বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

অতীতের আয়না: বাঙালির সার্কাস
অমিতাভ পুরকায়স্থ

১৯২০ সালের ২০ মে। নিজের ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ নিয়ে সিঙ্গাপুরে ট্যুরে গিয়ে জন্ডিস হয়ে মারা গেলেন প্রিয়নাথ বসু। শুধু উপমহাদেশের সার্কাসের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও উৎকর্ষের নতুন মানদণ্ড ছাড়াও, বিনোদন শিল্প হিসেবে সার্কাসকে দৃঢ় ভিত দিয়ে গেলেন তিনি। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানের মতো শরীরচর্চাও জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।
উনিশ শতকের বাংলায় জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের অন্যতম কাণ্ডারী নবগোপাল মিত্রের হাতে গড়ে উঠেছিল প্রথম বাঙালির সার্কাস। যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল সার্কাস’। সেই নিরীক্ষাকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করে প্রিয়নাথ বসু উদ্বুদ্ধ করলেন কৃষ্ণলাল বসাকের মতো আরও বেশ কিছু বাঙালিকে এই পেশায় আসতে। পরবর্তী সময়ে বাঙালি পরিচালিত সার্কাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এস কে গুহ ওরফে বুঢঢা বাবুর ‘রিংলিং সার্কাস’ এবং বি এন বসুর ‘লায়ন সার্কাস’। সেই পরম্পরাতেই বাংলার মাটিতে গড়ে উঠল অজন্তা সার্কাস, পানামা সার্কাস আর এম্পায়ার সার্কাস। জিমন্যাস্ট ও ভারোত্তোলক সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পরিবারের হাতে তৈরি হল প্রথমে ইন্টারন্যাশনাল তারপর অলিম্পিক সার্কাস এবং ১৯৮৬ সালে ফেমাস সার্কাস। এছাড়াও গোপাল তরফদারের নটরাজ সার্কাস এবং তাঁর পুত্রের এভারেস্ট সার্কাসের কথা বলতেই হয়।রাজা রামমোহন রায়ের পৌত্র হরিমোহন বা মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মতো সমাজের নামী মানুষরাও সার্কাস নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন। তবে, সার্কাসের বেশির ভাগ কুশীলবরা আসতেন সমাজের পিছিয়ে পড়া স্তর থেকে। জীবিকার উৎস হওয়ার পাশাপাশি সার্কাস তাদের সামাজিক স্বীকৃতি এবং পেশাগত উন্নতির সুযোগ দিয়েছিল। প্রফেসর বোসের সার্কাসে বন্য পশুদের নিয়ে খেলা দেখানো সুশীলা সুন্দরী ও মৃন্ময়ী ছিলেন সমাজের প্রান্তিক পরিসর থেকে উঠে আসা সফল সার্কাস শিল্পী। অবশ্য খেলা দেখানোর সময় বাঘের আক্রমণে গুরুতর জখম হয়ে সুশীলা সুন্দরীর পেশাদার জীবন শেষ হয় অকালে। তুলনায় মৃন্ময়ীর কথা কম আলোচিত হয়েছে। সুশীলার সহশিল্পী ছিলেন এই মৃন্ময়ী। সুশীলার সুপারস্টার স্ট্যাটাসের পাশেই যাকে বলে সার্কাসের ‘পোস্টার গার্ল’ ছিলেন এই মৃন্ময়ী। মানে, সার্কাসের পোস্টারে ভারত মাতা রূপে দেখা যেত মৃন্ময়ীর ছবি। উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত, সিংহবাহিনী, হাতে বরাভয় মুদ্রা। লোক ভেঙে পড়ত সার্কাসের তাঁবুতে ভারতমাতাকে দেখতে। সেই ভূমিকায় সিংহ নিয়ে দুঃসাহসিক খেলা দেখাতেন মৃন্ময়ী।
তবে স্টেজের আড়ালে তাঁর জীবন বয়ে চলেছে সম্পূর্ণ বিপরীত খাতে। মৃন্ময়ীর স্বামী বিয়োগ হল। শুরু হল বৈধব্য পালন ও কৃচ্ছ্রসাধন। সার্কাসের সব থেকে খারাপ খুপরি বরাদ্দ হল তাঁর। আলোচাল আর কাঁচকলার খাদ্য হল দৈনন্দিন বরাদ্দ। শুধু সার্কাসের প্রয়োজনেই কদম ছাঁট চুলটা বোধহয় বাদ থেকেছিল। দিনের শেষে যে তাঁকে সিংহ নিয়ে ভারতমাতার ভূমিকায় অভিনয় করতে হতো!
তবে সার্কাস দল গড়ে তোলা এবং দীর্ঘদিন তা সফল ভাবে চালানো অত্যন্ত কঠিন। সার্কাসের ইতিহাসে তাই দল ভেঙে যাওয়া বা বিক্রি হওয়ার তথ্যে ভরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলি বাদ দিয়ে গত শতকের প্রায় পুরোটা জুড়েই পারিবারিক বিনোদন হিসেবে সার্কাসের একচেটিয়া কদর ছিল। সেই বাজারের টানে বাংলার ঘরের সার্কাসগুলি ছাড়াও কলকাতায় আসত দেশি-বিদেশি নামী সার্কাস কোম্পানিগুলি। তাই শুধু পার্ক সার্কাসের মতো বড় ময়দান নয়, অন্যান্য মাঠেও সার্কাসের তাঁবু পড়ত। আজকের হিন্দুস্থান বিল্ডিং ও ইমলের জায়গায় যে ফাঁকা মাঠ ছিল, সেখানেও বসত সার্কাসের আসর। কিংবা ওয়াচেল মোল্লার দোকানবাড়ির জায়গায় তাঁবু ফেলত মোল্লা সাহেবের নিজের মিনার্ভা সার্কাস।
সার্কাসের তাঁবু ফেলার আগে শুধু জমির মালিক নয়, পাড়ার লোকেরও অনুমতি নিতে হতো। তাঁরাও নানা আপত্তি তুলতেন। কেউ যদি বলতেন সার্কাসের জন্য বাড়ির ছেলেপুলেদের লেখাপড়া হবে না, তো কেউ বলতেন নানা জায়গার লোক সার্কাস দেখতে এসে পাড়া নোংরা করবে। আবার অন্য একদল আশঙ্কা করতেন যে, বাঘ সিংহের ডাকে বাড়ির গোরুগুলো ঘাবড়ে গিয়ে দুধ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেবে। সার্কাস কোম্পানিকে এমন মুশকিলে ফেলার পর শুরু হতো উল্টো খেলা। হ্যাঁ, আপত্তি তুলে নিতে পারি, কিন্তু ফ্রি পাশ দিতে হবে। একটা ফ্যামিলি পাশ দেবেন, তো বলুন!     কিন্তু গত শতকের শেষ থেকেই বিনোদনের চরিত্র বদলাতে শুরু করায় সার্কাসগুলির কঠিন সময় শুরু হয়। একসময় মনোহর আইচ বা রেবা রক্ষিতের মতো বিখ্যাত ব্যায়ামবিদদের পাশাপাশি ভিড় টানত নানা রকম জন্তু জানোয়ারের খেলা। কিন্তু সার্কাসের সেই অংশটাই বাদ দিতে হয় ১৯৯৮ সালে বন্য প্রাণীর খেলা দেখানো নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় পর। অনেকের মতে, সার্কাস তার মূল আকর্ষণটাই যেন এর ফলে হারিয়ে ফেলে। বিদেশি খেলোয়াড় ও তাদের চমকদারি খেলা দিয়ে সেই অভাব ঢেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই ২০১১ সালে শিশুদের খেলা দেখানোর উপরেও বসে নিষেধাজ্ঞা। অথচ, এদের শারীরিক নমনীয়তায় চলত জিমন্যাস্টিকের খেলাগুলি। এরপর এল নোট বন্দি আর ২০২০ সালে করোনা মহামারী। পরপর ধাক্কায় সারা দেশের সঙ্গে বাংলার সার্কাসের একে একে নিভিছে দেউটি।
এটাই হয়তো সার্কাসের নিয়তি। যে আঠারো-উনিশ শতকের যুগসন্ধির সন্তান সার্কাস, সেই সময়টা আজ বদলে গিয়েছে। তাই সার্কাসের সঙ্কট হয়তো এই দিন বদলের সমার্থক। তবু এখনও শীত এলে সার্কাসের তাঁবু পড়ে কলকাতার কয়েকটি মাঠে। সীমিত সামর্থ্য নিয়েই শো চলতে থাকে। তবে তার মধ্যেই  কান পাতলে শোনা যায় কয়েক প্রজন্মের বাঙালির মনে ছোটবেলার স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকা সার্কাসের কথা। 

10th     March,   2024
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ