বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

সুরক্ষার  পেশায়  মেয়েরা

আত্মরক্ষা করতে করতে একদিন বেছে নেওয়া সুরক্ষা দেওয়ার পেশা। পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে এগচ্ছেন তাঁরা। মহিলা সিকিওরিটি গার্ডের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। লিখেছেন কমলিনী চক্রবর্তী।

‘ছোট থেকেই দেখতাম মেয়েদের জন্য সমাজের হাজারটা বিধি নিষেধ। এখানে যেও না, ওটা কোরো না, এতটার মধ্যে বাড়ি ফিরবে, সন্ধে হলে একা বেরবে না— ফিরিস্তি যেন শেষই হতে চায় না। এই ‘না’-গুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করত আমার। তাই অল্প বয়স থেকেই আমাকে সবাই ‘রেবেল’ বলত। বাড়িতেও এই নিয়ে কম হেনস্থা হয়নি। বাবার বকুনি, মায়ের পিটুনি কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু আমার স্বভাব বদলায়নি। বাধা গতে জীবনযাপন যেন আমার ধাতেই ছিল না। তাই তো পেশাটাও একেবারে ভিন্ন ধাঁচে বাছলাম। পুরুষতন্ত্রের গায়ে এক ঘা মেরে হয়ে উঠলাম মহিলা সিকিওরিটি গার্ড,’—কথা হচ্ছিল ভারতের প্রথম মহিলা সিকিওরিটি গার্ড বীণা গুপ্তার সঙ্গে। কুড়ি বছরেরও বেশি দিন ধরে তিনি এই পেশায় রয়েছেন। 
বীণা জানালেন ছয় বোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বড়। ছোটবেলায় সন্ধেবেলা বোনেদের সঙ্গে টিউশন ক্লাস থেকে ফেরার পথে অথবা অন্য কোথাও গেলে ইভটিজিংয়ের হাত থেকে তাদের রক্ষা করাই জীবনের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল তাঁর। নিজের দিকে না তাকিয়ে বরং অন্যকে কীভাবে ভালো রাখা যায় সেই চেষ্টাতেই মগ্ন থাকতেন তিনি। পরবর্তীতে ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জননী হিসেবেও সেই একইভাবে রক্ষা করার প্রবণতা থেকেই এই পেশায় আসেন। ২০০০ সালে তিনি পার্টটাইম চাকরি খুঁজছিলেন, এমন একটা চাকরি যাতে মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর ফুরসত পান। সেই সময়ই একটি বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে বীণার। তারা সিকিওরিটি গার্ড খুঁজছিল। কপাল ঠুকে বীণা অ্যাপ্লাই করলেন সেখানে। ফিজিকাল ট্রেনিংয়ের পাঠ তাঁর নেওয়াই ছিল, আত্মরক্ষার নানা টিপসও জানতেন। আর ছিল বিজনেস ট্রেনিং ডিগ্রি। সব মিলিয়ে বীণাকে সেই বহুজাতিক সংস্থার মনে ধরল। আর চেহারায় বড়সড় মহিলাটি হয়ে উঠলেন ভারতের প্রথম মহিলা সিকিওরিটি গার্ড। 
চাহিদা বাড়ছে 
তাই বলে যে এই পেশায় তারপর থেকেই মহিলাদের ঢল নামল, তা কিন্তু নয়। সেই চিত্র বদলেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু তার জন্য মহিলাদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এই বিষয়ে ‘সেফ হ্যান্ডস সিকিওরিটি সার্ভিসে’র কর্ণধার পূরবী দত্ত জানালেন, ‘আসলে ‘সিকিওরিটি’ শব্দটার সঙ্গে একটা বলশালী চেহারা কেমন যেন জড়িয়ে গিয়েছে। আর বলবান অর্থে যেহেতু মহিলার তুলনায় পুরুষের চেহারাই বেশি প্রকট তাই সিকিওরিটি গার্ডের পেশায় পুরুষদের অবাধ আধিপত্য। কিন্তু আর পাঁচটা ক্ষেত্রর মতোই মেয়েরা এখানেও নিজেদের ক্ষেত্র তৈরি করছে ক্রমশ। এর একটা কারণ অবশ্যই শিক্ষা, দ্বিতীয় কারণটি মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।’ তাঁর কথায়, মহিলারা যত বেশি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলেন ততই তাঁদের সুরক্ষার প্রয়োজন হল। আর সেই সুরক্ষার ক্ষেত্রে মহিলাদের চাহিদাও বাড়তে লাগল। এছাড়া সমাজ উন্নত হচ্ছে, তাতে বিদেশি ধাঁচ ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। বাজার করার জন্য এখন শপিং মল রয়েছে, সিনেমা দেখার জন্য রয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। এই সব ক্ষেত্রেই মহিলাদের আনাগোনাও প্রচুর। আর তাদের সুরক্ষিত রাখতে মহিলাদেরই প্রয়োজন। তাই শপিং মল বলুন বা মাল্টিপ্লেক্স কাস্টমারের চাহিদা মতোই সেখানে মহিলা সিকিওরিটি গার্ড মোতায়েন করা হয় আজকাল। এই চিত্রটাও কিন্তু তুলনায় নতুন জানালেন পূরবী। 
একপেশে মনোভাব
সেফ হ্যান্ডস সিকিওরিটি সিস্টেমের অফিসে প্রথম মহিলা নিয়োগ হয় মাত্র পাঁচ বছর আগে। মেয়েটির নাম ছিল পুষ্পা। স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তাঁর কাছে এসেছিল কাজের খোঁজে। লম্বা চওড়া পুষ্পাকে দেখেই পূরবী ভাবেন তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সিকিওরিটির কাজে নিয়োগ করার কথা। প্রশিক্ষণ অর্থাৎ দৈহিক সুরক্ষার সাতসতেরো। সঙ্গে চাই চটপট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। কোন পরিস্থিতিতে কী করলে সুবিধে হবে, সেটা ভাবার জন্য সাকুল্যে পাঁচ সেকেন্ড সময়। তারই মধ্যে নিজের ও অন্যের সুরক্ষা করতে হবে। লাফ, ঝাঁপ, দৌড়, তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা, ব্যালান্স বজায় রেখে দ্রুততার সঙ্গে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়া— এইসব শেখার পর শুরু হল সুরক্ষার ট্রেনিং। সেই ট্রেনিং নিতে গিয়েই পুষ্পা অনুভব করেন আমাদের সমাজ এখনও কতটা একপেশে। মহিলারা এই ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ভাবতেই শেখেনি আমাদের সমাজ। কিন্তু সিকিওরিটি সিস্টেমে মহিলাদের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজের দেখার চোখও ক্রমশ বদলাতে শুরু করে। 
সহজাত প্রতিভা
মহিলাদের কিছু সহজাত প্রতিভা রয়েছে, বললেন বীণা। বিপদে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মহিলাদের বেশি। এই কারণে সিকিওরিটি সার্ভিসে মহিলাদের চাহিদা বাড়ছে। বীণার কথায়, এই যে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া, এর জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ লাগে। কিছু পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে মহিলাদের যেতে হয়। আগুন লাগা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কী করবে সেই প্রশিক্ষণ যেমন দেওয়া হয়, তেমনই দু’জন ক্রেতার ঝগড়া, শপিং মল বা রেস্তরাঁয় চুরি ইত্যাদি কীভাবে সামলাবে সেই প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। দেখা গিয়েছে ঝামেলা, ঝগড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে মহিলা সিকিওরিটি গার্ডরা সহজে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। 
ক্ষেত্র বিশেষে
অনেক সময় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও ক্লায়েন্ট মহিলা সিকিওরিটি চান। মহিলা অতিথিরা তাতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, জানালেন বীণা। এছাড়া অনেক সময় শপিং মল বা মাল্টিপ্লেক্সে কিছু অঞ্চল থাকে যেখানে পুরুষ সিকিওরিটি গার্ডরা যেতে পারেন না। লেডিস ওয়াশরুম তারই একটা। কখনও এমন কোথাও ঝামেলা বাঁধলে তা সামাল দেওয়ার জন্য মহিলা সিকিওরিটি গার্ডই লাগে। 
বীণা জানালেন বলিউডের অভিনেতারা নাকি সবচেয়ে বেশি মহিলা সিকিওরিটি গার্ডের উপর ভরসা করেন। বাউন্সার যতই পুরষ থাক না কেন, কোর সিকিওরিটি টিমে তাঁরা মহিলা রাখবেনই। শাহরুখ খান তাঁদেরই অন্যতম। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে কোনও মেগা ইভেন্টে গেলে মহিলা সিকিওরিটি গার্ড নিয়ে যান। না হলে মহিলা ভক্তদের হাত থেকে বাঁচা দায় হয়ে দাঁড়ায়। মহিলারা বারবার কাছে আসতে চায়, গায়ে হাত দিতে চায়, সেগুলো আটকানো পুরুষ সিকিওরিটি টিমের পক্ষে অসম্ভব। ফলে এই ধরনের ঘটনা এড়াতেই তিনি মহিলা সিকিওরিটি গার্ডের উপর ভরসা করেন। বলিউডের নায়করা অবশ্য কোনও সংস্থা থেকে মহিলা সিকিওরিটি গার্ড নেওয়ার পর তাকে আলাদা ট্রেনিং দিয়ে নেন। সেই ট্রেনিংয়ের মধ্যে ভালোভাবে কথা বলা, দূর থেকে দেখে পরিস্থিতি আঁচ করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করা ইত্যাদি। 
তবু তফাত থেকে যায়
কিন্তু এত অগ্রগতি সত্ত্বেও মহিলাদের এই পেশায় কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখে না, জানালেন পূরবী। তাঁর কথায়, ‘সিকিওরিটি টিমে মেয়েরা অনেকটাই দুধেভাতে হিসেবে থাকে। ঝগড়া মেটানো, লেডিস ওয়াশরুমে কেউ সমস্যায় পড়লে সাহায্য করা পর্যন্তই তাঁদের দৌড়। কিন্তু আসল বিপদে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব তাদের উপর কেউই দিতে সাহস পায় না। তাই গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে তাদের যতটা ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ততটা হয় না। এর জন্য মহিলাদেরও আরও বেশি সচেতন হতে হবে। অনেক মহিলাই শপিং মল বা এটিএম-এর গার্ড হিসেবে স্বচ্ছন্দ। কর্পোরেট দুনিয়ায় তারা পা রাখতে ভয় পায়। এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্রমশ মানসিকতার বদল ঘটছে।  নতুন কিছু করতে গেলে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, সেটাই দস্তুর। মহিলাদেরও সিকিওরিটি গার্ডের পেশায় নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে গেলে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। পিছিয়ে পড়লে চলবে না। লড়াই করে যেতে হবে। এক না একদিন সব বেড়া ডিঙিয়ে তারা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করবে, এমনই বিশ্বাস পূরবী দত্তর।  

22nd     April,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ