বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

উন্নয়নের মোড়কে নাম খোদাইয়ের সর্বনাশা রাজনীতি
হারাধন চৌধুরী

২০১৩ সালের ১৬ জুন। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে তছনছ হয়ে গিয়েছিল কেদারনাথ ধামসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই বিপর্যয়ে পাঁচ হাজারের বেশি নরনারীর প্রাণ যায়। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিপুল পরিমাণে। আপার হিমালয়ান রি‌঩জিয়নের মধ্যে হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সত্যিই দুর্গম। তবু সেখানে অবস্থিত চারটি হিন্দুতীর্থ (বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী) এবং একটি শিখতীর্থে (হেমকুণ্ড সাহিব) প্রতিবছর বহু পুণ্যকামী মানুষ যান। অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ। ধস এবং প্রবল বৃষ্টির বিপর্যয়ও অতীতে হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ১৮৯৩, ১৯৬৮ এবং ১৯৭০ সালে বিরাট বিপর্যয়ের কবলে পড়েছিল অঞ্চলটি। তবে পরিবেশবিদরা মনে করেন, ২০১৩ সালের বিপর্যয় মোটেই প্রাকৃতিক নয়, বরং ‘ম্যান মেড’। অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ নির্মাণ, মাইনিং এবং স্রেফ মুনাফাকামী পর্যটনে ইন্ধনই ছিল ওই ঘটনার নেপথ্যে। পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সরকার উৎসাহ বোধ করে। তাই নির্বিচারে তৈরি হয় রাস্তা, হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এসবই হচ্ছে পাহাড়, অরণ্য মিলিয়ে অপরূপা সুন্দরী প্রকৃতির শবের উপরেই। সোজা কথায়, একদল অর্ধশিক্ষিত এবং আত্মঘাতী সংস্কৃতির ধারকবাহক মানুষের হাতে ইকো সিস্টেমটাই সেখানে প্রতিনিয়ত বরবাদ হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গেই চিপকো আন্দোলনের স্মৃতি ফিরে আসে। ১৯৭৩ সাল। হিমালয় অঞ্চলের অরণ্য বাঁচাতে মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। গান্ধীবাদী সুন্দরীলাল বহুগুণার নেতৃত্বে সংগঠিত সেই অহিংস আন্দোলন উত্তরকালে বিশ্বব্যাপী পরিবেশকর্মীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। বহির্ভারত শিক্ষা নিলেও তা নেয়নি গান্ধী বা সুন্দরীলালের নিজের দেশ।  
প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার আগেই, ২০১৩-র বিপর্যয়ের সময়েই নরেন্দ্র মোদি সিদ্ধান্ত নেন যে, জীবনে একবার সুযোগ পেলে উত্তরাখণ্ডের বিখ্যাত চারধাম তীর্থযাত্রীদের কাছে অবশ্যগন্তব্য করে তুলবেন। পরিবেশবিদরা মনে করেন, পরিবেশ ও পৃথিবীর প্রতি মমত্ব থাকলে তিনি বরং সেখানকার পরিবেশের পবিত্রতা ফেরানোর উপরেই গুরুত্ব আরোপ করতেন। মোদি প্রধানমন্ত্রী হন ২০১৪ সালে, উপর্যুক্ত বিষাদের ঘটনার একবছরের মাথায় সুযোগ উপস্থিত হল। কিন্তু উত্তরাখণ্ড তখন কংগ্রেসের দখলে। ২০১২ সালে বিজেপির ভুবনচন্দ্র খান্ডুরিকে হটিয়ে তারা কুর্সি দখল করেছে। কিন্তু সরকার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণাকে সরিয়ে হরিশ রাওয়াতকে বসিয়েছে কংগ্রেস। বিজেপির সঙ্গে টক্করে পেরে উঠছেন না তিনিও।
অবশেষে উপস্থিত হল চতুর্থ বিধানসভা নির্বাচন—১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। পরিবর্তনের ডাক দিলেন মোদি স্বয়ং। ঠিক ওই ভোটের মুখে ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন চারধাম পরিযোজনা বা চারধাম হাইওয়ে প্রজেক্ট। ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে চার লেনের প্রায় ন’শো কিমি সড়ক নির্মাণ করা হবে। সেগুলির মাধ্যমে একটি ট্যুরিস্ট সার্কিটে স্থাপিত হবে চারধাম। এই উদ্দেশ্যে হৃষীকেশ ও রুদ্রপ্রয়াগের মধ্যে তৈরি হবে ১৪০ কিমি দীর্ঘ হাইওয়ে। তারপর রুদ্রপ্রয়াগ ও মানাকে জুড়তে নির্মাণ করা হবে আরও ১৬০ কিমি সড়ক। অন্যদিকে, রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৭৬ কিমি সড়ক তৈরি হবে গৌরীকুণ্ড অব্দি। এ গেল একটি দিক। অপরদিকে, হৃষীকেশ থেকে ধারাসু যাবে আর একটি সড়ক, যার দৈর্ঘ্য 
১৪৪ কিমি। এরপর ধারাসু থেকে দুটি রাস্তা বেরিয়ে যাবে গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রী পর্যন্ত। ওই রাজপথ 
দুটি হবে যথাক্রমে ১২৪ ও ৯৫ কিমি দীর্ঘ। টনকপুরের সঙ্গে পিথোরাগড়কে জুড়তে তৈরি হবে ১৪৮ 
কিমি রাস্তা। এই প্রকল্পে আরও তৈরি হবে ১৩২টি সেতু, যেগুলির মধ্যে ২৫টি অত্যন্ত বড় মাপের। 
চার জায়গায় ভায়াডাক্ট বা খিলানযুক্ত সেতুও তৈরি হবে। ওইসঙ্গে থাকবে প্রায় চার হাজার কালভার্ট। হবে দুটি বৃহৎ টানেল, ১৩টি বাইপাস, ১৫টি ফ্লাইওভার, ১৮টি প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সেন্টার ইত্যাদি। পাহাড় ও নদীর ধসের সম্ভাব্য বিপদের কথাও বিবেচনায় রয়েছে বলে সরকারের দাবি।
‘সব মরশুমে সমান ব্যবহার্য’ এই সড়ক প্রকল্পের সূচনা করে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ‘বিভাগীয় মন্ত্রী নীতিন গাদকারি সংশ্লিষ্ট বিদেশি সংস্থাগুলিরও পরামর্শ নিয়েছেন। তারা আশ্বস্ত করেছে, প্রকল্পটি অন্তত একশো বছর অক্ষত থাকবে। এটি সফল হওয়ার পর চারটি পবিত্র তীর্থ কোনও শিশুর কাছেও আর দুর্গম মনে হবে না। শতবর্ষ পরেও মানুষ বাহবা দেবে। বহু মানুষ তাঁদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে চারধাম দর্শন করাতে চান, কিন্তু দুর্গমতার জন্যই তা সবসময় সম্ভব হয় না। প্রকল্পটি হওয়ার পর কেউ কি এই দেবভূমি স্পর্শ না করে থাকতে পারবেন?’ 
আমরা দেখলাম, সারা দেশ, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদীরা মোদির নামে ধন্য ধন্য করে উঠল। টাটকা ফল পেল বিজেপি। উত্তরাখণ্ডের রাজপাটে শুধু পরিবর্তনই এল না, ৭০ সদস্যের বিধানসভায় একলাফে ২৬টি আসন বাড়িয়ে নিল গেরুয়া শিবির। বিজেপির নামের পাশে লেখা হল ৫৭, পূর্ববর্তী বিধানসভায় তারা ছিল ৩১ আর কংগ্রেস ৩২। ভোটের শতাংশ হারেও বৃদ্ধি হল চমকপ্রদ—১৩.৩৭ শতাংশ। মোদির কোনও খেলার লক্ষ্য সামান্য একটি হয় না। ব্যতিক্রম হয়নি এক্ষেত্রেও। চারধাম উন্নয়নের ডিভিডেন্ড তিনি নিয়েছেন দু’বছর পরবর্তী (২০১৯) লোকসভা নির্বাচনেও।
এখানেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন: তীর্থের মাহাত্ম্য আর নিছক ভ্রমণের আনন্দ কি এক দাঁড়িপাল্লায় রাখছেন তিনি? হিমালয়ে পরিকাঠামো নির্মাণে 
কি চীনের সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মোদির ভারত? চীন যেভাবে হিমালয়ের 
বারোটা বাজাচ্ছে আমরা কি তারই অন্ধ অনুকরণে উল্লসিত হতে থাকব?
জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির উত্থান এবং তৎপরবর্তী খতিয়ান এটাই স্পষ্ট করে যে, তিনি উন্নয়নের মোড়কে চমকেই আস্থা রাখেন বেশি। যেমন ভারতকে স্বচ্ছ বানাবার অছিলায় নোট বাতিল করেছিলেন। যখন চীন, ইউরোপ, আমেরিকায় ত্রাহি রব উঠে গিয়েছে তখন মোদি থালা-বাটি বাজিয়ে এবং তিনসপ্তাহের লকডাউনে ভারতকে করোনামুক্ত করার কথা ঘোষণা করেন। নেহরু থেকে মনমোহন—সবাই যখন চীনের চাতুরি ধরতে ব্যর্থ, তখন মোদি একা জিনপিঙের সঙ্গে দোলনায় দুলে চীনের মন জেতার ছক করেছিলেন। পাকিস্তানের নষ্টামি নিয়ে সারা দুনিয়া যখন তিতিবিরক্ত তখন মোদি দাওয়াত ছাড়াই পৌঁছে গেলেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পারিবারিক অনুষ্ঠানে! তাঁর একের পর এক ‘সারপ্রাইজের’ দরুন হয় দেশবাসীর সামনে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে কিংবা দেশের মানমর্যাদা মিশেছে ধুলোয়। তাতে ব্যক্তি মোদির কী যায় আসে!
মোদির মস্ত সমস্যা হল, সবসময় নেহরু-গান্ধী ফোবিয়ায় ভোগেন। তাই বোঝাতে চান, ‘ওই পরিবারটি সর্বনাশ ছাড়া কিছুই করেনি। দেশের জন্য এবার সব ভালো আমিই করব।’ এই হীনমন্যতা থেকেই, যেকোনও কিছুর বিনিময়ে নিজের নামটি খোদাই করে যেতে মরিয়া তিনি। নেহরুকে ছোট করতেই গড়েছেন তাঁর মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেলের সুবিশাল এক মূর্তি। কাশ্মীর সমস্যার রাতারাতি সমাধান করার জন্য বাতিল করেছেন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং কেড়ে নিয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদাও। নির্মাণ করছেন নয়া সংসদ ভবন এবং সেন্ট্রাল ভিস্তা। প্যাটেলের নাম মুছে মোতেরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আগে খোদাই করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদির নাম!
মোদির কাছে ‘উন্নয়ন’ মানে যত্রতত্র যথেচ্ছ হারে কংক্রিটের নির্মাণ বাড়িয়ে যাওয়া। সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর ভোটের রাজনীতি। মোদির কাছে 
‘সবকা’ মানে নিছকই হিন্দু ভোটার। তাই তাঁর তথাকথিত উন্নয়নের কেন্দ্রে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীই। তাদের মন জয়ের আশাতেই মোদি সরকার চারধাম প্রজেক্ট নিয়েছে। যোশিমঠের সাড়েসর্বনাশের নেপথ্যে সরকারের এই অপরিণামদর্শী মানসিকতাই কি দায়ী নয়?
এটা হুঁশিয়ারি মাত্র। সরকারকে বুঝতে হবে, হিমালয়ান রিজিয়ন ছেলেখেলার বস্তু নয়। কোনও সুস্থ মানুষই উন্নয়নের বিরোধী নয়। তারা এও জানে, সভ্যতামাত্রই আকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধি, শক্তি ও দুঃসাহসের এক অনবদ্য সমন্বয়। কিন্তু সব সৃষ্টিরই কিছু পূর্বশর্ত থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পরিবেশের ভারসাম্য। পরিবেশের দাবি অগ্রাহ্য করে নিছক বস্তুগত আয়োজন দীর্ঘমেয়াদে আত্মঘাতী হতে বাধ্য। কারণ প্রকৃতি মোটেই সর্বংসহা নয়, একটা সীমার পর তার অধিক প্রতিহিংসাপরায়ণ কেউ নয়। তখনই উপস্থিত হয় সভ্যতার সঙ্কট। এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতা’র যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন, ‘সভ্যতা-শব্দটার আসল মানে হচ্ছে, সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করা। সভা-শব্দের  ধাতুগত অর্থ এই যে, যেখানে আভা সেখানে আলোক আছে। অর্থাৎ মানুষের প্রকাশের আলো একলা নিজের মধ্যে নয়, সকলের সঙ্গে মিলনে।’ প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ করে সকলের সঙ্গে সেই মিলনের কল্পনা অলীকই।

11th     January,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ