বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদি সরকারের তুঘলকি কাণ্ড!
হিমাংশু সিংহ

আবার ধোঁকা, আবার সস্তা চমক। সৌজন্যে বিজেপি সরকার। এবার মাত্র ৬ বছর আগে ছাপানো মোদি জমানারই অসামান্য কীর্তি নতুন ২ হাজার টাকার নোট বাতিল করল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বলে দিল, ওই নোটের নাকি বয়স হয়েছে, মেয়াদ শেষ। তাই সার্কুলেশন থেকেই তুলে নেওয়া হচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর আর ব্যাঙ্কে তা জমা দেওয়া যাবে না। কিন্তু কেন এই ফরমান? উত্তরে বলা হয়েছে, এটি নাকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘ক্লিন নোট পলিসি’র অঙ্গ। সবিনয়ে বলি, বাজারে দশ টাকা থেকে একশো, দুশো, পাঁচশো টাকার নোট যে চলছে তার বয়স কত? গুনে দেখেছে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। জ্ঞানবাপীর শিবলিঙ্গের মতো তার ‘কার্বন ডেটিং’ হবে! কেমন ময়লা তাপ্পি মারা নোট চলছে বাজারে তার হিসেব আছে সরকারের কাছে? তাহলে এই সেদিনের ২ হাজার টাকার নোটের উপরই শুধু সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কেন? জবাবটা খুবই সহজ। সমীক্ষা বলছে, আগের বার নোটবাতিলে কালোটাকার রমরমা তো কমেইনি বরং লাফিয়ে বেড়েছে। সরকার শুধু পরিকল্পনাতেই ব্যর্থ হয়নি নতুন করে অপরাধেরও জন্ম দিয়েছে। নতুন নোটে যেহেতু জায়গা কম লাগে তাই কালা ধান্দার কারবারিরা নগদ মজুত করার কাজে মোদি জমানার ২ হাজার টাকার নোটকে পাখির চোখ করেছে। সিবিআই, ইডির অভিযানে দেখা গিয়েছে, যত বেহিসেবি টাকা উদ্ধার হচ্ছে তার ৯৯ শতাংশই ২ হাজার টাকায়। অর্থাৎ পরোক্ষে কালা ধান্দাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে মোদি জমানার এই ‘অতুলনীয় কীর্তি’। আমাদের দেশে গড় মানুষের যা আয় তাতে ২ হাজার টাকার নোট চালু করাই ছিল অবাস্তব পরিকল্পনা। আম আদমির বদলে অসাধু ব্যবসায়ীরাই এতে উপকৃত হয়েছে। আর এখন যখন ব্যবসায়ীরা প্রায় সব টাকা সরিয়ে ফেলেছে, তখন ধোঁকা দিয়ে সাধু সাজার নতুন চেষ্টা শুরু হল। যেটুকু পড়ে আছে তা অগত্যা গরিব কর্মচারীদের জনধন অ্যাকাউন্ট মারফত সাদা করার প্রাণপণ চেষ্টা চলবে আগামী কয়েক মাস। এবং সরকার তা অসহায়ের মতো দেখবে। প্রমাণ হবে গরিবের জনধন আসলে আমির লোকেদের টাকা ঘোরানোর (লন্ডারিং) নিরাপদ মাধ্যম মাত্র!
গণতন্ত্রে ভোট বড় বালাই। যখন গোটা সরকার মোদিজির ৯ বছরের সাফল্যের চোখ ধাঁধানো মার্কেটিংয়ে ব্যস্ত, হাজার হাজার কোটি ব্যয়ে নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধনের বর্ণময় প্রস্তুতি চলছে তখনই এই নতুন চমক দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল? কর্ণাটকের ভরাডুবি থেকে চোখ ঘোরাতে? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেই বলেছে, বাজারে যে পরিমাণ বড় অঙ্কের ওই নোট ছাড়া হয়েছিল তার মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখন পড়ে আছে। বাকিটা আগেই ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হয়েছে। সোজা কথায় কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচের ফসল এখন শীর্ষ ব্যাঙ্কের গুদামে বন্দি। আগামী কয়েক মাসে সেই গুদামের বহর আরও বাড়তে চলেছে। তবে এবার আর তুঘলকি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এলেন না। উল্টে তিনি জাপান পাড়ি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করল। আগেকার দিনে রাজারা যত শক্তিশালী হতেন ততই খামখেয়ালিপনা বেড়ে যেত। মৃগয়ায় বেরতেন, শিকার করে উল্লাসে মাততেন। আর এখন দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রে নির্বাচিত সরকার স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবে গেলে সাধারণকে জব্দ করার নিত্যনতুন ফিকির খোঁজে। কাজের চেয়ে অকাজ হয় বেশি। ষোলো সালের নভেম্বরে সবাই ভেবেছিল প্রধানমন্ত্রী আমাদের কত শক্তিশালী দেখেছ, ম্যাজিক করে দেশের প্রধান নোটটাকেই বদলে দিলেন! ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে সেই রাতেই লম্বা লাইন। মৃত্যু, আত্মহত্যা। বিড়ম্বনার একশেষ। আজ সাত বছর পর বুকে হাত দিয়ে বলুন তো—কালো টাকা, বেআইনি নগদের লেনদেন কি কমেছে? উল্টে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ছাপানো নতুন ২০০০ টাকার নোটের আজ স্থান হতে চলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মহাফেজখানায়। এটাকে শত কোটি ডলারের ধাপ্পা বলা কি অন্যায়! 
৯ বছর পর বোঝা যাচ্ছে, শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর সংজ্ঞাটাই ভেক! ২০১৪ সালের শুরুতে লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রশ্নটাই করা হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। ততদিনে তাঁকে ‘দুর্বল ও দুর্নীতিপরায়ণ’ আখ্যা দিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সতীর্থরা। উত্তরে মনমোহন সেদিন পাল্টা বলেন, শক্তিশালী বলতে আপনারা কী বোঝাতে চান? আমেদাবাদের রাস্তায় গণহত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার নাম কি শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক? ওই আলাপচারিতার শেষেই মনমোহন বলেছিলেন, মিডিয়া তাঁর প্রতি এখন সদয় না-হলেও ইতিহাস একদিন ঠিকই তাঁর মূল্যায়ন করবে। আজ প্রায় এক দশক পেরিয়ে মানুষের সমস্যাগুলি যখন সেই তিমিরেই তখন অসুস্থ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি বড় নির্মম হয়ে বাজছে। ওই সাংবাদিক সম্মেলনের পর কেন্দ্রে পালাবদল হয়েছে। দু’টো ফুল টার্ম শেষ করে আবার একটা লোকসভা নির্বাচনের প্রহর গুনছে দেশ। ইউপিএ’র মতো জোট সরকার নয়, কোয়ালিশন সংস্কৃতিকে বিদায় দিয়ে একদলীয় সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার বিরল সুযোগ পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু দেশজুড়ে বিভাজনের আগুন আর খামখেয়ালিপনার বাইরে কী পেয়েছে মানুষ, এই প্রশ্ন তোলা কি অন্যায়।
ভারতের মতো এমন সুবিশাল দেশ শাসনের খতিয়ানে এক দশক বড় কম সময় নয়। বিশেষত ৫৬ ইঞ্চি কিংবা তার চেয়েও প্রশস্ত বুকের ছাতির কেউ যখন ক্ষমতায়। দুর্বলের মাঝে প্রকাণ্ড শক্তিশালী আলাদিন, এই পরিচয়েই নরেন্দ্র মোদির আত্মপ্রকাশ জাতীয় রাজনীতিতে। ভাবটা এমন, যেন তাঁর নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় পড়শি শত্রু রাষ্ট্র বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাঁর লৌহকঠিন ব্যক্তিত্ব রকেট গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে অর্থনীতিকে। বেকারের দুঃসহ আত্মদংশন দূর হবে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ব্যবসা সহজ ও সরল হবে। প্রত্যেকের মাথার উপর ছাদ হবে। নারীর অধিকার স্বীকৃতি পাবে। উন্নয়নের সেই কাঙ্ক্ষিত অভিযাত্রায় শামিল হবে সবাই। সেই আশাতেই চোদ্দো সালে ২৮২ ও তারপর ২০১৯ সালে তাঁকে ৩০৩ আসন উপহার দেন জনগণ। কিন্তু ৯ বছর পরে এসে সেই লক্ষ্য আদৌ অর্জন কি সম্ভব হয়েছে, নাকি বিকাশের আড়ালে শুধুই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চলছে, যার ভাগফল স্রেফ শূন্য। পাকিস্তানে গুটিকতক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, এনআরসির জুজু, রামমন্দির উদ্বোধনের ঘোষণা এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের আড়ালে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার এজেন্ডাই যদি সবকা বিকাশের মূল প্রতিপাদ্য হয় তবে আলাদা কথা, কিন্তু এটা সত্যি, মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা ও সঙ্কটের ইতরবিশেষ হয়নি। বরং মসজিদ দেখলেই সেখানে শিবলিঙ্গ খুঁজে পাওয়ার ‘কুনাট্য’ সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে! 
আবার লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়েও কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়নি। রাজ্যে রাজ্যে চমক লাগানো রোজগার মেলা হচ্ছে, মন্ত্রী-সান্ত্রীরা হাতে হাতে নিয়োগপত্রও তুলে দিচ্ছেন, কিন্তু বেকার কমছে না। শুধু সরকারি ক্ষেত্রেই ৯ লক্ষেরও বেশি শূন্যপদ। সরকারি কাজেও ঢালাও চুক্তিতে নিয়োগ গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি চাকরি এখন দুষ্প্রাপ্য অলীক কল্পনায় পরিণত হয়েছে। নিট ফল একটাই ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেকার দেশে। এটাই কি কাঙ্ক্ষিত ছিল?
এলআইসির শেয়ার বিক্রিও মোদি সরকারের নিঃসন্দেহে বড় সিদ্ধান্ত। ২১ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে। সরকার ৯০০ টাকার আশপাশে ওই শেয়ার বেচেছে। আর একবছর পর সেই শেয়ার দর কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭০ টাকা। দর পড়েছে ৪০ শতাংশ। এলআইসি যে ২১ হাজার কোটি তুলেছে তা সবটাই কি ঢালা হয়েছে আদানির ব্যবসায়, এই প্রশ্ন মোটেই অসঙ্গত নয়। হিসেব বলছে, ভারতীয় স্টেটব্যাঙ্ক ও এলআইসি মিলিয়ে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে আদানির ব্যবসায়। এনিয়ে বারে বারে প্রশ্ন উঠবেই। এবং অস্বস্তি হলেও দেশের মানুষকে তার উত্তর দিতে হবে। 
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে সারকারিয়া কমিশনের কথা আমাদের সবার জানা। কিন্তু গত এক দশকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অভিমুখটাই ঘুরে গিয়েছে ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্বের দিকে। কেন্দ্র ও রাজ্যে 
একই দলের সরকার থাকলে তবেই হাতে লাড্ডু, এই তত্ত্ব কি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ?  মনে হয় না। সংবিধানের দর্শনের বিরুদ্ধে গিয়ে এই নতুন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা কার্যত যাবতীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করারই নামান্তর। আর সেই কারণেই 
ইদানীং দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্র, ফেডারেল কাঠামো পদে পদে বিপন্ন। একসময় ইন্দিরা গান্ধী কথায় কথায় 
৩৫৬ জারি করে রাজ্যের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিতেন। নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রী বদলও ছিল সেই জমানায় জলভাত। এস আর বোম্মাই রায়ের পর দেশে ৩৫৬ দূর কল্পনায় পরিণত। কিন্তু তার বদলে 
জারি হয়েছে এজেন্সি শাসন। দিল্লির উপ মুখ্যমন্ত্রী জেলে। এ রাজ্যেও মন্ত্রী-নেতারা গারদে। কিন্তু ব্যাপমের মতো কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরও মধ্যপ্রদেশে কি খুব তৎপর ইডি, সিবিআই। কেন? ডাবল ইঞ্জিনের লাড্ডুর মহিমায়?
আসলে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হওয়ার আশা জাগিয়ে ক্ষমতায় এসে আজ তিনিই কার্যত ভক্ষকের ভূমিকায়।  শুধু সরকারে নয়, নিজের দলেও। ৯ বছরের কিস্‌সা এইটাই। দল, সরকার দুই একনায়কতন্ত্র ও খামখেয়ালিপনার আবর্তে। ফলে দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করছে দেশের মানুষ। পরবর্তী তুঘলকি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ত্রস্ত সবাই।

21st     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ