বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

স্মৃতি-বিস্মৃতি
আড্ডার ঠিকানা কফি হাউস
সুদীপ্ত রায়চৌধুরী

সালটা ১৯৫১। এই সাতাশি বছরেও স্পষ্ট মনে আছে বুঝলে... তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে আমার ফার্স্ট ইয়ার। প্রথমবার পা রাখলাম কফি হাউসে। এক বন্ধু নিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে দোতলা। দুই বন্ধু মিলে বসা হল একটি টেবিলে। অর্ডার দেওয়া হল—কোল্ড কফি উইথ ক্রিম। এর আগে কখনও অমন কিছু চোখে বা চেখে দেখিনি। আহা, অপূর্ব সে স্বাদ। সেই শুরু। এরপর মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে ঢুঁ মারতাম আলোচনার মক্কায়—ব্যারিটোন ভয়েজ, কাটা কাটা বাক্য থেকে প্রতিটা অক্ষর যেন মুক্তোর মতো আলাদা করে বেরিয়ে আসছে। বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। নাটকের রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। ব্যারিটোনের ম্যাজিকে প্রায় ডুবে যাচ্ছি তখন। ‘আড্ডা জমত। ধীরে ধীরে অনেকের সঙ্গে আলাপও হল। চেয়ারের সংখ্যা বাড়ল। নিত্যনৈমিত্তিক গল্প, আড্ডা হয়। এর মধ্যেই ঘটল এক মজার কাণ্ড। যেকোনও সময়ে কফি হাউসে ঢুকলেই আড্ডাধারীদের সমুদ্র গর্জন মার্কা কলরোল কানে বাজে। সেদিনও তেমনটি ছিল। হঠাৎই সব চুপচাপ। সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে। হতবাক। মিনিট তিনেক পর ধীরে ধীরে কফি হাউস ফিরল তার চেনা চরিত্রে। কিন্তু এই তিন মিনিটের নীরবতা কী কারণে, সেই রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করে উঠতে পারিনি। এখনও কি সময়ের ভগ্নাংশ ধরে নীরব হয় কফি হাউস? পারলে জানিও তো আমাকে।
শুধু সিগারেট ফুঁকে আড্ডাবাজি নয় কিন্তু। মুখে প্রচুর হাতিঘোড়া মেরেছি আমরা। তবে এটাও ঠিক, সেই সময়ে আড্ডার মানুষদের মধ্যে যেমন রুচির সাযুজ্য ছিল, তেমনই আলোচনার সারবত্তাও থাকত। পরে অবশ্য ছবিটা বদলায়। রাজনীতির মানুষদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। আমারও তখন থিয়েটারের খিদে বাড়ছে। অল্প অল্প করে কাজের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। ফলে কফি হাউসে যাওয়াটা কমে যায়। তার পরেও অনেক বেদনার মুহূর্তে, শূন্যতার সময়ে কফি হাউস ছিল আমার মতো অনেকের আশ্রয়।  দিনকয়েক আগে একবার গিয়েছিলাম কফি হাউসে। বহুদিন পর চেনা চেয়ার, চেনা টেবিলে বসা যেন অতীত ছুঁয়ে থাকা। পুরনো কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হল। কথা হল। আনমনে বসে ভাবছিলাম, কতশত সম্পর্ক শুরু হয়েছে এখানে। শেষও। না জানি কত সম্পর্কের জোড়-বিজোড় হয়ে রয়েছে এই কফি হাউস।’ কথা শেষ করলেন রুদ্রপ্রসাদ। তাঁর দু’চোখজুড়ে কি সিপিয়া রঙা অতীত খেলা করে বেরাচ্ছে! ফোনের এপার থেকে দেখা হল না। শুধু সেই ভরাট ব্যারিটোন গলা আর ভারী হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে আসা স্মৃতিগুলিকে নাটকের মতো দৃশ্যকল্প তৈরি করে দিল।
স্মৃতিকাতর বাঙালিও। বইপাড়ার এক ও অদ্বিতীয় কফি হাউস নিয়ে। ক্যাসেট-সিডি-আইপডে ‘সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ শুনেও রংচটা চেয়ার-টেবিলে এসে ভিড় জমায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। জমে ওঠে আড্ডা—প্রতিদিন। যে আড্ডার সূত্রপাত ‘অ্যালবার্ট হল’-এর আমল থেকেই। নামে সাহেবিয়ানা থাকলেও কাজে অবশ্য ছিল উল্টো। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায় ‘অ্যালবার্ট হল’। বুদ্ধিজীবীদের আখড়া। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতসভা’। ক্যাফিনের সুবাস তখনও এখানে এসে পৌঁছয়নি। কলেজ স্ট্রিটের আগে, ১৯৪১ সালে মধ্য কলকাতায় ‘কফি হাউস’ খোলে ভারতীয় কফি বোর্ড। দু’ভাগে বিভক্ত এই কফি হাউসের একাংশ ছিল জনসাধারণের জন্য। রাস্তার ধারে ঘর, নাম ‘হাউস অব কমনস্‌’। অপরটি ভিতরে—‘হাউস অব লর্ডস’। সেখানে কফি হোক বা খাবার, ‘হাউস অব কমনস্‌’-এর তুলনায় দাম ছিল কিছুটা বেশি। এই অংশটি ছিল মূলত বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের আড্ডাস্থল। সেখানে নিয়ম করে আড্ডা দিতে আসতেন হরিসাধন দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, রাধাপ্রসাদ গুপ্তরা। ইউরোপের সিনেমা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলত সত্যজিৎ, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্তদের। শোনা যায়, সেই আড্ডা থেকেই পথের পাঁচালির ভাবনার জন্ম। সত্যজিতের সুবাদে ‘দ্য রিভার’ সিনেমার শ্যুটিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যেও দু’একবার এই কফি হাউসের আড্ডায় এসেছিলেন প্রখ্যাত ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়াও। চৌরঙ্গির এই কফি হাউস অবশ্য কখনওই ‘সবার’ হয়ে উঠতে পারেনি। আড্ডার জন্য আমজনতার পছন্দ ছিল কলেজ পাড়ার অ্যালবার্ট হলই। এমনকী, একটা সময়ের পরে চৌরঙ্গির কফি হাউসের আড্ডার অনেক নিয়মিত মুখকেই দেখা যেত কলেজ স্ট্রিটে। ১৯৪২ সালে সেখানে ‘কফি হাউস’ শুরু করল ভারতীয় কফি বোর্ড। স্বাধীনতার পর ‘অ্যালবার্ট হল’-এর পরিচয় ঢেকে গেল কফির ধোঁয়ায়। ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট হয়ে উঠল বাঙালির আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। এর মধ্যেও ঝড়-ঝাপ্টা যে একেবারে আসেনি, তেমনটা নয়। ১৯৫৮ সালে ‘অলাভজনক’ এই ব্যবসা বন্ধের কথা ভেবেছিল ভারতীয় কফি বোর্ড। সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হন বহু শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক। পাশে দাঁড়ান তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-পড়ুয়ারাও। টানাপোড়েন শেষে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে হাসি ফোটে প্রতিবাদীদের মুখে। তৈরি হয় সমবায় গোষ্ঠী। সাময়িক বিরতির পর ফের পথ চলা শুরু হয় কফি হাউসের।
শুধু আড্ডা নয়, কফি হাউসকে বাঙালির মননের চারণভূমি বলেই মনে করেন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। যদিও সেই চারণক্ষেত্রের রাখাল বালকগুলি বাস্তবিকই আজ আর নেই। স্বপ্নময় আক্ষেপ করেন। বলেই ফেলেন শেষপর্যন্ত, ভাবি, যদি এখনকার তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে বসে গল্প করা যেত... কিন্তু তাঁদের কেউই তো কথা বলতে আসে না... এড়িয়েই যায় কিছুটা। বাগবাজারের স্বপ্নময় ছিলেন হেয়ার স্কুলের ছাত্র। সেই স্কুল জীবনেই প্রথম পা কফি হাউসে। নেপথ্যে—এক সহপাঠী। তাঁর কথায়, আমাদের স্কুলের পাশেই প্রেসিডেন্সি কলেজ। আমি যখন ক্লাস নাইন, অপর্ণা সেন তখন প্রেসিডেন্সিতে সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ার। পড়ার পাশাপাশি অভিনয় জগতে পা রেখেছেন। নাম শুনেছি, কিন্তু তাঁকে দেখিনি কখনও। আচমকা একদিন সহপাঠী কমল এসে বলল, অপর্ণা সেনরা সবাই কফি হাউসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখতে যাবি? ব্যস, দল বেঁধে ছুটলাম। সেই প্রথম কফি হাউসে যাওয়া। অভিনেত্রীকে দেখতে। এরপর কলেজ। তখন অল্প বিস্তর লেখালেখি শুরু করেছি। লিটল ম্যাগাজিনে মশগুল। লেখার সুবাদে আগেই আলাপ হয়েছিল বাংলার শিক্ষক সুখেন্দু ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে। তাঁদের ডাকে একদিন হাজির হলাম কফি হাউসে। মাঝে বেশ কয়েক বছর পেরিয়েছে। কিন্তু ঢুকে মনে হল, জায়গাটা বদলায়নি। একই রকম রয়েছে। ফের আড্ডায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। কত মানুষ আসতেন। দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অমল রায়, দেবকুমার বসুদের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসতাম। পরে টেবিল বদলাল। আড্ডা জমল নবারুণ ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, সুরজিৎ ঘোষদের সঙ্গে। সেই সময় টেবিলগুলিতে হাজির মানুষরা এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন রায়চৌধুরী, শেখর বসু, রমানাথ রায়, শৈবাল মিত্রদের কথায় সমৃদ্ধ হতো আড্ডা। পরের দিকে মূলত বয়সজনিত কারণেই যাওয়া কমে। আড্ডা আজও টানে, কিন্তু কফি হাউসের সেই গমগমে আওয়াজে এখন একটু কষ্ট হয়। তাই গেলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। 
কলেজ স্ট্রিটে নিয়মিত আড্ডার মাঝেই একবার গিয়েছিলাম চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসে। গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন ছিলেন কলকাতায়। লেখালেখির ফাঁকেই তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমন্ত্রণ জানান শংকরলাল। আর একবার গিয়েছিলাম মৃণাল সেনের সঙ্গে দেখা করতে। একটা সিনেমার বিষয়ে নেহাতই কেজো কথা। কিন্তু আমাদের কাছে আড্ডার সমার্থক ছিল বই পাড়ার কফি হাউস।
লিটল ম্যাগাজিনের টানে ছাত্রজীবনে মফস্‌সল থেকে কলকাতায় আসতেন কবি সুবোধ সরকার। পাতিরামের স্টল থেকে লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করেই পা বাড়াতেন কফি হাউসের উদ্দেশে। স্মৃতিমেদুর কবি বলছিলেন, ‘সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি—এই সময়ে কফি হাউসে নিয়মিত যেতাম। ঢুকলেই মনে হতো, পুরনো সময় যেন থমকে গিয়েছে। এখনকার মতো ঝাঁ চকচকে না হলেও একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতাম। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, আড্ডার সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ ছিল বহু মানুষের কণ্ঠস্বরের সম্মিলিত গুঞ্জন। কোনও কথা আলাদা করে বোঝা যেত না। শুধু ওই শব্দ ঘুরপাক খেত দু’কানজুড়ে। কফি হাউসের শব্দ। একটা সময়ে কফি হাউস ছিল আমাদের সবার মিলনস্থল। কেউ কল্যাণী, রানাঘাট, কেউ আবার সুন্দরবন, হাড়াল থেকে এসে জুটতাম সেখানে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা বন্ধুরা তো ছিলই। এখন তো পাড়ায় পাড়ায় কফি শপ। ছেলেমেয়েরা এখন সেখানেই আড্ডা মারে, কফি খায়। খরচ কিছুটা বেশি, কিন্তু আরামদায়ক। তবে কফি হাউসের সেই মেজাজ এই সমস্ত কফি শপে মেলা ভার।’
কলেজ স্ট্রিটের কৌলিন্য বা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের আভিজাত্য না থাকলেও আড্ডার জনপ্রিয়তায় কম যেত না হাজরার বসুশ্রী কফি হাউসও। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস ছিল সাহিত্যিক, শিল্পীদের মিলনমেলা। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসে আড্ডা জমাতেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাংবাদিকরা। আর বসুশ্রী কফি হাউসে দেখা মিলত টলিপাড়ার নামজাদা অভিনেতা ও ময়দান কাঁপানো ফুটবলারদের। সিনেমার শ্যুটিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে নিয়মিত আড্ডায় আসতেন বিখ্যাত অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। নায়কের পাশাপাশি নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন পার্শ্বচরিত্রেও। অথচ তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বে কখনও বিচ্ছেদ হয়নি উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবীদের। কখনও স্টারডম তাঁর পিছু ছাড়েনি। অথচ সেই জনপ্রিয়তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে বসুশ্রী কফি হাউসে নিয়মিত আড্ডায় মেতে উঠতেন তিনি। ফি রবিবার দুপুর পর্যন্ত কফি হাউসের একটি টেবিল থাকত অনিল চট্টোপাধ্যায়ের জিম্মায়। এমনকী অন্যান্য দিন সকালবেলায় সেখানে হাজির হতেন তিনি। আড্ডার টানে নিয়মিত আসতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জরা। দেখা মিলত ময়দানজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো বহু ফুটবলারের। চুনী গোস্বামী, চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুভাশিস গুহ, থঙ্গরাজ, বলরাম, অসীম মৌলিক—কে নেই সেই তালিকায়। বসুশ্রী সিনেমার মালিক মন্টু বসুদের গেস্ট হাউসে থাকতেন আমেদ খান। নীচের কফি হাউসে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলত তাঁর। সুদিনের সেই দিনলিপিতে যতিচিহ্ন পড়েছে বহুদিন।
সোনালি দিন উধাও যাদবপুর কফি হাউসেরও। জলের দাগের মতো পড়ে রয়েছে স্মৃতি। বইপাড়ায় কফি হাউসের জনপ্রিয়তা দেখে উৎসাহী কর্তৃপক্ষ ১৯৬৪ সালে ৮বি মোড়ে চালু করেন কফি হাউসের এই শাখাটি। ধারে বা ভারে কলেজ স্ট্রিটের মতো নয়। তবে এককালে এই আড্ডাঘরও ছিল বেশ জনপ্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া-অধ্যাপক-গবেষকদের সঙ্গেই হাজির হতেন দক্ষিণ কলকাতার বেশ কিছু শিল্পী-বুদ্ধিজীবী। আসতেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও। ব্ল্যাক কফির ধোঁয়া-চারমিনারের গন্ধ মিশে যেত সিআইটি বাজার চত্বর। বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে বসার চেয়ার মিলত না। অগত্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা গুনতে হতো। এখন অবশ্য ভিড় অনেকটাই হাল্কা। চেয়ার মেলে সহজেই। ‘আসলে নতুন প্রজন্মের কাছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেই বেশি পছন্দের’—বলছিলেন কফি হাউসেরই এক কর্মী। তবু কয়েকজন এখনও আসেন। নিয়মিত। দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছাড়তে পারেননি বলেই বোধহয়...।
ঝাঁ চকচকে কফিশপগুলির জৌলুসেই কি ম্লান হয়েছে কফি হাউস? আগ্রহ হারিয়েছে নবীন প্রজন্ম? অমোঘ প্রশ্ন। শুকনো উত্তর খোঁজার বদলে অবশ্য জেন ওয়াইকে কাছে টানতেই নিউ টাউনে গড়ে উঠেছে কফি হাউসের আধুনিক সংস্করণ। ধারে-ভারে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে হাল ফ্যাশনের যে কোনও ক্যাফেকে। কোলাহলমুক্ত নিউ টাউনের এই কফি হাউসের বাইরের গঠন অনেকটা প্রাসাদের মতো। তবে অন্দরসজ্জার ক্ষেত্রে মনে রাখা হয়েছে শিকড়ের টান—কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের নির্মাণশৈলীকে। আধুনিকতার মধ্যে এসেছে স্মৃতিমেদুরতার ছোঁয়া।
কফি হাউস আসলে স্মৃতির জগদ্দল পাথর নয়। বহমান এক স্রোতধারা। লন্ডন হোটেলে কলকাতায় প্রথম ‘কফি রুম’ বানিয়েছিলেন উইলিয়াম পার্কেস। ১৭৬২ সালের ২১ জুন। কলকাতায় ‘কফি-কালচার’-এর সূত্রপাত সেই থেকে। তবে লন্ডন হোটেলের ছোট কফি রুম মন ভরাতে পারেনি কোম্পানির তরুণ কর্মীদের। আরও জায়গা চাই—দাবি উঠেছিল। তার জেরেই ১৭৮৮ সালে তৈরি হয় ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস। 
অবশ্য সেখানকার দরজা খোলা ছিল শুধুই কলকাতায় কর্মরত কোম্পানির কর্তাব্যক্তি, কর্মচারী এবং বণিকদের জন্য। কফির কাপে তুফান তোলার জন্য এখানে রাখা থাকত কলকাতা, লন্ডন এবং মাদ্রাজের সমস্ত ইংরেজি কাগজ এবং রাজনৈতিক খবরের একাধিক পত্রিকা। দিব্যি জমে উঠেছিল সেই কফি হাউসের আড্ডাও। কিন্তু আচমকা একদিন বদলে গেল ছবিটা। কারণ একটাই, লোকসান। আড্ডা জমলেও ব্যবসা তেমন জমেনি। অগত্যা কফি হাউসটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন মালিক। কিন্তু বেঁকে বসেন হাউসের সদস্যরা। শেষে ঠিক হয়, কফি হাউস বাঁচাতে লটারি করা হবে। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। নিলামের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় কলকাতার কফি প্রেমের একটি পর্যায়। পার্কেস সাহেবের দেখানো পথে মাদকের নেশা থেকে ব্রিটিশ যুবকদের ফেরাতে এই কফিকেই অস্ত্র করেছিলেন ক্যাপ্টেন হেনরি পিডিংটনও। এর পর কেটেছে অনন্ত সময়। ব্রিটিশ যুগ, স্বদেশি আন্দোলন, অ্যালবার্ট হল থেকে কফি হাউস হয়ে ওঠার সঙ্গেই বদলেছে কলকাতা। বদলেছে মানুষ। জীবন। 
শহরের অলি পথ, গলি পথজুড়ে মায়াময় আলোমাখা ছোট ছোট ক্যাফের ভিড়। চটকদার হরেক নাম। তার মধ্যেই মিশেছে ‘ক্যাফে দে জেনি’র মুজতবা-স্মৃতি।

23rd     April,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ