বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

রোজনামচা
সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

ভারী সুন্দর সেজেছে মেয়েটি। কপালে ছোট টিপ, চোখের কোলে গাঢ় কাজল, অধর যুগলে গোলাপ কুঁড়ির রং! রোজকার থেকে একেবারেই আলাদা। জ্যোৎস্নার মতো স্বচ্ছ শাড়িখানা ফরসা গায়ে দিব্যি মানিয়েছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন শমিতা। মাত্র মিনিট আটেকের ভিডিওক্লিপ। মিঠে-কষা কিছু কথা, টুকরো-টুকরো দৃশ্য...মুহূর্তেই শুরু থেকে শেষের দিকে গড়িয়ে যায়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শমিতা দু-তিনবার করে দেখেন। রোজ। সময় কাটতে না চাইলে পুরনো ক্লিপগুলোই ফিরে দেখেন আবার।  কী মিষ্টি বাচনভঙ্গি মেয়েটার! গানের গলাও অপূর্ব! বোঝাই যায় সংসারে টানাটানি, নিজেও সে কথা লুকোয়নি। তবে একচিলতে ঘরখানা পরিপাটি সাজিয়ে রাখে। মুখ দেখে যতটুকু আন্দাজ করা যায়, তাতে মনে হয় শমীকের চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট। তাই হয়তো সকলকে ছেড়ে এই মেয়ের অপেক্ষায় থাকতে ইচ্ছে করে শমিতার। মনে-মনে তিনি প্রশংসা না করে যেমন পারেন না, তেমনই অদ্ভুত টানটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।  
‘এত মন দিয়ে কী দেখছ গো শমিতাদি?’
গঙ্গা কিনারের বেঞ্চে শমিতার ঠিক পাশে এসে বসেছেন মিতালি। আজ দেরি হয়েছে মিনিট পনেরো। হাঁটতে বেরনোর ঠিক মুখেই কাঠের মিস্ত্রি নিয়ে আশ্রমের ম্যানেজারবাবু তাঁর ঘরে হাজির হয়েছিলেন। বর্ষার জলে ফুলেফেঁপে উত্তরের জানলার পাল্লা দুটো এক্কেবারে গিয়েছে। এলোমেলো হাওয়ার জ্বালাতন তো আছেই তাছাড়া মশারির ভেতরেও অবলীলায় হামলা চালায় রক্তচোষা দস্যুর দল। আশ্বিন পেরতে চলল। রাতবিরেতের দমকা হাওয়ায় এখন মিতালির গা-শিরশির করে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বেশ কিছুক্ষণ গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে থাকে। ঠান্ডা লাগার ধাত নিয়ে মিতালি বরাবরই ভুগে আসছেন। আজকাল আবার চারদিকে বড় ভয়। রোগগুলো প্যাঁচালো হতে শিখেছে। ডাক্তারের দ্বারস্থ হলেই গুচ্ছের খরচ। শমিতাদির সঙ্গে থেকে থেকে আগের চেয়ে অনেক সতর্ক হয়েছেন মিতালি। মানসিকতাও বদলেছে কিছুটা। ছেলের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে দ্বিধা হয়। অতএব ‘সাবধানের মার নেই’ মন্ত্র জপতে-জপতে ‘দিনগত পাপক্ষয়’।   
মোবাইলখানা বান্ধবীর মুখের সামনে তুলে ধরলেন শমিতা। গোটা শান্তিনিকেতন জানে শমিতা-মিতালিতে গভীর সখ্য। সহোদরার মতো একে অন্যের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ভাগ না করে নিলে তাঁরা শান্তি পান না। বছর পাঁচেক এভাবেই দু’জনের খুঁটি হয়ে রয়েছেন দুজনে। শমিতা বললেন, ‘এই-ই তো ইউটিউব! তোমাকে বলেছিলাম, মনে নেই?’
মিতালির মুখেচোখে বিস্ময়! হ্যাঁ, শমিতাদির মুখে ক’বার শুনেছিলেন বটে, তবে ব্যাপারটা যে এইরকম সেটা আগে বুঝতে পারেননি।
‘ঘরের ভেতর ক্যামেরার সামনেই কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া! আমি ভেবেছিলাম টিভি চ্যানেলের মতো অনুষ্ঠান বুঝি! কিন্তু এ যে দেখছি সাধারণ মানুষের ঘরের গল্প!’
শমিতা মুচকি হাসেন। 
‘হ্যাঁ, ভ্লগ মানে জীবনেরই গল্প। হাসি-কান্না, রান্নাবান্না, ঘরকন্না...তবে দৈনন্দিন গল্পগাছা ভাগ করে নেওয়াটা আমার মন্দ লাগে নাগো মিতালি। দেখতে-দেখতে কেমন সুন্দর সময় কেটে যায় বলো তো! বাচ্চা মেয়েগুলো কী সাবলীলভাবে বলে যায় মনের কথা। দেখাতে থাকে সংসারের আনাচ-কানাচ!’
‘তা ঠিকই বলেছ শমিতাদি। আমাদের বুড়ো চোখ এসবই তো দেখতে চায়। নতুন সংসার...ফুলফলে, ভরন্ত!’
ছেলের বিয়ের পর হাতে ধরে পল্লবীকে গৃহকর্ম শিখিয়েছিলেন মিতালি। মা-মরা মেয়েটাকে কখনও ছেলের বউ বলে মনে করেননি। নিজের সন্তানের অধিক ভালোবাসা দিয়েছেন সবসময়। সেই মেয়েই যে শাশুড়িকে একদিন সংসার থেকে বাতিল করে দেবে কে জানত! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলেন মিতালি। উদাস নজর মেলে দেন দূরে। শমিতার দৃষ্টিও বান্ধবীর চোখ অনুসরণ করে। গঙ্গাবক্ষে আসন্ন রাতের প্রতিবিম্ব ধূসর প্রলেপের মতো ঘন হচ্ছে ক্রমশ। আকাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কালো কালো বিন্দুর আলপনা। ছোট-বড় পাখির ঝাঁক ফিরে যাচ্ছে আস্তানায়। মিতালি দু’চোখে জোর দিয়ে চশমার কাচের ভেতর থেকে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেন সুদূর ওই শূন্যে ওরা কেউ একা আছে কি না! এই ফিরে যাওয়া বলে দিচ্ছে আলো ফুরিয়ে এলে বিশ্রামের বড় প্রয়োজন। ঠিকই, কিন্তু বিশ্রাম মানে কি শুধুই নীরবতা অথবা নিরাপদ চার দেওয়ালে ঢাকা মুঠোভরা একাকিত্ব! জলের বাষ্পমাখা ভারী বাতাস ছুটে আসছে শান্তিনিকেতনের বাসাগুলোর দিকে। ঘড়িতে পৌনে ছ’টা। শমিতা আর মিতালি পার্কের দিকে পা বাড়ালেন। দু’ধারে সযত্নে লালিত সবুজের মাঝে সিমেন্ট বাঁধানো একচিলতে লাল পথ। এই পথ ধরে এগলে বৃদ্ধাশ্রম সংলগ্ন ছোট্ট মন্দিরটি। মার্বেলের সিংহাসন আলো করে রয়েছেন নানা দেবদেবী। পুজো শুরু হয়েছে আগেই। সন্ধ্যারতির ক্ষণ আগতপ্রায়। আগে এ সময়টায় মন্দিরের বারান্দায় তিল ধারণের জায়গা থাকত না। কতিপয় অশীতিপর সদস্য ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই শামিল হতেন ঠাকুরের দরবারে। এখন আর ভিড় হয় না। পুণ্যতিথি ছাড়া পূজারির যাতায়াতও বন্ধ। আজ বহুদিন পর এই সামান্য আয়োজন। সাত তাড়াতাড়ি অফিসঘরে তালা ঝুলিয়ে ম্যানেজার বিধানবাবু নামিয়ে এনেছেন বুড়ো হারমোনিয়ামটাকে। ঘণ্টাখানেক ভজন-কীর্তন চলবে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে শমিতা দেখলেন, মাস্ক ঢাকা ক’টি ম্লান মুখ চাতকের মতো চেয়ে রয়েছে আরাধ্যের দিকে। পারস্পরিক আলাপে অনিচ্ছুক। একগাল হেসে এগিয়ে এসে কথা বলতেন যাঁরা, তাঁদের কতজনকে যে মহামারী ছিনিয়ে নিয়েছে, সে কথা ভাবলে বুকটা ভার হয়ে ওঠে। মনে পড়ে বিগত দিনগুলোর কথা। মিত্রদা, কিশোরবাবু, সুকন্যাদি রাক্ষুসে জ্বর আর শ্বাসের কষ্ট নিয়ে একে-একে যখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিলেন, শমিতার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। অশান্তি করছিল শমীক, ‘তোমাকে কতবার বলেছিলাম মা, আমাদের সঙ্গে এসো। এই বয়সে একা থাকার অনেক বিপদ। কেন যে জেদ করলে তুমি? এবার কী হবে বল তো? তোমার যদি কিছু হয়, ওল্ডএজ হোমের লোকেরা দায়িত্ব নেবে তো? একটা ভালো হসপিটাল পর্যন্ত নেই ওখানে!’  
গোটা পৃথিবী থমকে গিয়েছে তখন। ছেলের প্রশ্নের সামনে শমিতাও আর যুক্তি সাজাতে পারছিলেন না। ইউএস যাওয়ার আগে শমীকরা তাঁকে রেখে যেতে চায়নি। থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন শমিতা। মনের কোণ থেকে কে যেন বলেছিল, ছেলে-বউমার সঙ্গে সাতটা বছর তো কাটালে, এবার একটু একলা থাক। প্রবাসে তোমার উপস্থিতি যেন ওদের কর্মজীবনে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। ভয় পেয়েছিলেন শমিতা। সেই শুরু থেকেই স্বাবলম্বী জীবন কাটাচ্ছেন। অসময়ে কর্তা চলে যাওয়ার পরেও নিষ্ঠাভরে স্কুলের চাকরি করে গিয়েছেন। একা হাতেই ছেলের উচ্চশিক্ষার যাবতীয় ভার সামলেছেন। নিজের কাছে কোনওদিন যদি ছোট হতে হয়, মরেও যে শান্তি পাবেন না। হাজার ভাবনা আর দোটানার মাঝেই অবশেষে শমিতা একদিন খুঁজে পেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের ঠিকানা। ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘তুই চিন্তা করবি বলেই এই সিদ্ধান্তটা নিচ্ছি বাবাই। ওখানে আমার মতো আরও অনেক মানুষ থাকে। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বেশ ভালোই কাটবে আমার। আর বছরে একবার তো তোরা আসবিই।’
‘কিন্তু মা, আমরা থাকতে তুমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে কেন? লোকে কী বলবে মা?’
সস্নেহে ছেলের মাথায় রাত রেখেছিলেন শমিতা, ‘লোকের কথা ভাবতে তো তোকে আমি শেখাইনি বাবাই। শেষ বয়সে মায়ের বোঝা বইবি বলে কি এতটা বড় করেছি তোকে? মন দিয়ে চাকরি কর বাবু। তোদের দু’জনের সামনে কত সম্ভাবনা! কতটা পথ চলা বাকি! এখন আর আমাকে নিয়ে ভাবিস না। বাড়িটা রইল, অসুবিধে হলেই আমি ফিরে আসব। তখন না হয় তোরা এসে আমাকে নিয়ে যাস।’
মায়ের জেদের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল শমীক। দেশ ছাড়ার আগে দফায়-দফায় শান্তিনিকেতনে এসে খবরাখবর নিয়েছিল ওরা। দু’বেলা নিয়ম করে পড়তে বসানোর মতোই স্মার্টফোনের খুঁটিনাটি শেখাতে শুরু করেছিল তিতাস। 
‘বি আ গুড গার্ল মামণি। ভালো করে রপ্ত করে নাও। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিডিওকল সব শিখতে হবে। তোমাকে না দেখলে আমরা কিন্তু শান্তি পাব না।’
তিতাসটা খুব সরল আর ছেলেমানুষ। মুঠোর ভেতর ফোনটা চেপে তিতাসের মুখখানা মনে করে আনমনেই হেসে ফেললেন শমিতা। 
থুতনির কাছে মাস্ক নামিয়ে এনেছেন মিতালি। অনেকদিন পর আজ তাঁর গলায় সুর। বান্ধবীর পাশে বসে দু’চোখ বুজে গোপীনাথের চরণে শ্রদ্ধামিশ্রিত গান অর্পণে ব্যস্ত তিনি। শমিতার বড় ভালো লাগছে। দেশ দুনিয়া কবে যে আবার আগের মতো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে কেউ জানে না, কিন্তু বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলোকে উপভোগ না করতে পারলে এই জীবন মৃত্যুর থেকে কিছু কম নীরস নয়। 
****
ট্রাঙ্কের ঢাকনা খোলা। রুক্ষ হাওয়ার দাপটে খাতার পাতাগুলো ফুরফুর করে উড়ছে। টেবিলে ঢাকা দেওয়া রাতের খাবার যেমন কে তেমন পড়ে। খোলা জানলার সামনে মোহাবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে মিতালি। মনটা বিক্ষিপ্ত। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর স্বরলিপি লেখা পাতাগুলো ছুঁয়ে নিজেকে একটা খালি পাত্রের মতো মনে হচ্ছে। বড় আশা করে ভোরবেলা তাঁকে রেওয়াজে বসাতেন বাবা! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা নিয়মের অন্যথা হতো না। কিশোরীবেলায় বাবার সঙ্গে বড়-বড় অনুষ্ঠানে গেয়েছেন মিতালি। স্টেজ থেকে নামলেই গুণীজনেরা মাথায় হাত ছুঁইয়ে বলতেন, ‘তোমার গলায় স্বয়ং মা সরস্বতীর বাস। ভুলেও যেন সুরের সঙ্গ ছেড় না।’ 
ছেড়ে দিতে হবে সে কথা কি মিতালি নিজেও ভেবেছিলেন কখনও? বাবা মারা না গেলে তাঁর জীবন হয়তো একেবারে অন্যরকম হতো। মিতালির মায়ের ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে পিঠোপিঠি তিন সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়েছিল। গানের মাস্টার বাবা কী আর রেখে গিয়েছিলেন পরিবারের জন্য? সেলাইয়ের কাজ করে ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ...তার বেশি কিছুই খাওয়াতে পারতেন না মা। মিতালি গান শেখার বায়না করলে ভাইবোনের প্রতি অবিচার হতো তখন। হলদে হয়ে যাওয়া ছেঁড়া এই খাতাই জানে মিতালির সব গল্প। প্রথমদিন দেখতে এসে শুভময়ের মাসি বলেছিলেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না। দিদির বাড়িতে গানবাজনার খুব কদর। আপনাদের মেয়ে সুখীই হবে।’
মাত্র উনিশের মিতালি কতই না স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন! পড়াশোনার প্রতি কোনওকালেই খুব আগ্রহ ছিল না। গানই ছিল ধ্যানজ্ঞান। প্রথমদিকে পড়শি ননদরা আবদার করত, ‘বউদি একটা গান গাও। রেকর্ড করে রাখি। বন্ধুদের শোনাব।’  
ওই পর্যন্তই। শুভময় কোনওদিন স্ত্রীকে উৎসাহ দেননি। টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি টপকানো মেয়ের সব কিছুই তাঁর কাছে ঠাট্টার মতো ছিল। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকেও প্রশ্রয় পাননি মিতালি। শোকে-আঘাতে-অনভ্যাসে-তাচ্ছিল্যে অচিরেই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিল সুর। এই শান্তিনিকেতনের মন্দিরে বসে তবুও মিতালি মন ভরে গাইতে পারেন। মনে পড়ে যায় সঙ্গীত পূজারি বাবাটার কথা। 
‘খুকু, তোকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি রে মা। আশা করি, একদিন তোর গানের রেকর্ড বেরুবে। লোকে তন্ময় হয়ে শুনবে তোর গলা। আর বুক চওড়া করে আমি বলব, আমি তোর বাবা।’
চোখে জল আসে মিতালির। বহু কষ্টে মানুষ করা ছেলের পরিবারে আজ তিনি বোঝা। জীবন আর কতদিনেরই বা! যাদের জন্য সব ছেড়েছিলেন, তারাও কেবল শূন্যতা দিয়ে গেল। শমিতাদি বলে প্রত্যাশা মানুষের দুঃখের একমাত্র কারণ। বুড়ো বয়সে বাবা-মা যদি মালপত্রের মতো নিজেদেরকে সন্তানের কাঁধে চাপিয়ে দেন, সন্তানরা বিমুখ হতে বাধ্য। চতুরাশ্রমের শেষ ধাপ ছিল সন্ন্যাস। এই বয়সে আর কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা নয়, হওয়া উচিত নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ। শমিতাদি উচ্চশিক্ষিতা। মিতালি তাঁর কঠিন কথাগুলো বোঝেন না। তিনি শুধু জানেন পেটের ছেলেও তাঁর আপনজন হয়নি। সুযোগ পেয়েই রং বদলে ফেলেছে।     
****
তিন-চারদিনের বৃষ্টিতে দেখা-সাক্ষাৎ একেবারে বন্ধ। শমিতা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করেছিলেন। মিতালি বলেছেন, ‘তেমন কিছু নাগো। কোমরে ব্যথাটা একটু বেড়েছে। এত সহজে কি আর মরব দিদি?’
মিতালির কথায় লুকনো হতাশার রেশ বুঝতে দেরি হয়নি শমিতার। ছেষট্টি পেরনো অভিজ্ঞ নজর, মানুষ গড়ার অভিজ্ঞতা... সেসব কি আর বৃথা যায়? শমিতা বোঝেন মাত্র ষাটে পৌঁছেই মিতালি বাঁচার ইচ্ছে হারাচ্ছেন। একটু একটু করে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন কালো একটা গর্তে। বেচারি সহজসরল মানুষ। মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়ার মোহ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। জীবনের পাল্লাও অপ্রাপ্তির দিকেই ভারী। মাসের খরচের জন্য ছেলে খোঁটা দিতে ছাড়ে না। এই কারণেই মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। বিয়ে-স্বামী-সন্তান সবই একটা স্টেজ শো-এর অংশমাত্র। আজ আছে, কাল নেই। চৌত্রিশ বছরের দীর্ঘ চাকরিজীবনে বহু মেয়েকে বাল্যবিবাহের ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন শমিতা। হাত ধরে রোজগারের পথে চলতে শিখিয়েছেন। তাঁকেও কম সমালোচনা শুনতে হয়নি। খারাপ সময়ে স্ত্রীর পাশে শক্ত অবলম্বনের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন সুবিমল। মনে-মনে নিজেকে গুছিয়ে নেন শমিতা। মিতালির ওপর বড় মায়া। ওকে কিছুতেই অন্ধকারে হারাতে দেওয়া যাবে না।
****
মলিন বিছানায় মিতালির পাশে বসে আগের দিনের মতোই মোবাইলটা তুলে ধরেছেন শমিতা। ক’দিন আগে মন্দিরের পুজোয় মিতালির গাওয়া গানটা বাজছে। মিতালির দু’চোখ ঝাপসা। গাল গড়িয়ে নামছে নোনা জলের ধারা। কী একটা বলতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন। চোখ ভর্তি প্রশ্ন। শমিতা বললেন, ‘খুব তো বলেছিলে সেদিন, বুড়ির গাওয়া গান নাকি কেউ পছন্দ করবে না? দেখছ, ফেসবুকে কত হাজার মানুষ ভিডিওটা দেখেছেন? শেয়ার করেছেন? অবশ্য গোটা কাণ্ডই আমার তিতাসের। আমি কেবল রেকর্ড করে ওকে পাঠিয়েছিলাম। তিতাস বলছিল, মিতালি মাসিমণিকে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলতে বলো মা। এমন গান রোজ শুনতে পাব।’
কাঁপা হাতে শমিতার হাত দুটো জড়িয়ে ধরেছেন মিতালি। মেঘ কেটে যাচ্ছে। একফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। মিতালির এখন খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আশার আলো কি এমনই হয়! নরম আর হলদে!   
অঙ্কন: সুব্রত মাজী

6th     March,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ