বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

চান্দা দো ধান্দা লো!
মৃণালকান্তি দাস

হেটেরো দেশের অন্যতম বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা। অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ প্রস্তুতের কাজে হায়দরাবাদের এই কোম্পানি বিশ্বেরও বৃহত্তম ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা। মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই বিখ্যাত কোম্পানির বিরুদ্ধে ছ’টি নোটিস জারি করেছিল। কেন জানেন? নিম্নমানের ওষুধের জন্য। এর মধ্যে তিনটি নোটিস রেমডেসিভির সম্পর্কিত। করোনার চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির (কোভিফোর) বাজারে এনেছিল হেটেরো। ফলে সেই সময় হেটেরোর ব্যবসা বেড়েছিল হু হু করে। মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরীক্ষায় রেমডেসিভির নমুনায় পরিষ্কার তরলের পরিবর্তে হলুদ রঙের তরল পাওয়া গিয়েছিল। এই সংক্রান্ত একটি নোটিস ২০২১ সালের জুলাই মাসে হেটেরোর হাতে ধরানো হয়েছিল। দ্বিতীয় নমুনায় ওষুধের মাপ প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কম ছিল এবং সেই বছরের অক্টোবরেই একটি নোটিস জারি হয়। রেমডেসিভিরের তৃতীয় নমুনায় দেখা যায়, ওষুধটির গুণমান খুবই খারাপ। তাই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আরও একটি নোটিস জারি করা হয়েছিল। ২০২১ সালে হেটেরোর আরও দু’টি নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া যায়। একটি অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ ইটবর ক্যাপসুল এবং মনোসেফ— যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন যুগ্ম ড্রাগস কমিশনার ওমপ্রকাশ সাধোয়ানির কথায়, এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি কোম্পানির লাইসেন্স স্থগিত হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, প্রশাসনের তরফে হেটেরোর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর সংস্থাটিও চুপিচুপি ওই নিম্নমানের ওষুধের ব্যাচটি বাজার থেকে তুলে নিয়ে যাবতীয় অভিযোগ ধামাচাপা দেয়। ততদিনে অবশ্য ওই ওষুধ চলে গিয়েছে বহু ঘরে। প্রশ্ন হল, এত বড় অভিযোগের পরও হেটেরো ছাড় পেল কী করে? উত্তর মেলে ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর। দেখা যায়, হেটেরো কোম্পানির দুই শাখা— হেটেরো ল্যাবস এবং হেটেরো হেলথ কেয়ার ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৯ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ১০ কোটি এবং ওই বছরই অক্টোবরে ১১ কোটি টাকার বন্ড কেনে। মোট ৬০ কোটি টাকার বন্ড। কে না জানে, এই ধরনের কোনও সংস্থাই এত বিপুল টাকা গণতন্ত্রের সেবা কিংবা দেশের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দলকে দান করে না। তার পিছনে থাকে গভীর অভিসন্ধি!
দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যখন ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে নোটিস দিয়েছে, সেই বছরই তারা কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। নির্বাচনী বন্ড ব্যবহার করে নিজেদের মুনাফার মার্জিন সুনিশ্চিত করেছে দেশের বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি। তথ্য অনুযায়ী, প্রথম সারিতে থাকা ৩৫টি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ৭৯৯.৬৬ কোটি টাকা মূল্যের নির্বাচনী বন্ড কিনেছে এবং জমা দিয়েছে। বন্ড কিনে নিশ্চিন্ত ওষুধ কোম্পানিগুলি। আর ফার্মা বন্ডের হাফেরও বেশি ঢুকেছে বিজেপির ফান্ডে। চান্দা দো ধান্দা লো!
ধরুন টরেন্ট ফার্মার কথাই। গুজরাতের এই কোম্পানির অ্যান্টিপ্লেটলেট ওষুধ ডিপ্লাট-১৫০ স্যালিসিলিক অ্যাসিড পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল এবং ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একে নিম্নমানের ঘোষণা করে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টরেন্ট ফার্মার রক্তচাপ কমানোর ওষুধ লোসার এইচ-কে গুজরাত ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে। সেই বছরই অক্টোবরে, আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গুণমানে ব্যর্থতার জন্য সংস্থাটিকে সতর্কও করে। তবে গুজরাত সরকার সেই ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, এই কোম্পানির আরও একটি ওষুধ নিকোরান এলভি (হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়) মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত লোপামাইড ওষুধটিও পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় এবং একে নিম্নমানের ঘোষণা করা হয়। এই টরেন্ট ফার্মা ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৭.৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। গুজরাতের আরও একটি কোম্পানি জাইডাস। ২০২১ সালে বিহারের ওষুধ নিয়ন্ত্রক গুজরাতের এই কোম্পানির তৈরি রেমডেসিভির ওষুধের একটি ব্যাচকে নিম্নমানের ঘোষণা করে। ওই ওষুধের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এন্ডোটক্সিনের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। অনেক রোগীর মধ্যে এই ওষুধের প্রতিক্রিয়াও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু গুজরাতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক আরও পরীক্ষার জন্য এই ব্যাচগুলির নমুনা সংগ্রহ করেনি এবং জাইডাসের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপও করেনি। কারণ? জাইডাস হেলথকেয়ার ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৯ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে।
সম্প্রতি এসবিআই বন্ডের আলফা-নিউমেরিক মেমো নম্বর সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন সেই তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে দিয়ে দিয়েছে। তা থেকেই জানা গিয়েছে, কোন কোম্পানি কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকার অনুদান দিয়েছে গত ক’বছরে। দেখা গিয়েছে, সবচেয়ে লাভবান হয়েছে কেন্দ্রের শাসকদলই। ফার্মা বন্ডের ৩৭টির মধ্যে কমপক্ষে ২৯টি কোম্পানির থেকে মোট ৪৬৮.৪৫ কোটি পেয়েছে বিজেপি। এরপরেই রয়েছে টিআরএস। ১৩টি কোম্পানির (অধিকাংশই দক্ষিণ ভারতীয়) থেকে তারা মোট ২৪১.৪ কোটি টাকার বন্ড অনুদান পেয়েছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস। ২১টি কোম্পানি থেকে তারা ১৫৩.৯ কোটি টাকা পেয়েছে। বন্ড কেনা অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানির ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, একটি নাম কমন— বিজেপি। গেরুয়া শিবির সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে হেটেরো বায়োফার্মা (৫০ কোটি), টরেন্ট ফার্মা (৪৫ কোটি) ও অরবিন্দ ফার্মা (৩৪.৫ কোটি)-র থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহল এই বন্ডের বিনিময়ে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের বক্তব্য, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে লাগাতার যে খরচ বেড়ে চলেছে, তার পিছনে রয়েছে ওষুধের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি। অথচ, আইন থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগে অনীহা রয়েছে মোদি সরকারের। প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতাল গোষ্ঠী এবং ওষুধ কোম্পানিগুলির থেকে বন্ডের চাঁদা পেতেই কি আলগা হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ?
ওষুধ কোম্পানি ‘সিপলা’র নাম কে না জানে। 
সেই সিপলা ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের 
মধ্যে চারটি শো-কজ নোটিস পেয়েছিল। ২০১৮ সালের আগস্টে ধরা পড়ে সিপলার আরসি কাশির সিরাপের গুণমান খারাপ। পরের বছর ১৪ কোটি টাকার বন্ড কেনে সিপলা। ২০২১ সালের জুলাই মাসে সিপলা রেমডেসিভির ওষুধ, সিপ্রেমির জন্য দু’বার নোটিস পেয়েছে। হেটেরোর মতো, সিপ্রেমিতেও প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে কম রেমডেসিভির পাওয়া গিয়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে ২৫.২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল সিপলা। তথ্য বলছে, ২০১৯ সাল থেকে সিপলা ৩৯.২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। কীসের স্বার্থে?
‘গ্লেনমার্ক’ ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্নমানের ওষুধের জন্য পাঁচটি নোটিস পেয়েছিল। এর মধ্যে চারটি মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জারি করেছিল। গ্লেনমার্কের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ ‘টেলমা’ নিম্নমানের বলে চিহ্নিত হয়। গ্লেনমার্কের জনপ্রিয় এই ওষুধটির দামই গত এক বছরে ১৮-২০ শতাংশ বেড়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিটি ২০২২ সালের নভেম্বরে ৯.৭৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আইপিসিএ ল্যাবরেটারিজ লিমিটেডের অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ লারিয়াগোতে প্রয়োজনীয় ক্লোরোকুইন ফসফেট নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম ছিল এবং ওষুধটিও নিম্নমানের বলে চিহ্নিত করা হয়। আর এই সংস্থাই ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৩.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। ২০২০ সালে এনাপ্রিল-ফাইভ ট্যাবলেটের গুণমান পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল ইনটাস ফার্মাসিউটিক্যাল। এই কোম্পানি ২০২২ সালের অক্টোবরে ২০ কোটির বন্ড কিনেছিল। শুনলে অবাক হবেন, দেশের বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মাও ৩১.৫ কোটি টাকা মূল্যের ৩৬টি বন্ড কিনেছে। কোম্পানির নামে নয়, নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৬ কোটি টাকার বন্ড কিনেছেন বায়োকন প্রধান কিরণ মজুমদার শ’। আরও এক বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ডক্টর রেড্ডি’জ ল্যাবরেটরি, যারা বন্ড কিনেছে ৮৪ কোটি টাকার। এমন তালিকা দীর্ঘ...! অভিযোগ, যারা কোটি কোটি টাকা রাজনৈতিক দলে বিনিয়োগ করছে, তারা তো আর দানছত্র খুলে বসেনি। মুনাফা করার আশাতেই দিয়েছে। যেমন ধরুন, ব্লাড সুগার কন্ট্রোলে রাখতে গ্যালভাস খেতে হয় ভারতের কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীকে। নোভারটিস ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার তৈরি এই ওষুধের দাম সাম্প্রতিক সময় কত বেড়েছে জানেন? ২০-২৫ শতাংশ। দেশবাসীর অভিজ্ঞতা, গত কয়েক বছরে লাগামছাড়া হারে বৃদ্ধি পেয়েছে জীবনদায়ী সহ সমস্ত ওষুধের দাম। গ্যাস অম্বলের ওষুধ প্যান ফরটির দাম ৭.৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৪ টাকা, রক্তচাপ হার্টের জন্যও ব্যবহার হয় টেসলা। তার দাম ৭ টাকা থেকে ১০ টাকা। অম্বলের ওষুধ ওমেজের দাম ৪ টাকা থেকে ৬.৪০। সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে চিকিৎসার খরচ। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে কি দাম বৃদ্ধির সঙ্গে দলীয় তহবিলে চাঁদা দেওয়ার কোনও সংযোগ রয়েছে?
আসলে নির্বাচনী বন্ডের আড়ালে রয়েছে দুর্নীতির বীজ! এই রোগ ছড়ানোর দায় তো মোদি সরকারেরই!

4th     April,   2024
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ