বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সরকারের পক্ষে জোরদার তালির বন্দোবস্ত হয়েছে
পি চিদম্বরম

আইপিএল ২০২৩-এর সেরা পাঁচ বোলারের মধ্যে চারজন স্পিনার—রশিদ খান, ওয়াই চাহাল, পীযূষ চাওলা এবং বরুণ চক্রবর্তী। একজন সাধারণ মানুষকে ব্যাপারটা অবাকই করেছে, কারণ তিনি জানেন যে, টি-টোয়েন্টি খেলাটি এমন দাপুটে ব্যাটসম্যানদের কথা মাথায় রেখেই সাজানো, যাঁরা স্পিন বোলারদের পিটিয়ে মাঠছাড়া করে দিতে মরিয়া।
সম্ভবত আইপিএলের অনুকরণ করছে আজকের বিজেপি। (এই প্রসঙ্গে ‘স্পিন ডক্টরস’ নামে নতুন একটি কথার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। যাঁরা মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে শতমুখে স্তুতি করেন ও সাফাই গেয়ে থাকেন, তাঁদের ‘স্পিন ডক্টরস’ বলা হয়।) তাই তাদের সরকার এবং তাদের দ্বারা শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘স্পিন ডক্টরস’-এর মারাত্মক কদর। বিজেপির এই পদক্ষেপের সর্বশেষ প্রাপ্তি এই যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) এবং তাদের অর্থনীতিবিদরা সরকারের সুবিধামতো বোলিং করে চলেছেন। আর এরকমই এক ব্যবস্থাক্রমে (মেড-ইন-হেভেন অপারচুনিটি)  গত ১৯ মে আরবিআই ঘোষণা করে দিল যে, ২০০০ টাকার নোট তারা বাজার থেকে তুলে নেবে। সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের তরফে যুক্তি সাজানো হল যে, এটা ‘বিমুদ্রাকরণ’ বা নোট বাতিলের মতো বড় কোনও ব্যাপার নয়। মনে করে দেখুন, ২০১৬ সালেও কিন্তু ‘ডিমানিটাইজেশন’ বা ‘নোট বাতিল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি; এই বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি এবং সার্কুলারগুলিতে এবারের মতোই ‘উইথড্রল’ বা ‘প্রত্যাহার’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছিল। 
আমাদের মন ছুটে গিয়েছে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের দিকে। সেদিন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় টেলিভিশনে নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট আর বৈধ নয়! এক ধাক্কায়, প্রচলিত নোটের ৮৬ শতাংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তার পরিণতিতে সৃষ্টি হয় বিরাট বিশৃঙ্খলা। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা মনে করে আজ আর কোনও লাভ নেই।
যুক্তিকে অস্বীকার
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর, দু’হাজারি নোট চালু করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও সরকার ঘাপটি মেরে ছিল। ‘স্পিন ডক্টরস’ সিদ্ধান্তটিকে ‘রিমানিটাইজেশন’ আখ্যা দেন। লোকজন প্রথমে একটি নতুন শব্দ শিখলেন ‘ডিমানিটাইজেশন’। তারপর আরও একটি নতুন শব্দ শেখা হল—‘রিমানিটাইজেশন’। দুইয়ে মিলে মানুষের মনটা উড়ে গেল। সরকার কেন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করল এবং একইসঙ্গে চালু করল ২০০০ টাকার নোট? কেন পুরনো নোটগুলির জায়গায় একই মূল্যের কিন্তু ভিন্ন রং, আকার ও কিছু নতুন বৈশিষ্ট্যসহ নতুন নোট চালু করা গেল না? বিমুদ্রাকরণের তিনটি ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল: জাল নোটের মূলোৎপাটন, কালো টাকা উদ্ধার এবং জাল নোটের মাধ্যমে মাদক পাচার ও সন্ত্রাসবাদে আর্থিক মদত রোখা। এই তিনটি ক্ষেত্রের পরীক্ষায় ২০০০ টাকার নোট যে ডাহা ফেল! আরও দেখা গেল, কালোবাজারি, মাদক পাচারকারী এবং সন্ত্রাসবাদীরা ২০০০ টাকার নোটকে সানন্দে স্বাগত জানাল। কারণ? তাদের অপকর্মগুলিকে যে এই নোট উল্টে সহজ করে দিল!
সরকারের নিশ্চয়তা আছে, তবু মানুষ ধারাবাহিকভাবে ২০০০ টাকার নোটের প্রতি বিমুখ হয়েছে। ‘বিনিময়ের মাধ্যম’ হিসেবে এই নোট ছিল একেবারেই অকেজো। দোকানদার এবং পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যে খুব কম ব্যক্তিকেই পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা ২০০০ টাকার নোট নিতে চান। চালু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মানুষের দৈনন্দিন বা রুটিন লেনদেন থেকে ২০০০ টাকার নোট কার্যত হাওয়া হয়ে গেল! তবুও আরবিআই ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২০০০ টাকার নোট মুদ্রণ এবং বণ্টন অব্যাহত রেখেছিল। এখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, ২০০০ টাকার নোটের অধিকাংশই ব্যাঙ্কের কারেন্সি চেস্ট বা ভল্টে পড়ে আছে। বাকিটা, সাধারণভাবে নগদ অর্থ ব্যবহারে অভ্যস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে ছিল না, সেগুলি ছিল খুব সামান্য কিছু ব্যক্তির হাতে। ২০০০ টাকার নোট যে কেন চালু করা হয়েছিল, তার কোন যুক্তিপূর্ণ জবাব এখনও মেলেনি। 
কেন ২০২৩ সালে প্রত্যাহার?
অযৌক্তিক ২০০০ টাকার নোট, পরবর্তী যুক্তিসংগত প্রশ্নটিকেও অস্বীকার করে: এটা ২০২৩ সালে প্রত্যাহার করা হল কেন? ব্যাঙ্কগুলিকে লেখা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চিঠি বলে যে, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে তাৎক্ষণিকভাবে যে মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা ছিল তার জন্যই’ ২০০০ টাকার নোটটি চালু করা হয়েছিল এবং এটি তার উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল! দৈনন্দিন ব্যবহারের পক্ষে একেবারে ফালতু ২০০০ টাকার নোটের ‘প্রয়োজন’ ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে ছিলই না। তাঁরা ছোট অঙ্কের নোট এবং নোটবন্দির পর অনিবার্যভাবে ছাপা নতুন ৫০০ টাকার নোট দিয়েই তাঁদের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। 
মানুষ যখন এই ধরনের নোট প্রত্যাখ্যান করলেন তখনও কেন বহু কোটি টাকার ২০০০ টাকার নোট ছাপানো হল? কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। আরবিআই আরও যুক্তি দিল যে, ২০০০ টাকার নোটের ‘শেলফ-লাইফ’ বা আয়ু মাত্র চার-পাঁচ বছর। সেটা বাস্তব হলে, ছোট অর্থাঙ্কের নোটের (১০, ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার) আয়ু অবশ্যই কম হবে। সময়ে-অবসরে নতুন নোট ছাড়ার মাধ্যমে সেগুলি যেমন বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়, তেমনই ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়া যেত ২০০০ টাকার নোটগুলি। গল্পের ‘স্পিন’ যত বেশি হয়, ততই নিজেদের মিথ্যার জালে আটকা পড়ে যান ‘স্পিন ডক্টরস’। আর এই ঘটনাক্রমে ভারতীয় মুদ্রার প্রতি বিশ্বাস কমে গিয়েছে। 
আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারে (আইএমএফ) ভারতের তরফে মনোনীত এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর কে ভি সুব্রামনিয়ানের সবচেয়ে অবাক করা ব্যাখ্যা এইরকম: প্রথমে কালো টাকার কারবারিদের হিসাববহির্ভূত অর্থ ২০০০ টাকার নোটে লুকনোর জন্য প্রলোভন দেখানো এবং সাতবছর পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই কালো টাকা উদ্ধার বা বাজেয়াপ্ত করতেই এই কৌশল নেওয়া হয়! ডক্টরসের খাওয়ানো সবচেয়ে উদ্ভট এই গল্পের জন্য ‘ইগ-নোবেল প্রাইজ’ দেওয়া উচিত। হয়তো বিজ্ঞানের কল্পকাহিনির লেখক হিসেবে সুব্রামনিয়ানের এই সাংঘাতিক অনুভবটি হয়ে থাকবে। 
মজুতদারদের জন্য লাল কার্পেট
দুর্ভাগ্যবশত, কে ভি সুব্রামনিয়ান তাঁর ‘অনন্য’ তত্ত্বটি উপস্থাপন করার আগেই স্টেট ব্যাঙ্ক (এসবিআই) ঘোষণা করে দিয়েছে যে, পরিচয়ের প্রমাণপত্র ছাড়াই, কোনও ফর্ম পূরণ না-করেই এবং উৎসের প্রমাণ পেশ ছাড়াই যেকোনও ব্যক্তি ২০০০ টাকার নোট পাল্টে নিতে পারেন! অনেক ব্যাঙ্ক এই নিয়মই অনুসরণ করেছে।
পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, ২০১৬ সালে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটের ৯৯.৩ শতাংশই ফেরত এসেছিল, ২০০০ টাকার যেসব নোট সার্কুলেশনে আছে তার প্রায় প্রতিটিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ফেরত আসবে। স্পিন ডক্টরস-এর মাথা যিনি, গল্পটিকে তিনি এইভাবে ঘুরিয়ে দেবেন যে, সাত বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সর্বশক্তিমান ভারত সরকার দেশের সমস্ত কালো টাকা সাফল্যের সঙ্গে উদ্ধার করেছে এবং অবসান ঘটিয়েছে দুর্নীতির। আরও বলা হবে যে, মাদক কারবারি, সন্ত্রাসবাদী এবং তাদের টাকার জোগানদারাও একেবারে জব্দ হয়ে গিয়েছে! 
স্পিন ডক্টরস লালা ঝরাচ্ছে এবং শহরে তাদের কারবারের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করার জন্য পরবর্তী কোনও দুর্দান্ত সুযোগের অপেক্ষা করছে।
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

29th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ