বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
আমরা মেয়েরা
 

প্রগতি এখন হাতের মুঠোয়

নারীপ্রগতি কি শুধুই অলীক কল্পনা? নাকি প্রগতির পথে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে মেয়েরা? নারীকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্বয়ম-এর ডিরেক্টর অনুরাধা কাপুর-এর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেন কমলিনী চক্রবর্তী।

সুষমা রায়চৌধুরীর জীবনটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম দিয়ে। দেশ গড়ার স্বপ্নে    বিভোর হয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি। ক্রমশ দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু জীবন তাঁর অন্য খাতে বয়ে গেল। বিবাহ, সংসার, সন্তানের পর আর রাজনীতি করেননি সক্রিয়ভাবে। বরং স্কুল শিক্ষিকা হয়ে নিজের অর্জিত মূল্যবোধ আগামী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৯৬। তবে বয়স তাঁর কাছে নিছকই সংখ্যা। মনে-প্রাণে তিনি চিরকালই অাধুনিক, প্রগতিশীল।  
বছর ৪০ আগের কথা। এক স্বনামধন্য সাহিত্যিকের নিয়মভঙ্গ অনুষ্ঠানে তাঁর শোকস্তব্ধ স্ত্রী নীহারিকার পাশে খেতে বসেছিলেন সুষমা। বৈধব্যের নিয়ম অনুযায়ী নীহারিকার পাতে নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হলে সুষমা প্রায় জোর করেই নিজের ভাগের আমিষ পদটি তাঁর পাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমরা একসঙ্গে খাব। এবং আমি যা খাব, আপনিও তা-ই খাবেন।’ মনে মনে এতটাই প্রগতিশীল ছিলেন সুষমা। 
এখন প্রশ্ন হল স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর নারীপ্রগতি বা নারী মনের আধুনিকতা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল নারীদের জন্য কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্বয়ম-এর অধিকর্তা অনুরাধা কাপুরের সঙ্গে। তিনি বললেন নারী জীবনে সমগ্র একটা উন্নতি অবশ্যই ঘটেছে। এবং সেই উন্নতি নারী প্রগতিরই সাক্ষ্যস্বরূপ। এখন সমাজের সব স্তরেই মেয়েরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠছে। পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে নারীপ্রগতির কারণে। আর নারীপ্রগতি হয়েছে বলেই সমাজের দেখার চোখটাও অনেকটা বদলে গিয়েছে। মেয়েরা এখন নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন। সেই অধিকারগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যও তারা প্রস্তুত। প্রয়োজনে নিজেদের অধিকারের জন্য তারা লড়াই করতেও পিছপা হয় না। ফলে মেয়েদের এই যে আচরণগত তফাত এটাই নারীপ্রগতির আসল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এবং সেই প্রগতি ক্রমবর্ধমান। 
নারী চরিত্রের এই পরিবর্তন কিন্তু একদিনে হয়নি। আস্তে আস্তে মেয়েরা নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলেছে। একটা সময় ছিল, গত শতাব্দীর ছয় বা সাতের দশক নাগাদ, যখন মেয়েদের ওপর অত্যাচারটা সমাজে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই গণ্য হতো। কিন্তু ক্রমশ নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করল। সহ্য করতে করতে হয়তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল মেয়েদের। অথবা নিজেদের বুদ্ধি এবং বিবেচনার দ্বারা তারা বুঝতে পেরেছিল যে, সমাজকে ও পুরুষতন্ত্রকে পেয়ে বসতে দিলে তা ক্রমশই মাথায় চড়ে বসবে। ফলে নিজের অধিকার ভিক্ষে করে নয়, অনুদান হিসেবেও নয় বরং লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে। 
আরও একটা জিনিস হয়েছিল, দিনে দিনে মেয়েরা লজ্জার বেড়া ডিঙিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। লোকলজ্জার ভয় যেই মুহূর্তে মেয়েদের গা থেকে খসে পড়ল, তখনই তারা নিজেদের অধিকারগুলো পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। আর মেয়েদের এই অধিকারের লড়াই শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিষয়ে বিভিন্ন আইন তৈরি হল। সেইসব আইনের সাহায্য নিয়ে মেয়েরা প্রগতির পথে ক্রমশ এগিয়ে যেতে শুরু করে। কেমন সেই নারী সুরক্ষা আইন? অনুরাধা বললেন, সমাজে মেয়েদের বিরুদ্ধে যত অত্যাচার হয়েছে ততই তা আটকানোর জন্য আইনও তৈরি হয়েছে। পারিবারিক হিংসা আইন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন বা সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন— এমন বহু আইন রয়েছে নারীর সুরক্ষায়। এই আইনগুলো কিন্তু বরাবর আমাদের সমাজে ছিল না। বরং নারীর সামাজিক উন্নতির প্রতীক হিসেবে এই আইনগুলো স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে ক্রমশ তৈরি হয়েছে। 
মেয়েদের মানসিকতার বদলের কারণেই এই আইনগুলো ক্রমশ তৈরি হয়। মেয়েরাও যে মানুষ, সেই ধারণা তারা নিজেরাই তৈরি করেছে। তাদের আচরণের দ্বারা নিজেদের অস্তিত্ব সমাজের চোখে     আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। এর ফলে শুধুই যে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন তৈরি হয়েছে বা সমাজের মনোভাব বদলেছে তা-ই নয়, নারীর সমগ্র অস্তিত্বই   উন্নত হয়েছে। যেমন পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার, একক মাতৃত্বের অধিকার— এগুলোও ক্রমশ আইন হয়ে উঠেছে এবং মেয়েদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নারীমনের আধুনিকতাই সমাজে মেয়েদের অবস্থান উন্নত করেছে। 
নারীর সচেতনতার প্রসঙ্গে শিক্ষার বড় ভূমিকার কথাও জানালেন অনুরাধা। তাঁর মতে, মেয়েরা যখন পড়াশোনা শিখেছে তখনই তাদের সচেতনতার পরিধিটা প্রসারিত হয়েছে। এবং তারা নিজেদের অধিকার পাওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে। শিক্ষার কারণে বিবেচনাও বেড়েছে। একটা বোধ তৈরি হয়েছে পারিপার্শ্বিক সমাজ সংক্রান্ত বিষয়ে। ফলে মেয়েরা বুঝতে শিখেছে যে পারিবারিক হিংসা আসলে তাদের লজ্জা নয়। বরং যে নির্যাতন করছে তার লজ্জা। অতএব সেই হিংসা সহ্য না করে বরং তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। শিক্ষাই মেয়েদের সচেতন করেছে। এবং সেই সচেতনতা থেকেই তারা অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেছে। 
মেয়েদের এই সচেতনতার পিছনে কি অর্থকরী স্বাধীনতা বা রোজগারের কোনও ভূমিকা আছে? অনুরাধা কিন্তু তা মনে করেন না। তাঁর মতে সচেতনতা একটা মানসিক স্থিতি। সেটা যে সবসময় রোজগার থেকে আসে তা নয়। স্বয়মে কাজ করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন স্তরের মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন। এবং সেই সূত্রে দেখেছেন সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মহিলাদের মধ্যেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস আছে। আবার তথাকথিত উচ্চবিত্তরা অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে সংকোচ বোধ করে লোকলজ্জার ভয়ে। ফলে কে যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, আর কে ভয়ে পিছিয়ে আসবে তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন। অনেক সময় পরিস্থিতিও মেয়েদের রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যায় 
যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন মেয়েরা আর চুপ করে থাকতে পারে না। প্রতিবাদে সরব হয়। 
সমগ্র নারী জাতি অবশ্যই অনেকটা এগিয়েছে। তবে এখনও পথ চলা অনেক     বাকি। স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও তাই নারী প্রকৃত অর্থে ‘স্বাধীন’ নয়। তবে আশার কথা এই যে, ‘মেয়েমানুষ’-এর খোলস ছেড়ে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পথে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে মেয়েরা। সচেতনতা ও চেতনার মাধ্যমে সমাজে   নিজেদের অস্তিত্ব তারা আরও উন্নত করবে এটাই আশা। ফলে  প্রগতি তাদের হাতের মুঠোয়।

14th     August,   2021
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ