বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
হ য ব র ল
 

আর এক রঘুর গল্প
চন্দন চক্রবর্তী

রঘু নামটা শুনলেই ইয়া মোটা বিড়াল লেজের মতো গোঁফ আর তাগড়াই চেহারার রঘু ডাকাতের কথা মনে পড়ে। যে কিনা গ্রামের অবস্থাপন্নদের বাড়িতে আগাম চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করতে যেত। জমিদার বাড়ির লেঠেলদেরও লাঠির আঘাতে ঘায়েল করত। নিজে কখনও হার মানত না।
হার না মানা আর এক রঘুর কথা বলি। তার নাম রঘু নন্দন গোপ। আসল বাড়ি বিহারে। কিন্তু বাস ছিল মেদিনীপুর শহরে। সে ছিল গোয়ালা। বাড়ি বাড়ি দুধ দিত।
একসময়ে তিনজন ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করে হত্যা করেছিল, আমাদেরই দেশের দামাল বীর, অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে শহিদ হয়েছিলেন। রঘুর কথা বলার আগে ছোট্ট করে সেই ইতিহাস বলে নিই। 
সেই সময়ে বিপ্লবীরা জেহাদ ঘোষণা করলেন, ‘এই হিংস্র কুখ্যাত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যেই আসুন না কেন তাঁকে হত্যা করা হবে। কোনও ইউরোপিয়ানদের বরদাস্ত করা হবে না।’
প্রথম জন জেমস পেডি। তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন দুই বিপ্লবী বিমল দাসগুপ্ত ও যতিজীবন। দিনটা ছিল ৭ এপ্রিল, ১৯৩১। তখন বিকেল পাঁচটা। বিমল আর যতিজীবন ম্যাজিস্ট্রেট  পেডি সাহেবের বাংলোর সামনে, ডায়মন্ড গ্রাউন্ডে। উদ্দেশ্য তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখা। দুজনে তখন যেন কত প্যারেড করতে ব্যস্ত। হঠাৎ  নজরে এল সশস্ত্র  সিপাই, ব্রিটিশ পুলিস তাঁর দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা, এত ভয়! মুহূর্তে ওরা প্যারেড ছেড়ে সোজা বাড়িতে।
যে যার অস্ত্র পেটের খাঁজে গুঁজে সোজা হাজির। পেডি সাহেব তখন স্কুলের বিশাল ঘরে প্রদর্শনী দেখতে ব্যস্ত। দ্রিম দ্রিম করে ঝলসে উঠল ওদের রিভলবার। উনি লুটিয়ে পড়লেন। ত্রাহি ত্রাহি করে মুহূর্তে ঘর ফাঁকা। ওরা অক্লেশে পালিয়ে যায়।
পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর কে ডগলাস। তিনি তখন বিকেল চারটে নাগাদ জেলাবোর্ডের সভায় ব্যস্ত। চাদ্দিকে কঠোর সশস্ত্র সিপাহি পুলিস প্রহরায়। যাতে মাছি না গলতে পারে। বিশ্বাস নেই মেদিনীপুরের দামাল ছোকরাগুলোকে। বলতে বলতে আর এক এপ্রিল এসে গেল। হঠাৎই দেখা গেল চশমা পরা ছদ্মবেশে দুই যুবক। তীব্র গতিতে দৌড়ে চলে গেল ডগলাস সাহেবের টেবিলের সামনে। আগুনের গোলার মতো বুলেট বর্ষিত হল। সবাই যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। কেউ টেবিলের তলায়, কেউ দরজার আড়ালে। সেই সুযোগে ঝড়ের গতিতে ওরা পালিয়ে গেল। একজন ছিলেন ১৮ বছর বয়সি প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য। অপরজন প্রভাংশু শেখর পাল। সে পালিয়ে  যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস। রিভলবার অকেজো থাকার ফলে গুলি করতে সক্ষম হয়নি প্রদ্যোৎ। ধরা পড়ে যায়। পরে ফাঁসি।দিনটি ছিল আর এক এপ্রিল। ৩০ এপ্রিল, ১৯৩২।
পরের বছর মি বার্জ। ভীত সমস্ত সাহেবকে অনেক চেষ্টা করেও এপ্রিলে হত্যা করা গেল না। কিছুটা পিছিয়ে গেল। দিনটি ছিল ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বেচারা এসেছিলেন পুলিস গ্রাউন্ডে। ফুটবল ম্যাচ দেখতে।গুলি করে হত্যা করেছিলেন দুই বিপ্লবী, অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্ত। তারা পালায়নি।বীরদর্পে বার্জের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের যত আক্রোশ মেটাচ্ছিল।ভ্রুক্ষেপহীন তাদের খেয়াল হল না পালাতে হবে।সেই সুযোগে
তাদের  ব্রিটিশ পুলিস গুলি করে হত্যা করে।
রঘুনন্দন এইসব অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কার্যকলাপ দেখেছে। ভেতরে ভেতরে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
এবারে আসা যাক রঘুনন্দনের কথায়। সে গোয়ালা হতে পারে কিন্তু পরাধীন দেশের যন্ত্রণা তাকেও নাড়া দেয়। দেশের জন্য কিছু একটা করার কথা ভেবে হাত নিশপিশ করত। বলবান যুবক ভাবত, ‘যদি একটা সুযোগ পাই কোনও দিন....’
মানুষের প্রবল ইচ্ছে, মনের জোর, কাজে নিষ্ঠা এবং সততা থাকলে ঈশ্বর বোধ হয় সুযোগ করে দেয়।
সে একটা সু্যোগ পেয়ে গেল।
কীভাবে?  সেটা এবার বলি...
তখনও জেমস পেডির হত্যাকারী বিমল দাসগুপ্ত ফেরার। চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। ব্রিটিশ পুলিস এবং স্তাবকেরা হন্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু এভাবে শহর মেদিনীপুরে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে বেশিদিন থাকা যাবে না। কলকাতার বিপ্লবীদের ডেরায় পালিয়ে যেতে হবে।
কীভাবে তা সম্ভব! সত্যেন বসুর বাড়িতে গোপন সভা বসেছে। বাঘা বাঘা বিপ্লবীরা উপস্থিত। রাত হচ্ছে। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। নিথর নিস্তব্ধ শহর। রাত ঝিঝি  ডেকে চলেছে আর মিটমিট জোনাক আলো বাইরে। থমথমে পরিবেশ। কোনও বুদ্ধি আর বেরয় না। অথচ সেখানে উপস্থিত বিনয় দাসগুপ্ত (মেজদা),ভূপেন বসু (কেতনবাবু) এবং বিমল দাসগুপ্ত নিজে। শুধু ফিসফাস কথা চলেছে। হঠাৎ  দরজার বাইরে খুট করে শব্দ! কোমরে গোঁজা রিভলবারের ট্রিগারে হাত রেখে ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়ে গেল বিমল দাসগুপ্ত! দেখা গেল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গোঁফওয়ালা পাগড়ি বাঁধা গলায় গামছা পরা একটি লোক! আলোতে এনে দেখা গেল, ‘আরে এ তো আমদের রঘু!’ তাহলে তুমিই পুলিসের চরের খাতায় নাম লিখিয়েছ? রঘু পাগড়ি খুলে পায়ের কাছে বসে পড়ে। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে।
‘বিশ্বাস করুন আপনাদের মতো বড় কাজ না হলেও, দেশের স্বাধীনতার জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে। মরণকে ভয় পাই না। কিছু করতে পারলে ধন্য হব। আমাকে সুযোগ দিলে বিমলবাবুর সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি।’ সবাই চমকে উঠলেন। বলে কী?
চারদিকে বাজ পাখির মতো শ্যেনদৃষ্টি!  তাছাড়া ওকে কি আদৌ বিশ্বাস করা যায়?
বিপ্লবী বিমল দাসগুপ্ত সাচ্চা দেশপ্রেমিকের চোখ দেখে চিনতে পারে। ও মিথ্যে বলার লোক নয়। অতএব ওকে সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে।
তেজোদ্দীপ্ত রঘু নন্দন পাগড়ি খুলে গোঁফে তা মেরে বলল, ‘আমিই বিমলবাবুকে পার করে দিব।’ সবাই অবাক। চোখেমুখে অনেক প্রশ্ন। কীভাবে!
এবারে আসা যাক সেদিনের ঘটনাতে।
তখন রাত দশটা বাজে। বিমলবাবু পুরো বিহারি সেজে বসে। মোটা গোঁফ, ডান গালে একটা তিল। বাটি ছাঁট চুল।পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। ঠিক সেই সময়, এহেন এক মাতাল কাঁধে পুঁটলি নিয়ে টলতে টলতে বিপ্লবীর বাড়িতে হাজির। দরজায় কড়া নড়ে উঠল। বিমল দাসগুপ্ত যথেষ্ট সাবধানী এবং বুদ্ধিমান। প্রথমে বেরল না। কিছু পরে আবার কড়া নাড়ার শব্দ।
এবারে রিভলবারের ট্রিগারে হাত রেখে আগুন্তুকের সামনে দাঁড়াল।
রঘু জড়ানো গলায় বলল, ‘চলুন, আমি রেডি। বিমলবাবু চমকে উঠল। শেষে এই মাতাল বাপের সঙ্গে কলকাতা! ধমক লাগাল। ইসস! তুমি মদ খাও?
রঘু হেসে ফেলে। স্বাভাবিক গলার স্বরে বলল, ‘অ্যাকটিং তবে পাক্কা হয়েছে বলুন। তাড়াতাড়ি চলুন। রেলের সময় হয়ে এল।’
রাত অনেক। রাস্তায় লোকজন নেই বললে চলে। একটা আতঙ্ক ভয় ভয় ভাব। এই বোধ হয় কিছু ঘটে যাবে! মাঝে মাঝে পুলিসের টহল। সবার চোখ এড়িয়ে তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে  একটা নোংরা ডিব্বাতে এক বিহারি গোয়ালা তার ল্যাড়কাকে নিয়ে উঠে পড়ল। বাজ পাখির মতো তার চোখ চাদ্দিকে ঘুরছে। জানলার দিকে পিছন করে বসে পড়ে। বলে, আপনি চোখ বুজে ঘুমাবার ভান করুন। বাকি আমি সামলে নেব। ভালো করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল। শুধু মুখ বার করা।
ইতিমধ্যে, কয়েকজন সিপাহি এসে বিমলের দিকে কটমট করে দেখতে থাকে। কিন্তু গালে তিল, চুলছাঁটা, পোশাক পুরো বিহারিদের মতো। রঘুর কাঁধে মাথা রেখে কোঁকাতে থাকে সেদিনের বিপ্লবী বিমল দাসগুপ্ত!  আরও দু’জন সিপাহি হাজির। চাদরের মধ্যে রাখা হাত সোজা রিভলবারে। সেরকম হলে গুলি চালাতে   চালাতে পালাবে। সিপাহিদের সন্দেহ হয়। তড়বড়িয়ে গোয়ালা রঘু বলে উঠল, ‘মেরা লেড়কা, উসকো বহুত তেজ বুখার। ইসি লিয়ে কলকাত্তা।  উঁহাসে মুলুক!’
নিখুঁত অভিনয়। সিপাহিরা বুটের আওয়াজ তুলে নেমে গেল।
একসময় ট্রেন ছাড়ল। রঘুর চিন্তা। ‘আবার কেউ আসবে না তো!’ নাহ, সেরকম কিছু হল না।
দু’জনের চোখে তখন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বয়ে নিয়ে আসা কু ঝিক ঝিক করা ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছে গেল। অনেক ভিড়। দু’জনে ভিড়ে হারিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য বিপ্লবীদের ডেরা।
এই রকম অনেক রঘুনন্দন গোপ স্বাধীনতার যুদ্ধে এক বিশেষ সৈনিকের ভূমিকায় ছিল। কিন্তু আমরা ক’জন তাদের নাম জানি?
এসো আমরা তাদের একটু শ্রদ্ধা জানাই।

15th     August,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ