বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

আবার সেই ‘ইসলামোফোবিয়া’!
মৃণালকান্তি দাস

ভোটের মুখেই রাজস্থানে সংখ্যালঘু মোর্চার নেতা উসমান গণিকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিজেপি! উসমানের অপরাধ? একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মুসলিম সমাজের নাম করে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা কাম্য নয়।’ 
প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন? রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় এক জনসভায় মোদি বলেছিলেন, ‘আগে যখন কংগ্রেসের সরকার ছিল, তখন বলেছিল, দেশের সম্পত্তিতে প্রথম অধিকার মুসলিমদের। এর অর্থ ওরা সম্পত্তি এককাট্টা করে যারা বেশি সন্তানের জন্ম দেয়, যারা অনুপ্রবেশকারী, 
তাদের বিলি করবে।’ এখানেই থামেননি মোদিজি। উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে গিয়ে মোদিজি কংগ্রেস ও মুসলিমদের একাসনে বসিয়ে যা বলেছেন, তা বিস্ময়কর অসত্য হলেও লোক খ্যাপানোর জন্য যথেষ্ট। বলেছেন, ‘কংগ্রেসের নজর আপনার সম্পত্তির উপরে। ক্ষমতায় এলে এরা মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে।’ প্রধানমন্ত্রীর মুখে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেই দলীয় নেতাদের কোপে পড়েছেন উসমান গণি।
গত ২০ বছরে মোদিকে এতটা মরিয়া হতে দেখা যায়নি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, কেন উন্নয়ন, বিকাশ, গ্যারান্টির কথা ছেড়ে তিনি মেরুকরণের পথ বেছে নিয়েছেন। বিরোধীরা বলছেন, প্রথম দফার ভোটচিত্র দেখে মোদিজি হিন্দু ভোট এককাট্টা করার সেই পুরনো কৌশলে নেমে পড়েছেন। রাজনৈতিক মেরুকরণের উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে বিভীষিকা বর্তমান শাসকদলের বহু ব্যবহৃত হাতিয়ার, ভোটের বাজারে বেগতিক দেখে সেই গরলস্রোতই এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। আর এসব কথা মোদি স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে পারছেন নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন করে দিতে পেরেছেন বলে।
প্রথম দফা ভোটের পরই বিজেপি বুঝে গিয়েছে, আগেরবারের মতো মোদি-হাওয়া নেই। নেই পাঠানকোট-বালাকোটের মতো যুদ্ধ-যুদ্ধ গন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে আর মন দোলা দিচ্ছে না। একঘেয়েমি এসে গিয়েছে। তাদের নজরে ধরা পড়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভোটের লাইনে হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের আধিক্য বেশি। ফলে প্রশ্ন জাগছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী না হয়েও যাঁরা মোদিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা এবার কি ভোট দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করছেন। রাজনীতির পরিভাষায় এসব ‘ফ্লোটিং ভোটার’ই জয়ের মার্জিন বাড়ায়। তাঁরা মুখ ফেরালে জয় পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, আসলে মোদির ‘জুমলাবাজি’ (ভাঁওতা) মানুষ ধরে ফেলেছে। চাকরিবাকরির হাল শোচনীয়। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে। সাধারণের সুরাহার জন্য যাবতীয় প্রতিশ্রুতির একটাও পূরণ হয়নি। ফলে মোদির গ্যারান্টিতে মানুষ ভুলছে না। তাই ভোটের হার কমেছে। ‘চারশো পার’ স্লোগানও তাই অলীক কল্পনা। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোটের হার দেখেই বিরোধীরা মনে করছে, এটা হতে চলেছে মোদির বিরুদ্ধে অনাস্থাজ্ঞাপনের ভোট।
শুধু নরেন্দ্র মোদি-ই নন, একই কথা শোনা গিয়েছে জেপি নাড্ডার ভাষণেও। মুম্বইয়ে ভোট প্রচারে গিয়ে বিজেপি সভাপতি বলেছেন, কংগ্রেস এবং তাদের ‘ইন্ডি’ (‘ইন্ডিয়া) জোটের গোপন উদ্দেশ্য হল তফসিলি জাতি-জনজাতি (এসসি-এসটি) এবং অন্যান্য অনগ্রসরদের (ওবিসি) অধিকার কেড়ে নিয়ে তা মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া। ওঁদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনই তো বলেছিলেন, দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার মুসলিমদের। তারা ‘ঘুসপেটিয়া’, অর্থাৎ অবৈধভাবে এ দেশে এসেছে, মানে অনুপ্রবেশকারী। আর বিদ্বেষের এই আবহে সম্ভলের বিজেপি প্রার্থীর সমর্থনে আয়োজিত এক জনসভায় আদিত্যনাথ বলেছেন, ‘এই নির্লজ্জ কংগ্রেসের লক্ষ্য হল, গোহত্যা করে সংখ্যালঘুদের মাংস খাওয়ায় অধিকার দেওয়া।’ এটা আজ স্পষ্ট, কেন্দ্রের শাসকদল সংখ্যালঘুকে পায়ের নীচে সদাসন্ত্রস্ত করে রাখতে চায়, এবং সেই লক্ষ্য যখন মোটের উপর পূর্ণ হয়ে এসেছে, তখন সংখ্যালঘুর জুজু দেখিয়ে ক্রমাগত সংখ্যাগুরু ভোট এক জায়গায় আনতে চায়। সেই অভিযানের ‘সেনাপতি’-র আচরণে বিস্ময়ের কিছু নেই! বিপুল জয় সম্পর্কে বিজেপি যে সংশয়ী ও নার্ভাস, সম্ভবত এটা তারই লক্ষণ। ভোটারদের অনাগ্রহ কাটিয়ে পরের পর্বগুলিতে হাওয়া তুলতে তাই ‘মুসলিম জুজু’ হাতিয়ার।
দেশবাসী জানে, বিজেপির এই কৌশল নতুন কিছু নয়। সেই ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির প্রথম ভোটপ্রচার এ দেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের আবহ ছড়িয়ে দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল নিজেকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ বানানোর কৌশল। সেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দলের প্রধান মুখ নির্বাচনী প্রচারে নেমে 
সরাসরি মুসলিমদের নাম করে, তাঁদের সম্পর্কে বিদ্বেষের তির ছুড়েছিলেন। প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিমদের 
বংশবৃদ্ধি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা সেই বারই প্রথম। গুজরাতের হিংসার পরে মুসলিমদের ত্রাণ শিবিরকে তিনি ‘সন্তান উৎপাদনের কারখানা’ বলে তকমা দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে এসে সেই মোদি ফের মুসলিমদের সম্পর্কে একই কথা শোনাচ্ছেন। 
সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই প্রচার করে এসেছে যে, মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একদিন হিন্দুদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। মোদি মুসলিমদের সম্পর্কে সেই আতঙ্ক ও বিদ্বেষ বা ‘ইসলামোফোবিয়া’-কে সামনে এনেই ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চাইছেন। কারণ, তিনি এই মেরুকরণের সুফল আগেও পেয়েছেন। তা সে রাজ্যের ভোটে হোক বা লোকসভা ভোটে। তিনিও জানেন, ভারতের রাজনীতিতে নির্বাচন আর সাম্প্রদায়িকতা আজ হাত ধরাধরি করে চলে। জানেন, গত দশ বছরে তাঁর এমন একটি নিজস্ব 
ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে, যাঁরা সব ভুলে মুসলিম-বিদ্বেষকে ইন্ধন করেই ভোট দিতে পারেন। আর তাই ২০ মার্চ 
কেরলের পালাক্কাডে মোদিজির রোড শোয়ে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি মাল্লপুরম আসনের নিজের দলের প্রার্থী আবদুল সালামকে-ও। সালাম এবার দেশের একমাত্র বিজেপি মুসলিম প্রার্থী।
‘ধর্মের নামে কোথায় পৌঁছেছি আমরা?’ প্রশ্ন তুলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি কে এম জোসেফ ও হৃষিকেশ রায়ের বেঞ্চ। উত্তরটি জানা। ধর্মের নামে ভারত পৌঁছেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রের দোরগোড়ায়, যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্র ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অদ্বৈতে। ভারতের যে কোনও রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই, এই দেশ যে সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হতে দায়বদ্ধ, জনমানস থেকে এই কথাটি কার্যত মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। ফলে বিজেপির নেতা প্রকাশ্যেই মুসলিম ব্যবসায়ীদের গলা কাটার কথা বলেও পার পেয়ে যান। সমাজমাধ্যমে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুত্ববাদী নেতার বিদ্বেষভাষণ। গুলি করে মারার উস্কানি দিয়েও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেতার গুরুত্ব বাড়তে পারে। ভারত আজ সেখানে পৌঁছেছে, যেখানে 
গো-সন্ত্রাসকে নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হয়। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পর প্রশাসনিক বুলডোজার মুসলিমদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিলেও সমাজের চোখে তা অস্বাভাবিক ঠেকে না। ধর্মের নামে ভারত সেখানে পৌঁছেছে, যেখানে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের কারামুক্তিতে সাগ্রহ সম্মতি জানায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এই গৈরিক আধিপত্যের ভারতে আজ এ কথা প্রতিষ্ঠিত, রাষ্ট্রক্ষমতার চোখে মুসলিমরা নিতান্তই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক— সাভারকর, গোলওয়ালকরদের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই ভোটও তার বাইরে বেরতে পারল না।
লক্ষ্য করুন, ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে যথাক্রমে সাত আর ছ’জন মুসলিম প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছিল বিজেপি। সবাই যে হারবে বিজেপি তা জানতও। ফলে দেশের ১৬ এবং ১৭তম লোকসভায় শাসকদলে একজনও মুসলিম ছিলেন না। রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মুসলিম। মুক্তার আব্বাস নাকভি, এম জে আকবর, সৈয়দ জাফর ইসলাম। তিনজনেরই মেয়াদ ফুরিয়েছে। একজনকেও আর রাজ্যসভায় ফেরত পাঠানো হয়নি। আপাতত শাসকদলের সাংসদদের মধ্যে কোনও 
মুসলিম নেই। অথচ, দেশের মুসলিম জনসংখ্যা কমবেশি ১৮ শতাংশ। এর অর্থ একটাই, তোমরা এখানে থাকো। কিন্তু ক্ষমতার ভাগ চেয়ো না। তোমরা নাগরিক নও— দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোর খেলাটাই চলছে দেশজুড়ে। আরএসএস–বিজেপির লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র। যেখানে সংখ্যালঘু মুসলিম, ক্রিস্টানরা নাগরিক নয়, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটির (সিএসডিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, চরিত্রগত ভাবেই গোবলয়ের উদ্ধত হিন্দুত্বগন্ধী। ফলে মুসলিমদের ১০ শতাংশ ভোটও বিজেপি পায় না। যতই তারা পসমন্দাদের (নিম্নবর্গের মুসলিম) মন পাওয়ার চেষ্টা করুক, তা সময়ের বৃথা অপচয়। ভোটের লাইনে মুসলিমদের প্রবল উপস্থিতি যদি এমনই থাকে এবং হিন্দুদের উৎসাহে জোয়ার না আসে, তা হলে বিপদ অনিবার্য। তাই হিন্দুত্বের জাগরণে হিন্দুদের মনে ভয় সঞ্চার করতেই হবে। মোদি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, রামমন্দির তৈরির ইস্যু ‘বাসি’ হয়ে গিয়েছে। বিরোধী প্রচারে রোটি-কাপড়া-মাকানের সঙ্গে বিজলি-সড়ক-পানি যেমন প্রাধান্য পাচ্ছে, তেমনই উঠে আসছে বেকারত্বের জ্বালা, মূল্যবৃদ্ধির কোপ, দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং এক শতাংশ ধনী মানুষের আরও ধনী হওয়ার কাহিনি। এই বোঝার উপর শাকের আঁটি নির্বাচনী বন্ড। এগুলোর একটার জবাবও তাঁর কাছে নেই। যা আছে, তা শুধুই ধর্মীয় মেরুকরণ। আর তাই ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনের গরম হাওয়ায় মাছ, মাটন, মুসলিমের পর মোদি আরও একটা ‘ম’ যোগ করেছেন— মঙ্গলসূত্র!
এই ধর্মীয় মেরুকরণই লাগামছাড়া বেকারত্ব আর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির যুগে মোদির একমাত্র রক্ষাকবচ!

1st     May,   2024
 
 
অক্ষয় তৃতীয়া ১৪৩১
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ