বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

অর্থ পরে, আগে আস্থা ফেরান মোদি
হারাধন চৌধুরী

পূর্ববর্তী দুটি লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন। এবার তাঁর প্রচারের ক্যাচলাইন ‘গ্যারান্টি’। কখনও কখনও তিনি শুধু ‘গ্যারান্টি’তেই থেমে নেই, ‘গ্যারান্টিরও গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন! পুরো শরীরী ভাষা উজাড় করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছেন, ‘আজ পুরা হিন্দুস্থান জানতা হ্যায়, দুনিয়া ভি মানতা হ্যায়, মোদি কি গ্যারান্টি মতলব গ্যারান্টি পুরা হোনে কি গ্যারান্টি!’ ঢাকের বোল পাল্টে ফেলার কারণ আজ আর গোপন নেই। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জেনে গিয়েছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়ে কথা রাখেননি। মানে তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। তাঁর মতো সম্মাননীয় ব্যক্তি ‘মিথ্যে’ বলেছেন বলাটা নাকি শিষ্টাচারসম্মত নয়, তাই বলতে হচ্ছে—তিনি বারবার ‘অসত্য’ বলেছেন। একই শাস্ত্রবাক্য মেনে বলতে হচ্ছে—মানুষ ‘প্রতারিত’ বোধ করছে, তিনি ‘প্রতারণা’ করেছেন বলা হচ্ছে না। 
বছরে দু’কোটি চাকরি এবং প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমার প্রতিশ্রুতির গায়ে শ্যাওলা জমে গিয়েছে। ওই নোংরা আর ঘাঁটেন না মোদি। এবার বাংলার মানুষের কাছে তাঁর গ্যারান্টি, তিন হাজার কোটি টাকা ফেরাবেন। নিয়োগসহ বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে নেমে ইডি ওই বিপুল টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। সংশ্লিষ্ট মামলাগুলিতে যাঁরা প্রতারণার শিকার টাকাগুলি তাঁদেরই ফেরাতে চান প্রধানমন্ত্রী। এজন্য তাঁর সরকার আইনি পরামর্শ নিচ্ছে বলেও তাঁর দাবি। বলিহারি, মোদির প্রতিশ্রুতি (থুড়ি, গ্যারান্টির গ্যারান্টি)!  
মোদি সরকার ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানে বাজার মাত করে চলেছে। স্লোগানটি থেকে ভোটের ফায়দা তুলতে অতিতৎপর এখন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক। আর এই আবহেই ৬ এপ্রিলের কাগজে পড়া গেল এক মেধাবী ছাত্রীর মর্মান্তিক কাহিনি। গণধর্ষিতা হওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় বসতে দেয়নি তার স্কুল! ঘটনাটি মোদির সাধের ডাবল ইঞ্জিনে চলা রাজস্থানের আজমিরের। সিদ্ধান্তের সপক্ষে স্কুল কর্তৃপক্ষের সাফাই, বেশিরভাগ অভিভাবক মেয়েটির স্কুলে আসা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। তাই তাকে বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ‘পরামর্শ’ দেয় তারা। মেয়েটিও মেনে নিয়েছিল স্কুলের ফতোয়া। অতঃপর বোর্ডের পরীক্ষা চলে এলে তাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, সে আর তার স্কুলের পড়ুয়া নেই। টানা চারমাস অনুপস্থিতির কারণেই তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে! এমন জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কী শাস্তি হল, এখনও জানা যায়নি। উল্লেখ্য, দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় মেয়েটি ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। সুখের কথা এই যে, সমস্যাটি গোচরে আসার পর মেধাবী ছাত্রীটির শিক্ষাজীবন বাঁচাতে তার পাশে দাঁড়িয়েছে শিশুকল্যাণ কমিশন।  
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দশবছর ধরে ট্রেলার দেখিয়েছেন। এবার ভোট দিলে পুরো এবং আসল সিনেমাটি দেখাবেন তিনি! কিন্তু ট্রেলার দেখিয়েই কি মানুষকে যথেষ্ট ক্লান্ত, বিরক্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেওয়া হয়নি? এরপর মানুষ পুরো সিনেমা 
দেখতে চাইবে কোন আনন্দে ও কীসের ভরসায়? বরং যে দীর্ঘ অমূল্য সময়টা নষ্ট হয়েছে তাঁর চক্করে পড়ে, তার জন্য আপশোস হচ্ছে অনেক, কিন্তু হারানো দিনগুলি ফেরত পাওয়া আর সম্ভব নয়। মানুষের হাতে এখন এটুকুই আছে যে, ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করবে না।   
ঢের হয়েছে, টাকার লোভ আর দেখাবেন না মোদি। মানুষ আর টাকা বা অর্থ চায় না। মানুষ এই আস্থা ফেরত পেতে চায় যে—সিবিআই, ইডি, এনআইএ, এসএফআইও’র মতো তদন্তকারী এজেন্সিগুলি তাদের সাংবিধানিক সত্তা মেনেই কাজ করে। তাদের স্বশাসন কেউ কেড়ে নিতে পারেনি, তারা শাসক দলের আজ্ঞাবহ দাসমাত্র নয়। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি কখনও রাজ্য ভিত্তিক তদন্তকারী সংস্থাগুলির শত্রু তো নয়ই, এমনকী প্রতিযোগীও নয়, বরং সহযোগী সংস্থা। তারা সমন্বয় রেখে 
কাজ না করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় অসম্ভব। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে মুড়ি মুড়কির মতোই! কিন্তু দীর্ঘ 
অপেক্ষার শেষে দেশজুড়ে হতাশার সঙ্গে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, এজেন্সগুলি সময়মতো চার্জশিটই পেশ করতে পারছে না কোর্টে। ফলে অনেক প্রকৃত অপরাধীও বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছে দিনের 
শেষে। বিচারকে এইভাবে প্রহসনে পরিণত করার দায় তবে কার?   
মানুষ এই ভরসা দাবি করে যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই), নীতি আয়োগ, ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস (এনএসএসও), আয়কর (আইটি) দপ্তর, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রভৃতির উপর বাইরে থেকে কেউ 
ছড়ি ঘোরায় না। অথচ সরকারের দোষত্রুটি বা ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উপর্যুক্ত সংস্থাগুলিকে ব্যবহারের অভিযোগ সামনে এসেছে একাধিকবার। এই নীতি কোন ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে লড়তে 
সক্ষম, এই প্রশ্ন উঠবেই। 
কাম্য পরিস্থিত এটাই যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে না সরকার বা বিরোধী কোনও পক্ষই। আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা হয় না কিংবা বিচারপতি বা বিচার বিভাগের মুণ্ডপাত করা হয় না রায় বিরুদ্ধে গেলেও। আমরা লক্ষ করি, বিচার বিভাগের এই স্বাধীন 
এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রাখতে ওই প্রতিষ্ঠানকে নিরন্তর লড়াই করে যেতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে স্বয়ং দেশের প্রধান বিচারপতিই বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলিকে একথা মনে করিয়ে দিতে। শুধু সরকারকেই নয়, বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত সকলকেও (বিচারপতি, আইনজীবীসহ) সতর্ক করে দিচ্ছেন তিনি।  
মানুষ এই আস্থা চায় যে, রাজভবনগুলি কেন্দ্রীয় শাসক দলের পার্টি অফিসের মতো আচরণ করবে না। রাজভবনের শীর্ষকর্তাটি স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং সুষ্ঠুভাবে রাজ্য সরকার পরিচালনার সহায়ক হিসেবে কাজ করবেন। রাজ্যের মানুষের অভাব অভিযোগ বঞ্চনার দিকগুলি তিনি নিয়মিত দিল্লির কর্তাদের গোচরে আনবেন এবং তাঁরই মাধ্যমে দ্রুত সুরাহার ব্যবস্থা হবে। রাজ্য সরকারকে বাগড়া দেওয়া কিংবা রাজ্যের শাসক দলকে ‘ম্যালাইন’ করা রাজ্যপালের দায়িত্ব কর্তব্য নয়। তিনি এইভাবে কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজনৈতিক লাভালাভ বৃদ্ধির ব্রত পালন করলে রাজ্যের মানুষ তাঁকে ‘অবাঞ্ছিত’ ভাবতেই পারে। প্রশ্নও উঠবে, রাজ্যের মানুষের টাকায় রাজভবন নামক শ্বেতহস্তীশালাগুলি রাখার কী প্রয়োজন?
সবশেষে বলতে হয়, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কথা। কমিশনের কাছে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাই কাম্য। কিন্তু ইতিমধ্যেই দেশের কোনও কোনও জায়গা থেকে—’মোদির কমিশন’ গোছের তির্যক মন্তব্যও কানে আসছে! ভোটগ্রহণের আগেই, একটি মানুষেরও মনে এমন অনাস্থার সঞ্চার কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক। নির্বাচন কমিশনের উপর মোদির পার্টি কোনওরকম প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে না, এই আস্থাটা এই মুহূর্তে ভীষণ জরুরি। গণতন্ত্র এবং সংবিধান আমাদের বহু সাধনার ধন। এই দুটি অক্ষত রাখার গুরুদায়িত্ব এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের উপরেই ন্যস্ত।     
মানুষের আস্থা অর্জনে মন দিন নরেন্দ্র মোদি। তবে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা ফেরানো বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। আপনার সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এই সরকার আস্থা ফেরানোর জায়গায় আর নেই। আস্থা ফেরাবার শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ সাধনায় আপনার পার্টিকেই মন দিতে হবে এখন।

10th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ