বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মতুয়াদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিচ্ছে বিজেপি
গোপাল মিস্ত্রি

বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন হরিদাস। কারণ তিনি ছিলেন শ্রীহরিভক্ত। শ্রীচৈতন্য অনুরাগী, বৈষ্ণব ধর্মের আচার অনুসারী। তাই নিজের নামের সঙ্গে ‘দাস’ শব্দটি যুক্ত না থাকলেও বাবা যশোমন্ত (মতান্তরে যশোবন্ত) ঠাকুর পাঁচপুত্রের নামের শেষেই ‘দাস’ যুক্ত করেছিলেন। তাঁর পাঁচ পুত্রের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণদাস, হরিদাস, বৈষ্ণবদাস, গৌরীদাস এবং স্বরূপদাস। কিন্তু শিশুকাল থেকেই দুরন্ত মধ্যমপুত্র হরিদাস নিজেকে যে কারও ‘দাস’ বলে মানতে নারাজ। তাঁর কোনও হরিভক্তিও নেই। তাই তিনি ক্রমে ক্রমে নামের সঙ্গে যুক্ত ‘দাস’ শব্দটি চিরতরে মুছে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন হরিচাঁদ। কোনও হিন্দু দেবদেবীর পুজোআচ্চায় কোনওদিন তাঁর মতি ছিল না। শৈশব থেকেই তিনি বিদ্রোহী। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি ঘৃণা, জল-অচল (অর্থাৎ যার ছোঁয়া জল পান করা যায় না) বলে পদদলিত করা শৈশব থেকে হরিচাঁদের মনে বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল। যখন তাঁর আর চার ভাই বাবার মতোই বৈষ্ণবসেবায় নিয়োজিত প্রাণ, তখন বালক হরি বলতেন ‘বৈরাগীরা ভণ্ড।’ চার ভাইয়ের বাল্যখেলার অঙ্গ ছিল বৈষ্ণবসেবা, পূজা অর্চনা, নাম সংকীর্তন, অন্তরে হরিভক্তির প্লাবন, তখন বালক হরি রাখাল বেশে গোপালনে মত্ত। গোপালকদের কাছে রাখালরাজা। তিনি গোষ্ঠীপতি।
হ্যাঁ, তিনিই মতুয়া মতের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর, যিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধী। মতুয়া মতাবলম্বীরা নিজেদের বৈদিক হিন্দু ধর্মের বাইরে একটি পৃথক ধর্মের মানুষ বলে মনে করেন। যেমন বুদ্বদেবের বৌদ্ধ ধর্ম। মতুয়ারা মনে করেন, মতুয়া ধর্মও তেমনই স্বতন্ত্র। যদিও তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু দু’শো বছর আগে ‘ভেকধারী ভণ্ডদের’ বিরুদ্ধে আশৈশব বিদ্রোহী হরিচাঁদ সমাজের দলিত অন্ত্যজ শ্রেণির বিশেষত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের মনে যে একটি পৃথক ধর্মীয় ধারা বা চেতনার সৃষ্টি করেছিলেন, যার সঙ্গে বৈদিক হিন্দুধর্মের কোনও মিল নেই। মতুয়া ধর্মে কোনও সামাজিক বিভেদ, বর্ণ বৈষম্যের কথা বলে না, বলে মানবতার কথা, সাম্যবাদের কথা। যেখানে কোনও জাতপাতের বেড়া ঩নেই, উঁচু-নিচুর ভেদ নেই। কোনও গোঁড়ামি নেই। সবাই সমান। সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার ও অন্ত্যজ শ্রেণির উন্নয়নে হরিচাঁদ এবং তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য। আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় তাঁরা উপেক্ষিত থাকলেও বাংলার লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভক্তের মনে তাঁরা দেবতার আসনে বসে আছেন। মতুয়ারা বিশ্বাস করেন, হরিচাঁদ ঠাকুর স্বয়ং পূর্ণ ব্রহ্ম। তিনি কোনও অবতার নন—স্বয়ম্ভু। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনিই মতুয়াদের আরাধ্য দেবতা।
আভিধানিক না-হলেও ‘মতুয়া’ শব্দটির সঙ্গে আজ আর কেউ অপরিচিত নন। অন্তত গত এক দশক ধরে এদেশের রাজনৈতিক প্রবাহ যে বেগে ধাবিত হচ্ছে তাতে রাজনীতি-সচেতন সমস্ত ভারতবাসী এই শব্দটির সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। কারণ মতুয়া শুধু একটি ধর্মমত নয়, মতুয়ারা এখন রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে বিজেপির  বোড়ে হয়ে উঠেছে। 
মতুয়ারা তো রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বহুকাল ধরেই আছে। বলা ভালো, মতুয়া আন্দোলনের সূচনাই হয়েছে রাজনীতির হাত ধরে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি বিশ্বাস করতেন, কংগ্রেস হল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দল। তারা  কখনও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের শিক্ষার অধিকার বা সামাজিক মর্যাদা দেবে না। তাই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের স্বার্থে রাজশক্তি ইংরেজ শাসকদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। আবার পরবর্তীকালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের (যিনি পি আর ঠাকুর নামে পরিচিত) হাত ধরে মতুয়ারা হয়ে যায় কংগ্রেসের সমর্থক। পি আর ঠাকুর নিজেও কংগ্রেসের এমএলএ এবং মন্ত্রী ছিলেন। পরে কংগ্রেস ছেড়ে বাংলা কংগ্রেসের এমপিও হন তিনি। রাজ্যে বাম জমানার শুরু থেকেই বামপন্থার অনুকূলে মতুয়াদের একাংশ গা ভাসালেও কংগ্রেস ও বামপন্থায় বিভক্ত ছিল তারা। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে মতুয়াদের মধ্যে প্রভাব বাড়তে থাকে তাদের। তারাও ক্রমাগত নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মতুয়াদের মন জয় করে নেয়। কিন্তু এযাবৎকাল কোনও দলের কাছেই তারা স্রেফ ‘মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক’ বলে চিহ্নিত হয়নি। বরং উদ্বাস্তু নমঃশূদ্র, মতুয়া সব মিলিয়েই ভোটের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। সেই ভোটের রাজনীতিতে কখনও ধর্মকে গুলিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতির আন্দোলনই ছিল মুখ্য। 
আজ কিন্তু মতুয়ারা স্রেফ একটি ‘হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক’ হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে। ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ আর ‘হিন্দুত্ববাদী’ ইস্যুতে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মতুয়াদের একটা বিরাট অংশ বিজেপির অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছে। স্বয়ং পি আর ঠাকুর রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ি এবং মতুয়া মহাসঙ্ঘের কেউ আর সক্রিয় রাজনীতিতে যাবে না। অথচ ঠাকুরবাড়ির ভিতর থেকেই ভক্তদের টেনে আনা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাঙ্গণে। তার সঙ্গে আছে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির অলীক গাজর। ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে বিজেপি যে সুকৌশলে এদেশে যুগযুগ ধরে বসবাসরত মতুয়াদের ‘বিদেশি’ সাজিয়ে দিয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করেন না অন্ধ ভক্তরা। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময় থেকেই মতুয়াদের একটা বড় অংশ বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়েছে। 
কিন্তু যে মতুয়ারা কখনও হিন্দুত্ববাদী নয়, কখনও মুসলিম বিদ্বেষীও নয়, তারা কেন এমন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দলে নাম লেখাচ্ছে? আসলে মতুয়াভক্তদের আধ্যাত্মিক বা সামাজিক উন্নতি নয়, এর পিছনে যে মতুয়াকুলের সর্বেসর্বাদের ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার লোভ, তা বোঝেন না অন্ধবিশ্বাসী মতুয়াভক্তরা।
তাঁদের হয়তো আদতে জানাই নেই, হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করেই। অন্ত্যজ অস্পৃশ্যদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচর থেকে মুক্তি পেতে।  মতুয়াবাদের মূল কথাই হল, সব মানুষ সমান। বর্ণহিন্দু সমাজ তৎকালীন বাংলার নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছে আশৈশব তারই প্রতিবাদী ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। মতুয়াবাদে কোনও দেবদেবীর স্থান নেই। প্রকৃত মতুয়া মতাবলম্বীরা কোনও হিন্দু দেবদেবীতে বিশ্বাস করে না। কোনও হিন্দু আচার অনুষ্ঠান পালন করে না। মতুয়া ভক্তরা যে মন্দির গড়ে নিত্যপূজা করে সেখানে অধিষ্ঠান হরিচাঁদ ঠাকুর ও শান্তিমাতাদেবীর, থাকে গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রতিকৃতিও। মতুয়াদের কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, বিবাহ কিংবা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান যাই হোক না কেন, কোনও হিন্দু আচার যেমন পালন হয় না, তেমনই ব্রাহ্মণ পুরোহিতও থাকে না। সেখানে মতুয়া গোঁসা‌ই, পাগলরাই আচার অনুষ্ঠান করেন। মতুয়াদের যে বীজমন্ত্র ‘হরি বল’ পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে যা ‘হোব্বোল’ শব্দে ধ্বনিত হয় সেই হরি হিন্দু দেবতা শ্রীহরি নন। তিনিই স্বয়ম্ভু হরিচাঁদ ঠাকুর। মতুয়াদের কোনও মন্ত্র নেই। তাদের কোনও দীক্ষা নেই। কোনও গুরুপ্রথা ঩নেই। তাদের একমাত্র ঈশ্বর হরিচাঁদ ঠাকুর।
হরিচাঁদ নিজে লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া অন্ত্যজ এই সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। সেকালে হিন্দু সমাজের কোনও স্কুলে নমঃশূদ্র সমাজের সন্তানের পড়াশোনা করার অধিকার ছিল না। পুত্র গুরুচাঁদকে তাই ভর্তি করেছিলেন মুসলমানদের মক্তবে। গুরুচাঁদের প্রাথমিক পাঠটুকু নমঃশূদ্র ভক্তদের পাঠশালায় হলেও মুসলমান মক্তবেই তাঁর শিক্ষার ভিত মজবুত হয়। তিনি আরবি, ফারসি ভাষাও শিক্ষালাভ করেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের দেখাশোনা করতেন যে মহিলা, তিনি সাবানা বুড়ি। একজন মুসলিম বিধবা মহিলা। হরিচাঁদ ঠাকুরের বহু মুসলমান ভক্ত ছিলেন এবং আছেন। হরিচাঁদ চাইতেন, শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক। সে কাজ তিনি নিজে করে যেতে না পারলেও গুরুচাঁদ ঠাকুর অন্ত্যজদের জন্য শত শত স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বর্ণহিন্দু সমাজের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন।  
অথচ আজকের এই মতুয়া মতাবলম্বীদের মধ্যে কোনও স্বধর্মীয় আবেগ নেই, আছে অন্ধ রাজনীতির উল্লম্ফন। মতুয়া ভক্তরাও হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে। বিজেপিও সুকৌশলে ভুলিয়ে দিয়েছে মতুয়াদের আত্মপরিচয়। তাদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছে মুসলমান বিদ্বেষের বিষ। যে মতুয়ারা হরিচাঁদ ঠাকুর ছাড়া আর কারও পুজো করে না, বিজেপি তাদের বাধ্য করছে হিন্দুত্ববাদের পুজো করতে। সদ্য নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর যখন সংসদে দাঁড়িয়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের নামে শপথ নিতে চান, তাঁকে সেই নাম নিয়ে শপথ নিতে দেওয়া হয় না। শতাধিক বছরের ইতিহাসে অন্যকোনও রাজনৈতিক দল মতুয়াদের অস্মিতায় আঘাত করেনি, যা বিজেপি করছে। ধর্ম এবং বর্ণ নিরপেক্ষতা মতুয়াবাদের মূল কথা। মতুয়াদের সেই ধর্ম নিরপেক্ষতার আবরণটিকেও ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার কাজটি নিপুণভাবে করে চলেছে বিজেপি। আর এখন নাকের ডগায় সিএএ’র গাজর ঝুলিয়ে মতুয়াদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তারা এদেশেরই বৈধ নাগরিক। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে বিজেপির ছোট বড় সব নেতাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মতুয়ারা ‘বিদেশি’! কারণ সেই ভয়টি তাদের মনে গেঁথে দিতে পারলেই ‘মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক’ অটুট থাকবে। মতুয়ারা এখন শুধুই ‘ভোটব্যাঙ্ক’। সেটা ধরতেই প্রধানমন্ত্রী কখনও ওড়াকান্দি যান, কখনও ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়ি এসে নতজানু হন। 
ঠাকুরবাড়ির এক প্রবীণ ভক্ত গোঁসাই আক্ষেপ করে বলছিলেন, এত যে ‘মতুয়া মতুয়া’ করা হচ্ছে, ক’জন আছে প্রকৃত মতুয়া? এই অন্ধ রাজনীতি সব ভুলিয়ে দিয়েছে।

6th     May,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ