ছোটবেলা থেকেই শ্যামাসংগীতে আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেটা পান্নালাল ভট্টাচার্যের গান শুনেই। বাড়িতে রেকর্ড ছিল। ‘দোষ কারও নয় গো মা...’ পাগল করা একটা গান, দাশরথি রায়ের অপূর্ব লিরিক। পুজোআচ্চা বা মন্দিরে যাওয়া, এসবে আমি নেই ঠিকই... কিন্তু ভক্তিগীতি বরাবর ভালো লাগে। শ্যামাসংগীত আমাদের বাংলা গানের ইতিহাসে পৃথক একটা অধ্যায় বলা যেতে পারে। এই গান ঘিরে যে সাহিত্য-সম্পদ তৈরি হয়েছে, তা অমূল্য। রামপ্রসাদ সেনের কথা ভাবুন, যাঁর গানের কথা সময়ের থেকে একশো বছর এগিয়ে ছিল। আমরা আধুনিকতার বড় বড় কথা বলি, রামপ্রসাদের লিরিক দেখুক কেউ। কাকে বলে লিরিক, অমন লিখতে বুকের পাটা লাগে। মনে করুন কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। আধুনিক গান কাকে বলে, তাঁদের থেকে শিখতে পারে এখনকার প্রজন্ম। ওইসব শব্দ আমরা ব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারব না। আমাদের সফিস্টিকেশনে লাগবে! রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত কিন্তু পেরেছেন। অবলীলায়। আরও কত খ্যাত-অখ্যাত গীতিকার রয়েছেন। শ্যামাসংগীতে দর্শন, জীবনবোধ, ভক্তিরস সব আছে।
‘সেকুলার’ কথাটা আজকাল খুব আলগাভাবে ব্যবহার করা হয়। কাজী নজরুল ইসলামের কথা মনে করুন। আমার কাছে নজরুলের শ্যামাসংগীত একটা মানসিকতার প্রকাশ। তাঁর কোনও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। নজরুল শ্যামাসংগীত, ইসলামি গান অথবা কীর্তনাঙ্গের যে সব গান সৃষ্টি করেছেন, সবেতেই একজন সাধকের ছাপ। এক অন্যরকম আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছতে পারলে তবেই মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব। তিনি শুধু গুটি কয়েক গান রচনা করে থেমে যাননি। মুক্ত মনের মানুষ হিসেবে নজরুল শ্যামাসংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। সমস্ত ধারার ভাব এসে তাঁর অন্তরে যেভাবে মিশেছে, তার মধ্যে শ্যামাসংগীতও ছিল। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তো দরগা যেতেন, আবার মা কালীর সাধনাও করতেন। এঁরা সবাই সাধক। সাধনা থেকেই মিলে যান এত সহজে।
শ্যামাসংগীত গেয়ে অনেক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল নজরুলকে। সেটা আমাদের দেশের ধারা! এখন হলেও এমনটাই হতো। তাতে তাঁর কাজ থেমে থাকেনি। যাঁরা নজরুল ইসলামের সমাদর করেছেন, বা বুঝতে পেরেছেন তাঁর সৃষ্টির মাহাত্ম্য... তাঁদের কাছে নজরুল চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবেন। যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদের তো কেউ মনে রাখেনি! রাখবেও না। নজরুল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সাধক সত্তা কতটা জোরদার।
১৯৯৯ সালে কাজী নজরুলের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর শ্যামাসংগীত নিয়ে আমার একটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল। সেসময় আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন পণ্ডিত সুকুমার মিত্র। ছোটবেলা থেকেই সুকুমারদার গান অসম্ভব ভালো লাগত। সুকুমারদাও আমায় খুব স্নেহ করতেন। তাঁর নির্দেশনায় আগেও নজরুলের গান রেকর্ড করেছিলাম। শ্যামাসংগীতের কাজটার সময় ফের তাঁর কাছে গান শেখা এবং রেকর্ড। অ্যালবামটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাম ছিল, ‘মা আমার।’ এখনও অনুষ্ঠানে গেলে ওই অ্যালবামের গান গাওয়ার অনুরোধ আসে। সবটাই সম্ভব হয়েছিল সুকুমারদার জন্য। পরে নজরুলের ইসলামি গান নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে ছিল আমাদের। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য... সুকান্তদার আকস্মিক প্রয়াণে সব পরিকল্পনা হারিয়ে গেল। এই দুঃখ বরাবর থেকে গিয়েছে।