেকেই ভালোবাসি। দুর্ঘটনার পর পেশাদার হিসেবে খেলতে শুরু করি। শারীরিকভাবে ব্যাডমিন্টন খেলা কখনও চ্যালেঞ্জ মনে হয়নি। তবে শুরুর দিকে আর্থিক সমস্যায় ভুগতাম। পাশাপাশি প্যারা অ্যাথলিটদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব ছিল। এখন অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টেছে।’ ২০২২ হাংঝউ এশিয়ান গেমসেও সিঙ্গলসে ব্রোঞ্জ এবং ডাবলসে রুপো জেতেন মানসী। ৩৪ বছর বয়সেও এই খেলার প্রতি তাঁর খিদে এতটুকুও কমেনি। সত্যিই মানসী যোশি এখন সবার কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁর কথায়, ‘পথটা সহজ ছিল না। তবে মানসিক দৃঢ়তা কখনও হারাইনি। ভাগ্যের পরিহাসে আমার মতো এমনটা অনেকেরই হয়ে থাকে। তাদের বলব, প্রতিবন্ধকতাকে শক্তি বানিয়ে এগিয়ে যাও।’

28th     April,   2024
অক্ষয় তৃতীয়া ১৪৩১
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ