বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা
 

চলার পথে
উপলব্ধি

চলার পথে তো কত কিছুই ঘটতে থাকে, কিন্তু সেইসব ঘটনা সাধারণত নজরেই পড়ে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি হচ্ছে। এমনটা ঘটেছিল কল্লোল যুগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যালের অভিজ্ঞতায়। হিমালয় ভ্রমণের সময় একবার রাস্তার পাশে সুদৃশ্য এক পাথর তাঁর নজরে আসে। পাথরটি এতই সুন্দর ছিল যে, তিনি সেটা সঙ্গে নিয়ে নেন কখনও কোথাও গৃহসজ্জার কাজে আসতে পারে এই ভেবে। সেসময়ে পদব্রজেই ভ্রমণ হতো। তাই বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর পাথরের ভার চলার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করায় তিনি পাথরটি সেখানেই ফেলে যান এবং স্বাভাবিক নিয়মে এই অকিঞ্চিৎকর পাথরটির কথা কয়েকদিন পর ভুলেও যান। মাসখানেক পর ভ্রমণ অন্তে ফেরার পথে এক গাছের তলায় একটি মন্দির ও কিছু মানুষের ভিড় দেখে তাঁর মনে হয়, যাওয়ার সময় তো জায়গাটা জনমানব শূন্য ছিল, এই কয়েকমাসে কী এমন ঘটল যে এই পরিবর্তন! কৌতূহলী হয়ে মন্দিরের কাছে গিয়ে লেখক আবিষ্কার করেন, যে সুন্দর পাথরটি তিনি কয়েক মাস আগে আবর্জনা মনে করে ফেলে গিয়েছিলেন, সেটাই আশপাশের গ্রামবাসীরা দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে নিয়েছে কোনও দেবমাহাত্ম্য ভেবে। মন্দির স্থাপন করেছে, পুজো শুরু করেছে। এই উপলব্ধিটাই আসল বিষয়। জীবনে একই ঘটনা একজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্য আর একজনের কাছে সাধারণ মনে হতেই পারে। যেমনটা ঘটেছিল পাথরটির বেলায়। অনেক সময় খুব সাধারণ কোনও ঘটনা হয়তো স্থায়ী প্রভাব ফেলে, যা একজনের মানসিক গঠনের সহায়ক হয়। আবার অনেক ঘটনা যা ঘটে যাবার সময় সেভাবে দাগ কাটে না, কিন্তু পরে মনে হয় কেন তখন বুঝিনি। এমন একটা ঘটনার কথা বলি।
আমার বাড়ির খুব কাছে, ডোভার লেনে একটা বাড়িতে ভারত স্কাউটস অ্যান্ড
গাইডস-এর ট্রেনিং হতো। বাড়িটা ছিল সাউথ পয়েন্ট স্কুলের একটা অংশ। মানে সাউথ পয়েন্টের কতগুলো ক্লাস এই বাড়িতেই হতো। পুরনো বাড়ি, সামনে একফালি জমি— যেটা মাঠের মতন। সেখানেই স্কুল শেষের পর বসত স্কাউটের সেশন। 
আমি অল্প বয়স থেকেই স্কাউটের সঙ্গে যুক্ত। দেখতাম, সন্ধের পর একজন ভদ্রলোক ধুতি আর হালকা নস্যি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে কাঁধে ঝোলা নিয়ে আসতেন, ক্লাসরুমের বাইরে দালানে বসে থাকতেন কিছুক্ষণ। তারপর আশপাশের বস্তির কয়েকটি ছেলেমেয়ে এলে ভিতরে ক্লাসরুমে নিয়ে গিয়ে পড়াতেন। কখনও বাংলা, কখনও ইংরেজি আবার কখনও ভূগোল বা ইতিহাসও। পড়ানো হয়ে গেলে নিজের কাঁধের ঝোলা থেকে বের করতেন পাউরুটি, ডিম সেদ্ধ আর কলা। ভাগ করে দিতেন সকলের মধ্যে। এই দেখাটা ছিল দূর থেকেই, কিন্তু একদিন কাছে আসারও সুযোগ গেল ঘটে।
একদিন পিতৃদেব তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘দর্শক’ আমার হাতে দিলেন এবং ওই ভদ্রলোকের বিবরণ দিয়ে বললেন ওঁকে পত্রিকাটি দিয়ে আসতে। পত্রিকা দিতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হল। কৌতূহল আগে থেকেই ছিল, তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনি রোজ ওই ছেলেমেয়েদের নিজে থেকে খাওয়ান কেন?’ বললেন, ‘তা না হলে যে এরা পড়া শিখতে আসবে না বাপু।’ উনি মনে করতেন, বেসিক শিক্ষাটা সকলের জন্য জরুরি। নিজের সাধ্যমতো কারওর উপর নির্ভরশীল না হয়েই চেষ্টা করতেন। মাঝেমধ্যেই উনি খামে ভরে আমাকে কিছু একটা দিয়ে বলতেন— ‘তোমার বাবাকে দিয়ে দিও।’ বুঝতাম পত্রিকার জন্য লেখা। পত্রিকা, কখনও বই, কখনও লেখা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঁর বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। জেঠু বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ওঁর নাম কী কখনও জানার কথা মনে হয়নি। তখন আমি ক্লাস সিক্স কী সেভেনে পড়ি।
তারপর পড়াশোনার চাপ ইত্যাদি নানান কারণে একসময় ক্ষীণ হয়ে এল স্কাউটে যাতায়াত, সেই ভদ্রলোকও জীবন থেকে গেলেন হারিয়ে। বেশ কিছু বছর পর, তখন আমি বারো ক্লাসের ছাত্র। সালটা ১৯৭৯ হবে। খবরের কাগজের প্রথম পাতা খুলেই দু’জনের মৃত্যু সংবাদ, একই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। একজন বনফুল, অনেকের মতন আমারও প্রাণের লেখক। আর অন্যজন সেই ভদ্রলোক, যাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পত্রবাহকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে। অবাক হয়ে পিতৃদেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উনি যে এত বিখ্যাত লোক তা তো তখন বলনি!’ হ্যাঁ, আমি জানতাম না, যাঁকে জেঠু বলছি, প্রায় রোজই যাঁর সঙ্গে গল্প করছি মানে বেশিটাই ওঁর কাছ থেকে শুনছি, তিনি আর কেউ নন— কমলকুমার মজুমদার।
পরে যখন কমলকুমার সম্পর্কে জেনেছি, তার লেখা পড়েছি আমার বারবার মনে হয়েছে, এমনও হয়, এমন একজন ব্যক্তিত্বের এত কাছাকাছি এলাম, অথচ তিনি যে কে সেটা বুঝলাম তাঁর মৃত্যুর পর। সামান্যই ঘটনা, কিন্তু জীবনের পথের এই ঘটনাগুলোই তো প্রভাবিত করে অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দেয় অনাগত চলার পথকেও।
       অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল

3rd     January,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ