বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

ছায়া সুনিবিড়

যে পথেই মাতৃত্ব আসুক, তাঁরা মা— এটাই একমাত্র পরিচয় তাঁদের। অনিন্দিতা সর্বাধিকারী ও শ্রেয়া পাণ্ডের কথা লিখলেন স্বরলিপি ভট্টাচার্য।
 
সন্তানকে গর্ভে ধরলে তবেই কি মা? পালন করলে মা হওয়া যায় না? এ তর্ক নতুন নয়। মা শব্দটার বোধহয় নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। তবুও যাঁদের মাতৃত্বের পথ খানিক ভিন্ন, যাঁরা একা মা (সিঙ্গল মাদার) হিসেবেই বড় করছেন সন্তানকে, তাঁদের অভিজ্ঞতা খানিক নতুনই বটে।

অনিন্দিতার গল্প
‘এতদিন ধরে তোকে বলছি পৃথিবীটা এত সুন্দর, এর রং, রস, গন্ধ তোর জন্য সাজিয়ে রাখছি। কিন্তু এত তাড়াতাড়িই বা কী বাবা? এর হাওয়ায় কিন্তু বিষ মিশে আছে। আলোর পিছনে আছে অন্ধকার। আর কিছুদিন থাকতে পারলি না আমার গর্ভে? আর একটু তোকে আগলে রাখতাম! তুই আগুনের নদী সাঁতরে আমার কাছে আসছিস, তুই ভূমিষ্ঠ হলে তোর নাম দেব অগ্নিস্নাত বা অগ্নিস্নাতা’— সন্তানকে লেখা মায়ের চিঠি। মা অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। পেশায় চিত্রপরিচালক। আর সন্তান ন’বছরের অগ্নিস্নাত। 
আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে মা হয়েছেন অনিন্দিতা। বললেন, ‘মেয়েদের শরীরে তো একটা ঘড়ি আছে। ৩৫-এর পর মা হওয়া কঠিন হতে শুরু করে। এই ঘড়িটার কথা ভেবেই এটা প্ল্যান বি-এর মতো ছিল। প্রথম পরিকল্পনাটা আর পাঁচজনের যেমন থাকে। প্রেম, ভালোবাসা, সঙ্গী...। তারপর মনে হল, এ তো জীবনের যে কোনও সন্ধিক্ষণে আসতে পারে। কিন্তু মা তো যে কোনও বয়সে হতে পারব না। এই ভাবনায় আমার মা খুব সাপোর্ট করেছিলেন। ৩০-এর কোঠায় যখন বয়স মা বলেছিলেন, যদি মা হবি মনে করিস, তাহলে আর সময় নষ্ট করিস না। চিন্তা করতে সময় লেগেছিল, আমি যাকে পৃথিবীতে আনব, পৃথিবীটা তার জন্য প্রস্তুত তো? একটা সময় মনে হল, এটা ভেবে তো লাভ নেই। সমাজ তো প্রতিদিন বদলায়। আমার একটাই জীবন। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম।’
আইভিএফ পদ্ধতিতে প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার দু’মাসের মধ্যে মিসক্যারেজ হয়ে যায় অনিন্দিতার। তীব্র মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। ‘আমার মনে আছে সেটা ছিল একটা সরস্বতী পুজোর দিন। একা গাড়িয়ে চালিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর ধাতস্থ হতে শরীর-মনের একটু সময় লেগেছিল। আমার এমব্রায়ো ফ্রোজেন ছিল। ওই একই সাইকেলে আবার এমব্রায়ো আমার গর্ভে স্থাপন করা হয়। তার ফল অগ্নিস্নাত’, বলছিলেন তিনি। সন্তানসম্ভাবা হওয়ার পর থেকেই অনাগত সন্তানকে চিঠি লিখতেন তিনি। বললেন, ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়নি তাকে চিঠি লিখতাম। আসলে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এগুলো কাকে বলব? বাবা, মাকে বলতাম না। ওঁরা কষ্ট পাবেন। আমি একমাত্র সন্তান। আমাকে ঘিরেই ওঁদের স্বপ্ন। ফলে সব কথা ওকেই চিঠিতে লিখতাম। সেসব এখনও আগলে রেখেছি, ও শুধু লেবাররুমে লেখা একটা চিঠির কথাই জানে।’
মা-ছেলের সংসার এগিয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব খুশিতে। কিন্তু ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার সময় প্রথম ধাক্কা পেলেন অনিন্দিতা। পিতৃপরিচয় চাওয়া হল। সেই লড়াইয়ের কাহিনি বলতে গিয়ে বললেন, ‘ওকে বড় স্কুলে ভর্তির সময় বলা হয়েছিল, ও এভাবেই যে জন্মেছে তার প্রমাণ দিতে হবে। ভারতের আইনে অবিবাহিতার কোনও প্রমাণ নেই। তাছাড়া ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরিয়ে গিয়েছে মায়ের পরিচয়ই যথেষ্ট। ওর বার্থ সার্টিফিকেট পেতেও কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বেশিরভাগ স্কুলের মানসিকতা এরকমই। সাড়ে সাত মাস ওকে স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি। চাইল্ড রাইটস কমিশনে গিয়েছিলাম। তারা স্কুলকে চিঠি পাঠিয়েছিল। আমি দেখলাম লড়াই করে জোর করে এসব স্কুলে ওকে ভর্তি করলে আগামী দিনে ওর হয়তো ক্ষতি হবে। একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যেসব স্কুলে সমস্যা হয়েছিল তার সবক’টির প্রিন্সিপাল ছিলেন নারী। যে স্কুল ওকে সাদরে ভর্তি করে নিল, সেখানকার প্রিন্সিপাল পুরুষ।’ 
কিন্তু অগ্নিস্নাত নিজে কী ভাবে? ‘বাবা’ শব্দটা নিয়ে কী ধারণা ওর? অনিন্দিতার কথায়, ‘যবে থেকে একটু বুঝতে শিখেছে তবে থেকে ওকে বুঝিয়েছি ও কীভাবে পৃথিবীতে এসছে। ওর এমব্রায়ো বার্থডে আমরা সেলিব্রেট করি। ও স্কুলে বন্ধুদের গিয়ে চকোলেট দেয়। মজার কথা, ওর প্রিন্সিপাল ওর সঙ্গে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে লিখেছেন, ৩০ বছরের বেশি আমি শিক্ষকতার পেশায় রয়েছি। এই প্রথম এমব্রায়ো বার্থডে সেলিব্রেট করলাম। পৃথিবীটা একটু একটু করে বদলাচ্ছে। আমি যাকে শালগ্রাম শিলা না ভেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, সেই বদলানোর কাজটা তো একা আমি পারি না।’ 
একা মা হিসেবে সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব কি কোনও চাপ তৈরি করে? ‘বাবা জীবনে থাকলে যা করতেন, আমার ছেলের জন্য আমি সবটাই করি। অর্থাৎ তথাকথিত পুরুষের ভূমিকাও পালন করি। আমরা দু’জনে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখি। আমি নিজের ইচ্ছেয় সিঙ্গল মাদার হয়েছি, বাধ্য হয়েও তো কত মেয়ে এই পথ বেছে নিচ্ছেন।’ 
শ্রেয়ার পথ
অনিন্দিতার মতো শ্রেয়া পাণ্ডের মা হওয়াও একটু ভিন্ন পথে। চার বছর আগে সরোগেসির মাধ্যমে কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন তিনি। নাম রেখেছেন, আদর। প্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের কন্যা শ্রেয়া নিজেও এখন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ভিন্ন ভাবনায় পরিবারের সমর্থন ছিল? শ্রেয়া বললেন, ‘এখন সারোগেসির কথা অনেকে জানেন। তখন অতটা পরিচিত বিষয় ছিল না। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করে সমর্থন পেয়েছিলাম। মা সমর্থন করেননি প্রথমে। আদর জন্মানোর পর মা কিন্তু পাশে রইলেন। মা প্রথমে ভেবেছিলেন আমরা মজা করছি। খুব চিন্তা করতেন। এখন নাতনিকে চোখে হারান।’ 
রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে হওয়ায় কি সামাজিক বাধা অতিক্রম করা তুলনায় সহজ হয়েছিল শ্রেয়ার? তাঁর কথায়, ‘মায়ের মনে হয়েছিল সামাজিকভাবে প্রচুর বাধা আসতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক কেরিয়ার বাবার ছিল। বাবা খুবই সমর্থন করেছিল। বরাবরই আমাকে রাজনীতিতে দেখতে চেয়েছিলেন। আমার পিছুটান থাকুক, তা খুব একটা চাইতেন না। তবে আদরের ব্যাপারে খুব সাপোর্ট করেছিলেন। কোনওদিনই সামাজিক কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। আসলে আমি বিশ্বাস করি মানব শিশুর গর্ভধারিণী মা, সৎ মা, সরোগেট মা, দ্বিতীয় মা, পোষ্যর মা— এরকম কোনও ভাগ হয় না। ‘মা’ একমাত্র পরিচয়। ওর অন্নপ্রাশন, জন্মদিন সেলিব্রেট করে আমার সব আত্মীয়-বন্ধুরা। ও স্কুলেও ভর্তি হয়েছে। মায়ের একমাত্র অভিভাবক হওয়াটা এখন আইনসিদ্ধও।’
চার বছরের ছোট্ট আদর কি আপনার চলার পথটা বুঝতে পারে? মেয়ের কথা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাস গোপন করলেন না শ্রেয়া। বললেন, ‘ও সবাইকে বলে ও স্পেশাল। কারণ ও মায়ের হৃদয় থেকে জন্মেছে। ওর সব বন্ধু আমাকে চেনে। ওকে খুব ছোটবেলা থেকে বুঝিয়েছি, ও শুধু মায়ের। ও যখন একদম ছোট ছিল তখন আমার বাবাকে ‘ড্যাডি’ বলে ডাকত। বাবা চলে যাওয়ার পর আমাকেও তো ‘ড্যাডি’ ডাকতে শোনে না, তাই মিস করে না ডাকটা। বরং আমার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করে।’ 
শুধু আদরের মা নয়, একসঙ্গে অনেক শিশুর ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে চান শ্রেয়া। গত বছর মাদার্স ডে উপলক্ষ্যে ‘মাতৃত্ব’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করেছেন। তাঁর কথায়, ‘এটা মাতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা। বহু বাচ্চা দুর্বল অবস্থায় জন্মায়। কারণ অনেক সন্তানসম্ভবা মহিলা স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পান না। মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে যত সন্তানসম্ভবা মহিলা রয়েছেন, তাঁদের আধার কার্ডের সঙ্গে আমাদের অফিসের লিঙ্ক করিয়ে প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা তাঁদের ১৫ দিন অন্তর পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করছি।’ 
ছোট থেকেই মাকে এভাবেই দেখে শিখছে আদর। গর্বিত মা বললেন, ‘আমার বাচ্চা আমারই দায়িত্ব। আমি ওর সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটাই। এখন একটু সকালে উঠি। স্কুলে দিয়ে আসি ওকে। দুপুরটা ওর সঙ্গে থাকি। রাতে ঘুমনোর সময়ও ওকে সঙ্গ দিই। আমরা ভালো আছি। ওকে আমি কখনও মিথ্যে বলি না। আমার কাজটা কী, সেটা ওকে বোঝানো হয়েছে। আমি যেমন ছোট থেকে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন অফিস ঘুরতাম। আদরও তেমনই সকলের মধ্যে থেকেই বড় হয়ে যাচ্ছে।’

13th     May,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ