বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নোটবাতিল বা কর্মসংস্থান,
ভারত কোথায় পৌঁছেছে?
সমৃদ্ধ দত্ত

রাগ  কিংবা হতাশা নয়। ভয়ের কারণ আছে। যদি বোঝা যায় যে, একটি রাষ্ট্র তার দেশ এবং দেশবাসীকে চেনেই না, জানেই না এবং সম্পূর্ণ একটি স্বপ্নরাজ্যকেই দেশ হিসেবে মনে করে, সেটাই ভয় সৃষ্টি করে। তখন আর ভোট দেওয়া না দেওয়া, দেশপ্রেম, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আলোচনায় মনোনিবেশ করতে ইচ্ছা হয় না। একটা আশঙ্কা তৈরি হয় ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রের একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে যতটা সমালোচনা অথবা সমর্থনের জোয়ার এসেছে, সেই চর্চাকে আসলে কিন্তু ছাপিয়ে গিয়েছে একটি নীরব আতঙ্ক। সেটি হল, এসব সিদ্ধান্তগুলি দেখেই বোঝা যায় যে, সরকার অথবা রাষ্ট্র আদতে ১৪০ কোটির সিংহভাগ অংশকে চেনেই না। কোনও ধারণাই নেই যে ভারতের মানুষ কীভাবে বসবাস করে। তাদের চাহিদা কী। তাদের জীবনযাপন কেমন। ২০১৬ সালের এরকমই নভেম্বর মাসে যেমন হঠাৎ একদিন রাতে স্রেফ টিভিতে ঘোষণা করে বাজারে পুরোদস্তুর চালু থাকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ নোট বাতিল করে দেওয়া হয়। ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট সেই মধ্যরাত থেকেই বাতিল কাগজে পরিণত করে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ খেলাচ্ছলে। সেই সিদ্ধান্তের ৬ বছর পর আজ দেখা যাচ্ছে ওই সিদ্ধান্ত যে ভুল অথবা অপ্রয়োজনীয় ছিল, তাই নয়, ভারতের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছিল ওই একটিমাত্র সিদ্ধান্তের জেরে। 
এই যে বলা হচ্ছে, উচ্চবর্ণের গরিব মানুষ ১০ শতাংশ সংরক্ষণ পাবে চাকরি ও শিক্ষায়, সেক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ না হয় বোঝা গেল। অর্থাৎ সোজা কথায় যাদের জেনারেল ক্যাটাগরি বলা হচ্ছে। যেহেতু অনগ্রসরদের সংরক্ষণ আছে, তাই এবার উচ্চবর্ণকেও সেইরকমই সংরক্ষণ দেওয়া হল। তবে সেটা জাতিগত কারণে নয়। আর্থিকভাবে দুর্বলদের জন্য। এ পর্যন্ত স্পষ্ট। 
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় গরিব কারা? সেটি স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যে পরিবারের বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকার মধ্যে, তারাই  গরিব অর্থাৎ আর্থিকভাবে দুর্বল হিসেবে বিবেচিত হবে। বার্ষিক ৮ লক্ষ টাকার মধ্যে আয়, এই কথাটির অর্থ কী? অর্থ হল, যে পরিবারের বার্ষিক আয় ৭ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা তারাও গরিব। অর্থাৎ মাসে যারা ৬৬ হাজার টাকার মতো আয় করে, তারা সরকারের কাছে গরিব মানুষ।
এটাই ভয়ের কারণ। এই যে সরকার নিজের দেশ সম্পর্কে ভাবছে যে, ভারতের মতো দেশে মাসে ৬৬ হাজার টাকা আয় করা মানুষ ও পরিবারকে গরিব বলা যায়। এটা বেশ ভীতির সঞ্চার করে। কেন? কারণ, আমরা যদি কিছু সরকারি রিপোর্ট দেখি তাহলে জানতে পারবো ভারতে রোজগারের চিত্রটি ঠিক কেমন। ‘সিচুয়েশন অ্যাসেসমেন্ট অফ এগ্রিকালচারাল হাউসহোল্ডস ইন রুরাল ইন্ডিয়া’ নামক একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে ভারতে একটি কৃষক পরিবারের গড় আয় ১০ হাজার ২১৮ টাকা। 
মহাত্মা গান্ধী রোজগার গ্যারান্টি প্রকল্প অর্থাৎ ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টির ন্যূনতম মজুরি কত ধার্য করা আছে? দৈনিক ৩৩১ টাকা। অর্থাৎ ১০০ দিন পুরোটাই যদি কেউ বছরে কাজ পায় তাহলে তার আয় হবে ৩৩ হাজারে সামান্য বেশি। বছরে। বাকি সময়টা তার আয় কোথা থেকে হয় তার দায় রাষ্ট্রের নেই। 
ইনস্টিটিউট ফর কম্পিটিটিভনেস একটি সমীক্ষা করেছে। সেটি বিস্ময়কর। সেখানে বলা হচ্ছে ভারতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ যে মাসিক আয়ের অংশটি রয়েছে, সেই তালিকায় মাসে ২৫ হাজার টাকা আয়ের পরিবারও আছে। অর্থাৎ মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় করে এরকম পরিবারও ঢুকে পড়ছে সর্বোচ্চ আয়ের ১০ শতাংশের ব্র্যাকেটে। যে কেউ নয়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিল এই সমীক্ষা করিয়েছিল। আবার এই সমীক্ষা অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে দেশের সর্বোচ্চ আয় করার যে ১ শতাংশ মানুষ আছে অর্থাৎ মূলত শিল্প বা বাণিজ্যমহল, তাদের আয় ১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। আর সর্বনিম্ন আয়ের ব্র্যাকেটে যারা আছে, তাদের আয় ১ শতাংশ কমে গিয়েছে। সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ আয়ের তালিকায় যদি ২৫ হাজার টাকার মাসিক আয় ঢুকে যায়, তাহলে আন্দাজ করা যায় যে, নিম্ন আয়ের অংশের গড় রোজগার ঠিক কোন পর্যায়ে যেতে পারে। 
২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের ৫২ শতাংশ মানুষ বেঁচে আছে, কোনও সম্পত্তি ছাড়া। অর্থাৎ নগদ টাকার সিকিউরিটি, গহনা, নিজস্ব বাড়ি, যানবাহন, কিছুই নেই তাদের। বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের ২০২২ সালের রিপোর্টে একটা চরম আতঙ্কজনক কথা বলেছে। সেখানে বলা হচ্ছে,  নানাবিধ পণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে সেটা তো স্পষ্ট। কিন্তু খাদ্যের ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ দাম যদি বেড়ে যায়, তাহলে প্রতিবার ১ কোটি করে মানুষ আরও একটু গরিব হয়ে যায়। আর ভারতে গড় স্যালারি কত? সরকারি চাকরি বাদ দিলে বেসরকারি ক্ষেত্রের গড় শুরুর বেতন হল ১৩ হাজার টাকা থেকে ২৩ হাজার টাকা। এই হিসেব সংগঠিত ক্ষেত্রে। অর্থাৎ যেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে। দোকানে কাজ করা, কোনও স্টোরে চাকরি কিংবা অন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসাব নেই। ৪ হাজার টাকার বেতনে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সেক্টরে।
এহেন ভারতে মাসে ৬৬ হাজার টাকার আয় করাকে ভারত সরকার তকমা দিয়েছে গরিব! এরকম হলে তো আমাদেরই গর্ব। কিন্তু তার জন্য সরকারের উচিত ছিল যারা নগণ্য আয় করে, তাদেরও এই ৬৬ হাজারের পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনও প্ল্যান করা। সেটা কি আমরা দেখতে পাই? কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কী প্ল্যান আছে? 
এটাই হল ভয়ের কারণ যে, রাষ্ট্র কত কম জানে অথবা জানতেই আগ্রহী নয় নিজের দেশকে। সে মনে করে, আমি যেভাবে দেখতে পছন্দ করি, সেটাই হল আমাদের দেশ। অর্থাৎ রাষ্ট্র মনে করছে স্মার্ট স্মার্ট শুনতে স্টার্ট আপ বিজনেস বোধহয় ভারতের অর্থনীতিই পাল্টে দিচ্ছে। সে মনে করে সত্যিই ডিজিটাল লেনদেন ১৪০ কোটি ভারতবাসীর কাছেই জলের মতো সোজা। নোটবাতিল করার সময় এটাই বলেছিল রাষ্ট্র যে, এখন আর কেউ নগদ নাকি ব্যবহার করে না। নগদ ব্যবহারের দরকারই নেই। অথচ আজ ৬ বছর পরও বাজারে নগদের পরিমাণ ৩০ লক্ষ কোটি টাকা। যা ২০১৬ সালে নোটবাতিলের সময় ছিল ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষের কাজ চলে গিয়েছিল মাত্র ৬ মাসের মধ্যে। তিন লক্ষের বেশি ক্ষুদ্র কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। 
নোটবাতিল করে ডিজিটাল ভারতের স্বপ্নে বিভোর রাষ্ট্র কী কী জানতে পারেনি? সে জানতে পারেনি তেলেঙ্গানার সিড্ডিপেট জেলার ধর্মারম গ্রামের ৪২ বছরের কৃষক ভর্দা বালায়া নিজে চিকেন রান্না করে পরিবারের সকলকে খা‌঩ইয়েছিল। চিকেনের ঝোলে মিশিয়েছিল কীটনাশক। কারণ তার ভুট্টা চাষ লোকসান হয়েছিল। তাই এক একর জমি বিক্রি করে সেই চাষের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতে চাইছিল সে। ক্রেতাও পাওয়া যায়। কিন্তু নোটবাতিলের পর ক্রেতা এসে বলে তাদের আর নগদ নেই। তাই জমি কেনা সম্ভব নয়। এরপর আর ভর্দা বালায়ার সামনে অন্য পথ ছিল না। সে গোটা পরিবারকে বিষাক্ত চিকেন খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বাকিরা হাসপাতালে বেঁচে গেলেও সে নিজে এবং তার বৃদ্ধ পিতা প্রাণ হারায়। 
রাষ্ট্র নোটবাতিল করে অর্থনৈতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল। আমাদের বিনীত প্রশ্ন, কোন অর্থনীতির সিংহাসনে বসেছে ভারত নোটবাতিলের ৬ বছর পর? 

11th     November,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ