বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বিপন্ন সাংবিধানিক নৈতিকতা
পি চিদম্বরম

দুর্নীতির অভিযোগে একজন কর্তব্যরত মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার একইসঙ্গে আইনি, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক সমস্যা। এটা আরও এমন একটা বিষয় যা সংবিধানের লিখিত বয়ানবহির্ভূত এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে সাংবিধানিক নৈতিকতার দিক। 
তথাকথিত ‘তথ্য’-এর দিকটা পরিষ্কার করে বলতে চাই। মামলাগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছ যে, তাঁরা ‘ঘুষ’ নিয়েছেন এবং তা নেওয়া হয়েছে ঘুষ দাতা বা দাতাদের অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই মুহূর্তে এটুকুই বলা যেতে পারে যে, ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ এবং তা ‘অপরাধ উদ্ঘাটন’-এর সমান নয়। মান্য আইনি নীতি এই যে, ‘দোষী প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকেই নির্দোষ বলে মনে করা হয়।’
নির্দোষ, এই অনুমানের আইনি দিক ধরেই শুরু করা যাক। একজন ব্যক্তি একটা রাজনৈতিক দলের সদস্য। সেই রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেন তার প্রার্থীরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দল একজন ব্যক্তিকে আইনসভায় তাদের নেতা নির্বাচিত করে। রাজ্যপাল সেই ব্যক্তিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান। অতঃপর, মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীরা কার্যভার গ্রহণ করেন। কাজ শুরু করে একটি নতুন সরকার। এটা একটা চেনা চিত্রনাট্য। গত ৭৫ বছরে এইমতোই নাটক অভিনীত হয়েছে শত শত বার। এই চিত্রনাট্য ‘ওয়েস্টমিনস্টার প্রিন্সিপল’ (এটা রাজনৈতিক দিক) এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা (এটা সাংবিধানিক দিক) মেনে রচিত।
মুখ্যমন্ত্রীকে অপসারণ
এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য একজন মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাধীন ব্যক্তি হতে হবে। তিনি অবশ্যই রাজ্যপালকে পরামর্শ দেবেন। তাঁকে অবশ্যই মন্ত্রিসভার বৈঠক করতে হবে। মানুষের মতামত ও অভিযোগ অবশ্যই শুনতে হবে তাঁকে। তাঁকে অবশ্যই বিধানসভায় কথা বলতে হবে এবং অন্যদের বক্তব্য শুনতে হবে। বিধানসভায় যেসব প্রস্তাব এবং বিল উত্থাপিত হয় তার উপর তাঁকে অবশ্যই ভোট দিতে হবে। সর্বোপরি, যেহেতু আমাদের সরকারি ব্যবস্থাদি রেকর্ড বা ফাইলের উপর ভিত্তি করে চলে, তাই সবকিছুই হতে হবে লিখিত এবং সই-স্বাক্ষর সংবলিত। যে-ব্যক্তি স্বাধীন নন, তাঁর পক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর কাজ ও দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। 
একজন মুখ্যমন্ত্রীকে পরাজিত করার এবং অপসারণের অনেক উপায় রয়েছে। একজন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে হারাবার উপায় হল নির্বাচন। পাঁচ বছরে একবার কিংবা তারও আগে এমন নির্বাচনগুলি অনুষ্ঠিত হয়। আর সংসদীয় উপায় হল বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব (মোশান অব নো কনফিডেন্স) পাস করা অথবা অর্থ বিল কিংবা পলিসি সংক্রান্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ ‘মোশান’ প্রত্যাখ্যাত হওয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠরা জয়ী হবে উভয় ক্ষেত্রেই। মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, রাজনৈতিক দলগুলি এর পাশাপাশি একাধিক অসৎ উপায়ও আবিষ্কার করেছে। ‘অপারেশন লোটাস’ হল এমনই একটি আবিষ্কার। এই কৌশলে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বিধায়ককে ক্ষমতাসীন পার্টি থেকে পদত্যাগ বা অন্য দলে যোগদানে প্ররোচিত করা হয়। তার ফলে বিধানসভায় বেচারা শাসক দল হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু! দলত্যাগ, দশম তফসিলের অধীনে আইনসভার একজন সদস্যের ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতা’ খোয়ানোর শামিল। তা সত্ত্বেও, পরিণামের তোয়াক্কা না করে দশম তফসিল লঙ্ঘন করা হয়েছে।
সরকারকে অস্থির করে তোলা
মুখ্যমন্ত্রীকে অপসারণের অন্যকোনও উপায় আছে কি? আমি তো আর অন্য উপায় খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু এই ক্ষেত্রে চতুর নারী-পুরুষের অবশ্য অভাব নেই। একজন মুখ্যমন্ত্রীর স্বাধীনতাহরণের ‘দৃশ্যত আইনি’ একটা উপায় তাঁরা আবিষ্কার করেছেন। যে মুখ্যমন্ত্রী টার্গেট, তাঁর বিরুদ্ধে একটি এফআইআর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) কিংবা ইসিআইআর (এনফোর্সমেন্ট কেস ইনফরমেশন রিপোর্ট) রুজু করবেন ওই চতুর ব্যক্তিরা। অতঃপর ওই অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব এবং গ্রেপ্তার করা হবে। সিবিআই কিছুটা সতর্ক, কিন্তু ইডির লাজলজ্জার বালাই নেই। একজন মুখ্যমন্ত্রী একবার গ্রেপ্তার হলেই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে কিছু লোক সোচ্চার হয় অথবা সংশ্লিষ্ট রাজ্যপালের ক্ষমতা প্রয়োগে তাঁকে বরখাস্তের জন্য হল্লা জুড়ে দেয়। যুক্তি দেওয়া হয় যে মুখ্যমন্ত্রীকে অন্য অভিযুক্তদের মতো অবশ্যই আদালতে হাজিরাসহ জামিনের আবেদন করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিসি হেফাজত কিবা বিচার বিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া দরকার। তেমন আদেশের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীকেও আদালতে আপিল করতে হবে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জামিন মঞ্জুর বা খারিজ হতে পারে। তবে একজন অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীকেও এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার চাইতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারটি নড়বড়ে হয়ে যায়। খুঁড়িয়ে চলাকালে, এমন একট‍া সরকারের দ্রুত পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বন্দি মুখ্যমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত কোনও অন্তর্বর্তী নেতাকেও গ্রেপ্তারের হুমকি তাড়া করে বেড়ায়। মুখ্যমন্ত্রীর মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটির জন্য পরের পর বিকল্প নেতার জোগান দেওয়া কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। দুর্নীতির অভিযোগের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য হল, একজন মুখ্যমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করা, সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য সেটা হাসিল হয়ে যায়।
এসব আপাতদৃষ্টিতে আইনসিদ্ধ। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই জিনিস অসম্মানজক ও আপত্তিকর হতে পারে। সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ রয়ে যায়। কিন্তু আমার প্রশ্নটি একটি বৃহত্তর দিক থেকে। যে-দেশ সরকার পরিচালনার জন্য ওয়েস্টমিনস্টার মডেল গ্রহণ করেছে, সেখানে একজন কর্তব্যরত মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তার ও আটক কি সাংবিধানিক নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আজকের দিনের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা কি সংবিধান মুছে ফেলা সম্ভব?
সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা
কিছু দেশ বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই, বশংবদ তদন্তকারী সংস্থা এবং জামিনের প্রশ্নে আদালতগুলোর পরস্পর-বিরোধী রায়ের গুরুতর বিপদ উপলব্ধি করেছে। এজন্য তারা কর্তব্যরত রাষ্ট্রপতি বা সরকারের শীর্ষকর্তার ‘ইমিউনিটি’র জন্য একটা ধারা যোগ 
করে রেখেছে। ভারতে বিচারপতিদের ব্যাপারে 
সুপ্রিম কোর্টের একটা রায় রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দেশের প্রধান বিচারপতি বা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির আগাম সম্মতি ছাড়া কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনওরকমের তদন্ত শুরু করা যাবে না। বলার অপেক্ষা থাকে না যে, এটার 
নিহিতার্থ হল বিচারপতিদের জন্য ‘ইমিউনিটি’রই বন্দোবস্ত করা হয়েছে। 
মুখ্যমন্ত্রীদের ধরপাকড়ের এই ব্যাপারটা উল্টে গেলে কী হতো? ধরুন, একটা রাজ্য সরকার তার আঞ্চলিক এক্তিয়ারের মধ্যে একটি অপরাধের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল এবং গ্রেপ্তারও করা হল তাঁকে! এরপর বিচারক নিয়মানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে পুলিসি কিংবা বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠালেন! এর পরিণতি ভয়াবহ এবং বিপর্যয়কর হতে বাধ্য।
কোনও ‘ইমিউনিটি’র ধারা নেই। তাই আদালতগুলোর এই অনুমান করা উচিত নয় কি—একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন মুখ্যমন্ত্রীর উপর যথাক্রমে লোকসভা ও বিধানসভার যতক্ষণ আস্থা (সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন) রয়েছে, ততক্ষণ ঊহ্য রয়েছে তাঁকে গ্রেপ্তার না-করারও ইমিউনিটি? এটা একটা বাস্তব সমস্যা। এর উত্তরের উপরেই নির্ভর করবে, সংসদীয় গণতন্ত্রের ওয়েস্টমিনস্টার নীতিগুলো টিকে থাকবে কি না, এবং জয় হবে কি না ভারতে সাংবিধানিক নৈতিকতার।  
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

8th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ