বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

কালের যাত্রার ধ্বনি
সন্দীপন বিশ্বাস

 

দক্ষিণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। উত্তরে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি। সংলগ্ন দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির। পশ্চিম দিকে গঙ্গার অনন্তধারা। এই অঞ্চলটুকুই হল চিৎপুর। কেউ বলেন, দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির থেকেই এই স্থানের নাম চিৎপুর। আবার কারও মতে, চিতু ডাকাতের নামানুসারেই এই নামকরণ। এরই একটা অংশকে লোকে এক সময় বলত বটতলা— বাঙালির সংস্কৃতির অন্যতম আঁতুড়ঘর। এখান থেকেই যেন বাঙালি পেল তার নতুন যুগের ভোরবেলা। বটতলার বই, বটতলার গান, বটতলার ছাপাখানা, বটতলার বাইজি, বটতলার নাটক, বটতলার স্কুল, নিধুবাবু আর পক্ষীর দলের গান— এমন আরও কত কিছুই দিয়েছে বটতলা। তারপর একদিন সে সব হারিয়ে গিয়েছে নিঃশব্দে। বেঁচে আছে চিৎপুর। এখান থেকেই একদিন কলকাতা ধীরে ধীরে কল্লোলিনী তিলোত্তমা হয়ে উঠেছিল।
চিৎপুরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয়। এই চিৎপুরেই মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে অভিনীত হয়েছিল ‘নীলদর্পণ’। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। এই অভিনয় ছিল বাঙালির ‘জাতীয় নাট্যশালা’ গড়ে তোলার আবেগ। আবার এই চিৎপুরকে ঘিরেই আধুনিক ও পেশাদারী যাত্রার বেড়ে ওঠা। আমাদের নিজস্ব পাঁচশো বছরের সংস্কৃতি যাত্রা নতুন রূপ পেল চিৎপুরের মাটিতে এসে। এক সময় ছিল গোবিন্দ অধিকারী, দাশরথী রায় কিংবা গোপাল উড়ের যাত্রা। কলকাতা সে যাত্রা চেটেপুটে আস্বাদন করেছিল। তখন চাহিদা ছিল অন্যরকম। সেই চাহিদা কেমন, সেটা গোপাল উড়ে ভালো করেই জানতেন। তাই তিনি তাঁর সবথেকে জনপ্রিয় পালা ‘বিদ্যাসুন্দর’কে নিয়ে গেলেন অন্যমাত্রায়। কিছুটা স্থূল হলেও নাচে, গানে তা ছিল আরও বিনোদনমুখী। সেই যাত্রার জনপ্রিয়তা শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, মজিয়ে দিয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকেও। গোপাল উড়ের পালা দেখে ঠাকুরবাড়ি একদিন নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিল। ১৮৬৭ সালে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাতে তিনি লেখেন, ‘গোপাল উড়ের যাত্রা থেকেই আমরা থিয়েটার করার প্রেরণা পেয়েছি।’
চিৎপুরে এসে যাত্রা পেল নবজন্ম। নতুন উত্তরাধিকার। জন-মনোরঞ্জনের নতুন বার্তা নিয়ে এল চিৎপুরের যাত্রা। বলা হয়, পুরনো ধারার যাত্রার শেষ নক্ষত্র ছিলেন মতিলাল রায়। তাঁর মৃত্যুর পর যাত্রার ধারা নিয়ে তাঁর এক পুত্র ভূপেন্দ্রনারায়ণ রায় লিখেছিলেন, ‘মতি যখন ছিল, তখনই প্রকৃত যাত্রা ছিল। এখন আর সে যাত্রা নাই। তার কঙ্কাল মাত্র অবশিষ্ট। তাও শীঘ্র জগৎ হতে লুপ্ত হবে।’ আধুনিক যাত্রার পর্যালোচনা করলে বলতেই হয় যে, যাত্রায় অপেরাধর্মিতা এসেছে তাঁরই হাত ধরে। নতুন যাত্রার দিশা তিনিই দিয়ে গিয়েছিলেন। চিৎপুর একদিন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ‘অপেরা’ যাত্রার ধারক ও বাহক। 

‘ভয় কী মরণে রাখিতে সন্তানে মাতঙ্গি মেতেছে আজ সমর রঙ্গে...’ মঞ্চে গান চলছে। মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রার গান শুনে জনতার মনে বাঁধনছাড়া আবেগ। দেশমাতৃকার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য তাঁদের মনে ঢেউ উঠেছে। কিন্তু বিধি বাম। সেই যাত্রা গান আর শেষ হল না। ব্রিটিশ পুলিস এসে মুকুন্দদাসকে বন্দি করে নিয়ে গেল। তবুও তাঁকে দমাতে পারেনি ইংরেজ বাহাদুর। মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রা সেই সময় বাংলার মানুষের মনে এক ভিন্নতর আবেগ তৈরি করেছিল। বঙ্গভঙ্গ কালে সেই স্বদেশি যাত্রা এবং তাকে কেন্দ্র করে মানুষের আবেগ দেখে ভয় পেয়েছিল ইংরেজ শাসকরা। 
নজরুল তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘চারণকবি’। মুকুন্দদাসের প্রকৃত নাম যজ্ঞেশ্বর দে। স্বাধীনতা সংগ্রামী অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁকে দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের গান শুরু কর।’ তাই শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পালাগান লিখতে শুরু করেন মুকুন্দদাস। তাঁর ‘মাতৃপূজা’ পালাখানি রাজরোষে পড়েছিল। ইংরেজ বাহাদুর সেই পালা বাজেয়াপ্ত করেছিল। 
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান চলেছে। কিন্তু কেউ কোথাও এই স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্মৃতিচারণায় যাত্রাশিল্পের অবদান নিয়ে একটি কথাও বলেননি। অথচ স্বাধীনতার কালে যাত্রাশিল্প এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, তারপর আলিপুর বোমা মামলা, ক্ষুদিরামের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে বাংলায় জ্বলে উঠেছিল বিপ্লবের আগুন। সেই আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে গ্রামে গ্রামে পরিবেশিত হতো নানা ধরনের পালা। 
মুকুন্দদাসের অনুপ্রেরণায় তখন গ্রাম বাংলায় বহু স্বদেশি যাত্রার সূচনা হয়েছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই মৃত্যু ঘটে মুকুন্দদাসের। কিন্তু তাঁর প্রেরণায় তখন উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন বাংলার তৎকালীন পালাকাররা। তাঁদের কলমে এসেছিল স্বদেশি ভাবনার জোয়ার। তখন বহু নাট্যকার ‘মাতৃপূজা’ নামে পালা লিখেছিলেন। সেই সময় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার মতো পালা যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁরা হলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়, কুঞ্জবিহারী মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনারায়ণ রায়, পার্বতীচরণ কাব্যতীর্থ, কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ (বড় ফণী), বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ভোলানাথ রায় নস্কর কাব্যশাস্ত্রী, অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থ, নন্দগোপাল রায়চৌধুরী, শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। 
পুলিস বহুবার চেষ্টা করেও তৎকালীন পালাকার ও অভিনেতাদের কণ্ঠরুদ্ধ করতে পারেনি। নন্দগোপাল রায়চৌধুরী তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, ‘পুলিস বাধা দিলেন, নাটকের কপি কেড়ে নিয়ে অত্যাচারের দৃশ্য এবং অগ্নিক্ষরা বাণীগুলি বাদ দিতে নির্দেশ দিলেন। নাটকের কপিতে বাদ হল বটে, কিন্তু অভিনেতাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলেন না।’ অভিনেতারা কিন্তু বাদ দেওয়া সংলাপ ও দৃশ্যগুলি মঞ্চে অভিনয় করতেন। 
বহু নাট্যকারের পালা থানায় নিয়ে গিয়ে কেটেকুটে সেন্সর করা হতো। কিন্তু পালা অভিনয়ের সময়ে অনেকেই সেইসব সংলাপ বলতেন। তখন যেসব পালা গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে জোয়ার এনেছিল বা যেসব পালা ইংরেজ শাসকদের সিংহাসন কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেগুলি হল— ‘দাদা’, ‘সোনার বাংলা’, ‘সমাজ’, ‘দেশের ডাক’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘যুগের দাবি’, ‘বিপ্লবী বাংলা’, ‘ধর্ষিতা’, ‘মায়ের দেশ’ ‘পলাশীর পরে’, ‘প্রবীরার্জুন’, ‘লীলাবসান’, ‘চাষার ছেলে’, ‘মায়ের ডাক’ ইত্যাদি। এই সব পালায় গান ও সংলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলা হতো। 
পালাকারদের মধ্যে বিনয় মুখোপাধ্যায় তাঁর অসংখ্য পালার মধ্যে দিয়ে বিপ্লব চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর লেখা পালাগুলি ছিল ‘যুগের দাবি’, ‘পুষ্পাঞ্জলি’, ‘সংগ্রাম’, ‘জয়যাত্রা’ প্রভৃতি। সেসব পালা পুলিস এসে মাঝেমাঝেই বন্ধ করে দিত। নাট্যকারের উপরও চলত লাঞ্ছনা। আর একজন পালাকার ছিলেন কুঞ্জবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘মাতৃপূজা’ পালায় একটি গান সেই সময় দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ‘আর আমরা পরের মাকে মা বলিয়া ডাকব না।/ জয় জননী জন্মভূমি তোমার চরণ ছাড়ব না।’ এছাড়াও কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রানা প্রতাপ’, অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থের ‘শান্তি’, হারাধন রায়ের ‘মীরা উদ্ধার’, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গাসুর গীতাভিনয়’, ‘রণজিতের জীবনযজ্ঞ’ পালাগুলির মধ্যে মানুষের ঘুম ভাঙানোর গান গাওয়া হয়েছিল। ভোলানাথ রায় নস্কর কাব্যশাস্ত্রীর ‘জরাসন্ধ’ পালাটি ইংরেজরা নিষিদ্ধ করেছিল। পালাকাররা বিভিন্ন পৌরাণিক, ঐতিহাসিক বা সামাজিক পালার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বা দেশমাতৃকার বন্দনাকে প্রকাশ করতেন। কখনও সংলাপের মধ্যে দিয়ে, কখনও আবার গানের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ পেত। ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র ‘ধরার দেবতা’ পালার একটি গান ছিল, ‘তোরা দেশের কুকুর মাথায় নে ভাই / বিদেশের ওই ঠাকুর ফেলে।’ ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদের ‘বাসুদেব’ পালার একটি গান হল, ‘যদি নিতে চাও তার প্রতিশোধ, করিতে চাও তার প্রতিকার / তবে মন্ত্রে জাগাও অস্ত্র তোমার অলসতা কর পরিহার।’   
ব্রজেন্দ্রকুমার দে ছিলেন একজন ধ্রুপদী পালাকার। তিনি সেই সময় সমাজটাকে এবং সময়টাকে ভালো করে চিনেছিলেন। তাই একেবারে যুগোপযোগী পালা লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ভাসিত তাঁর পালাগুলি হল ‘লীলাবসান’ ও ‘প্রবীরার্জুন’। নাট্যকারের পুত্র তথা যাত্রা বিশেষজ্ঞ তরুণকুমার দে বলেন, ‘তিনি শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্যই ডাক দেননি। বরং ইংরেজরা আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ঘটিয়ে যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। এছাড়া অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের দ্বন্দ্ব এসবের বিরুদ্ধেও তিনি গর্জে উঠেছিলেন। বারবার তিনি বলেছেন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি, সম্প্রীতির কথা।’   
পালাকারদের পাশাপাশি বহু অভিনেতা ও অভিনেত্রী সেই সময় এই সব পালার মধ্য দিয়ে বিপ্লব চেতনাকে পুষ্ট করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বড় ফণী, নন্দগোপাল রায়চৌধুরী, শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিত বিশ্বাস, জনার্দন রানি, রাখাল রানি প্রমুখ। 
স্বাধীনতার পরেও চিৎপুরের যাত্রাপালায় এই ধরনের দেশাত্মবোধক পালার বহু অভিনয় হয়েছে। বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবেন নাথ, অমর ঘোষ, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কানাই নাথ, উৎপল দত্ত, মধু গোস্বামী সহ আরও বহু পালাকার দেশাত্মবোধক পালা লিখেছিলেন।  
আর এই সময় এবং প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই সূচিত হয়েছিল বাংলা যাত্রার স্বর্ণযুগ।

সে ছিল এক সুখের দিন। স্বাধীনতার আগে-পরে বাংলার গ্রামে গ্রামে যাত্রা মানে কয়েক রাতের রঙিন উৎসব। ‘ঢং’ করে একটা ঘণ্টা বাজলেই শুরু হতো কনসার্টের সুরলহরী। সেই কনসার্ট শেষ হলে শুরু হতো নাচ। সখীদের জুড়ি নাচ। তারপর শুরু হতো আসল পালা। সেখানে রাজা, রানির ঝলমলে পোশাক, তরবারির ঝনঝনি, মন্ত্রী বা নায়েব মশায়ের চোখের কুটিল বিভঙ্গ, বিবেকের গান ইত্যাদি। একদিন ঐতিহাসিক পালা, তো পরদিন সামাজিক পালা, তারপর দিন পৌরাণিক পালা। তখন এত আলোর রোশনাই ছিল না, ছিল না রঙিন আলোর মায়া, ছিল না মাইক্রোফোন। হ্যাজাক বা পেট্রোম্যাক্সের আলোয় বসত আসর। শুধু পালা আর অভিনয় দিয়েই গ্রাম-বাংলার মানুষের মন জয় করত প্রত্যেকটি অপেরা। এক-একটি দলের থাকত আট থেকে দশটি পালা। সেই সব পালা দেখতে দেখতে মানুষ চোখের জলে ভাসতেন। তখন যাত্রা মানে ছিল দুর্গাপুজোর ‘ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি।’ অনেক আগে দল আসরে যেত গোরুর গাড়িতে, নৌকায়, লরিতে। ১৯৬৩-’৬৪ সাল থেকে যাত্রায় নিজস্ব বাসের প্রচলন করেছিল নট্ট কোম্পানি। আগে ছিল খোরাকি বায়না। অর্থাৎ কোনও জমিদার বাড়িতে কয়েক রাত পালা হলে তার জন্য দল পেত পালা প্রতি একশো থেকে দুশো টাকা। আর দলের শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মীরা পেতেন খাওয়া দাওয়া, হাতখরচা। নতুন যুগের হাওয়া এল। ছ’য়ের দশকের গোড়ায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে বসল যাত্রা উৎসবের আসর। এই পর্ব থেকেই শুরু যাত্রার বাণিজ্যিকীকরণ। স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল আগেই। এই সময় থেকে তা এক ভিন্নতর পথে বাঁক নিল। সেই সঙ্গে একটু একটু করে লাগল আধুনিকতার ছোঁয়া। আলো এল, মাইক্রোফোন এল, ডায়াস, রস্ট্রাম এল। সব থেকে বড় কথা পুরনো ‘রানি’ প্রথা বিদায় নিতে শুরু করল। ‘রানি’ মানে নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয়। এক সময় যাত্রা দলে বহু পুরুষ মঞ্চে তাঁদের মোহিনী রূপে এবং অভিনয়ে দর্শকদের মাথা ঘুরিয়ে দিতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জনার্দন রানি, রাখাল রানি, শতদল রানি, রেবতী রানি, বাবলি রানি, চপল রানি প্রমুখ। একবার এক যাত্রার আসর থেকে রাখাল রানিকে প্রকৃত নারী ভ্রম করে এক জমিদার তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ভুল ভাঙায় তিনি ওই শিল্পীকে নানা উপঢৌকন সহকারে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দেন। পাঁচের দশক থেকে যাত্রায় নারী চরিত্রে নারীরাই অভিনয় শুরু করেন। একে একে এলেন জ্যোৎস্না দত্ত, বীণা ঘোষ, বীণা দাশগুপ্ত, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়, মিতা চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা মল্লিকরা।    
সেই সময় থেকে পালার আঙ্গিক এবং অভিনয়েও বদল ঘটল। থিয়েট্রিক্যাল যাত্রার ঝোড়ো হাওয়ায় সূচিত হল নব্য আধুনিকতার ছোঁয়া। এল নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। আমরা পেলাম অনেক সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে। ‘সোনাই দিঘি’, ‘মসনদ’, ‘একটি পয়সা’, ‘বাঁশের কেল্লা’, ‘হিটলার’, ‘লেনিন’, ‘মাইকেল মধুসূদন’, ‘বাঙালি’, ‘রাইফেল’, ‘জালিয়ানওয়ালা’, ‘বাঘিনী’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘মা মাটি মানুষ’, ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’— এরকম শত শত পালা তখন জয় করে নিচ্ছে মঞ্চের পর মঞ্চ। শুধু বিনোদন নয়, বিভিন্ন পালার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চিৎপুরের দায়বদ্ধতা। 
মঞ্চের আলোকবৃত্তে তখন অসংখ্য সুপারস্টার। প্রত্যেকের অভিনয়েরই একটা  নিজস্বতা ছিল। একটা আসর ঘিরে দশ-বারো হাজার দর্শকের জমায়েত হতো। তার মধ্যে মাইক ছাড়া অভিনয় করতেন অভিনেতারা। পরে মাইক এল। এভাবেই স্বর্ণযুগের যাত্রা নানা বিবর্তন আর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। এই সময় অভিনেতা হিসাবে আমরা যাঁদের পেয়েছিলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই আপন প্রতিভায় ভাস্বর। সূর্য দত্ত, ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ (বড় ফণী), ফণিভূষণ মতিলাল (ছোট ফণী), পঞ্চু সেন, শান্তিগোপাল, মোহিত বিশ্বাস, সুজিত পাঠক, বিজন মুখোপাধ্যায়, সুজিত পাঠক, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, পান্না চক্রবর্তী, ভোলা পাল (বড়), অরুণ দাশগুপ্ত, রাখাল সিংহ, স্বপনকুমার, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, তপনকুমার, অসীমকুমার সহ আরও অনেকেই তখন তাঁদের পালা আর অভিনয় দিয়ে মন জয় করে নিচ্ছিলেন। 
কোনও স্বর্ণযুগই স্থায়ী হয় না। যাত্রারও হয়নি। আশার কথা, গত দশ বছরে যাত্রাশিল্প তার ভুলত্রুটিগুলি মুছে ফেলে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই কাজে চিৎপুর পাশে পেয়েছে রাজ্য সরকারকে। শেষ করি শিশিরকুমার ভাদুড়ির একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের জাতীয় নাট্যশালা কখনওই ইংরেজি নাট্যমঞ্চ বা অভিনয় ধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে না। জাতীয় নাট্যশালার জন্য আমাদের যাত্রার দিকে নজর ঘোরাতেই হবে। আজ যখন পশ্চিমে চেষ্টা হচ্ছে পিকচার ফ্রেম স্টেজ তুলে দেবার, তখন আমরাই বা আমাদের যাত্রার আসরে নাট্যকে স্থান দেব না কেন? যাত্রাকে নতুন করে কালোপযোগী করে গড়ে তুলব না কেন?’
‘বাঁশের কেল্লা’ (১৯৬৮) পালার একটি দৃশ্য

4th     June,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ