বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ম্যাজিক ফিগার কোনও
জাদুতে ছোঁয়া যাবে না
হারাধন চৌধুরী

ছাপ রাখে সময়। ফিকে হয় বিস্ময়ের রং। দু-এক দশক আগেও ম্যাজিক বা জাদু প্রদর্শনী দেখে সব বয়সি মানুষ বিস্মিত হতো। বিশেষ করে বালিগঞ্জের ইন্দ্রজাল ভবনের সদস্যরা বহু অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাতেন। বিস্ময় আর বিনোদনের সেই যুগলবন্দিকে যখন অতীত ভেবে নিয়েছি, ঠিক তখনই আমাদের বাকরোধ করল উপর্যুপরি দুটি ঘটনা। কাকতালীয় কি না জানা যায়নি, দুটি ঘটনাই উত্তর শহরতলির। সম্প্রতি জগদ্দলের এক হতদরিদ্র বৃদ্ধার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ল ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। সেই ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই, ক’দিন পর খবরের শিরোনাম দখল করল আগরপাড়া। ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা ক্রেডিট হল এক গরিব ফেরিওয়ালার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। 
নরেন্দ্র মোদি লোকসভায় ম্যাজিক ফিগার জোগাড় করেছিলেন দেশবাসীকে একাধিক ম্যাজিক উপহার দেবেন বলে। বছরে দু’কোটি চাকরি এবং প্রত্যেক নাগরিকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান অন্যতম। কীভাবে? একাধিক নির্বাচনী সভায় তিনিই জানান, কালো টাকার শেষ দেখে ছাড়বেন। কালো টাকার কারবার শুধু দেশেই নির্মূল হবে না, বিদেশে যেসব কালো টাকা পাচার হয়েছে উদ্ধার করে আনা হবে সেসবও। এতে অধিকার নাগরিকদেরই। অতএব তাদের মধ্যেই বণ্টিত হবে। 
মোদিযুগের আটবছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সরকার কথা রাখেনি। বিরোধীরা যখন সরকারকে ভর্ৎসনা করছে, নিজেদের প্রতারিতই ভাবছে নাগরিকরা, তখনই বিরাট ম্যাজিকের সাক্ষী হলেন সুশীলা কাহার এবং অমল সেন নামে দু’জন। আমরা কি ধরে নেব, মোদির প্রতিশ্রুতি শ্রবণে আমাদের কিঞ্চিৎ ঘাটতি ছিল—নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১৫ লক্ষ নয়, আসলে অনেক বেশিই জমা পড়ার কথা ছিল? এমনও তো হতে পারে, সেই টাকাই জমা পড়তে শুরু করেছে—পেরিয়ে যাওয়া আটবছরের স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারেস্টসমেত!
অবশ্য ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। বৃদ্ধা সুশীলা কাহারের অ্যাকাউন্টে বিপুল টাকার হদিশ পাওয়ামাত্রই তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছিল রাঁচির পুলিস। অন্যদিকে, আর্থিক অপরাধ দমন শাখার অফিসারদের জেরার মুখে পড়েছেন অমল সেন। সংশ্লিষ্ট পরিবার দুটির দাবি, এই ভেলকিতে তারা রীতিমতো অবাক। 
তাদের ঘুমও ছুটে গিয়েছে। তারা জানেই না, এই টাকার উৎস কী। এখনও জানা যায়নি, ব্যাঙ্ক বা অন্য কারও নিছক পোস্টিংয়ের ভুল, নাকি এর পিছনে সক্রিয় কোনও অপরাধ চক্র। উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
পরিবার দুটির মনের গভীরে একটু ঢুঁ মারা যায়। তারা কি ক্ষণিকের রাজা ভাবার সুখও পেয়েছিল? অনুমান হয় যে, একেবারেই না। বরং রাজার ঘরের ধন তাদের ঘরে আবিষ্কার করে তারা রাজরোষেরই ভয় পেয়েছে। অভুক্ত মানুষের সামনে রাজভোগের একটা বড় হাঁড়ি রেখেই কেড়ে নেওয়ার মতো চরম অশ্লীলতার সঙ্গেও এই ঘটনার তুলনা করা চলে।  
খেলাপি মোদি জমানা সাধারণ মানুষের শুধু দুর্দশা বাড়ায়নি, সম্মানও নষ্ট করেছে। সবচেয়ে খারাপ হয়েছে তাদের আর্থিক পরিস্থিতি। বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি লাগাম ছাড়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণের সাধ্যের বাইরে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসা সত্ত্বেও ফের ঊর্ধ্বমুখী বেকারত্বের হার। সিএমআইইর হিসেবে, গতমাসে বেকারত্বের হার ছিল ৮.২৮ শতাংশ। সংখ্যাটি শহরাঞ্চলের জন্য আরও ভয়াবহ—৯.৫৭! একবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের প্রধান ক্ষোভ এটাই। কারণ, দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পেরে ওঠার একমাত্র উপায় একটা চাকরি কিংবা একটু বেশি আয়। কিন্তু দুটোই অধরা। ‘কোথায় মূল্যবৃদ্ধি?’—অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এই প্রশ্ন তোলায় ক্ষোভ বরং বেড়েছে। অর্থমন্ত্রকের সর্বময়কর্ত্রীর মুখে এমন বিস্ময় সাক্ষাৎ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে! এমনকী, জিডিপি বৃদ্ধি সম্পর্কে এনএসওর এস্টিমেট (১৩.৫ শতাংশ), আইএমএফের সার্টিফিকেট (ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যকে হারিয়ে ভারতই পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি) ইত্যাদিও এই ক্ষতের জন্য উপযুক্ত মলম হয়ে উঠতে পারেনি। 
একইসঙ্গে খারাপ সময় যাচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপিরও। আমরা জানি, নরেন্দ্র মোদি দু-দু’বার ক্ষমতা দখল করেছেন এনডিএর নেতা হিসেবে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেই বিজেপি এবং এনডিএর নামের পাশে সেরা সাফল্যের খতিয়ানটি লেখা হয়। বিজেপি পেয়েছিল মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৭.৩৬ শতাংশ এবং ৩০৩টি আসন। এনডিএর ক্ষেত্রে সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ৪৫ এবং ৩৫৩। কিন্তু 
এই উচ্ছ্বাস তাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গত 
কয়েক বছরে শিরোমণি অকালি দল, শিবসেনা, জেডিইউ, রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি (রাজস্থান) প্রভৃতি এনডিএ ছেড়ে গিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ধরলে এনডিএ ত্যাগ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা দলের সংখ্যা নয় নয় করে উনিশ!
স্বদেশি ও জাতীয়তাবাদের উগ্রতা এবং ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স’ গোছের বাগাড়ম্বর দিয়েই এনডিএর অবিশ্বাস্য বিরাট চেহারা দিয়েছিল বিজেপি। বহুদলীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় জয়-পরাজয় নির্ধারণে একটিমাত্র ভোটই যথেষ্ট। বড়সড় জোট তৈরি করে অঙ্কের এই খেলায় বিজেপি একাধিকবার বাজিমাত করেছে। কিন্তু নদী পেরনোর পর মাঝিকে বেমালুম অস্বীকার করার মতোই  প্রত্যাখ্যাত, উপেক্ষিত হয়েছে একাধিক শরিকের দাবি। সরকার তৈরির অল্পদিন পর থেকেই বিজেপির স্বরূপ আবিষ্কার করে ব্যথিত, আহত হয় বেশিরভাগ এনডিএ শরিক। নানা সময়ে অনেকগুলি দলের বিজেপির সঙ্গত্যাগের পিছনে এই কারণটি অবশ্যই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু হাঁড়ির এই করুণ হাল মেনে নেয় কী করে গেরুয়া শিবির? তাদের যে ঘোষিত লক্ষ্য—‘কংগ্রেসমুক্ত (পড়ুন বিরোধীমুক্ত) ভারত নির্মাণ’। পরিতাপের বিষয় হল, ক্ষতে প্রলেপ দিতে তারা গণতন্ত্র জলাঞ্জলি দিয়েই রাজ্যে রাজ্যে কিছু ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার বসাতে মরিয়া। অর্থাৎ মওকা বুঝে বিরোধী দলের বা 
জোটের নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে নিজের সরকার তৈরি করতে তারা যাচ্ছেতাই কারবার চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পরিবর্তে তাদের সম্পর্কে দেশজুড়ে ভীতিই প্রকট করে তুলেছে ক্ষমতালোভী স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি।
পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন আর দু’বছরও দূরে নয়। তার আগেই হবে গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরাসহ একডজন রাজ্য বিধানসভার ভোট। অর্থাৎ সারা দেশের রাজনীতিতে আগামী দিনগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনে গণতন্ত্র এবং সংবিধান মান্যতা পেলে বিজেপির উদ্বেগ বাড়বেই। 
অন্যদিকে, নেতৃত্বের সঙ্কটে কংগ্রেস। সোনিয়া গান্ধীর জায়গায় নির্বাচিত সভাপতি চায় দল। কিন্তু ভোট-রাজনীতিতে নাস্তানাবুদ রাহুল গান্ধী প্রার্থী হতে নারাজ। প্রিয়াঙ্কাও রাজি হবেন কি না অজানা। গান্ধী পরিবারের আজ্ঞাবহ নেতাদের রাজি করাতেও হিমশিম হচ্ছেন সোনিয়া। অন্যদিকে, পদে বসার জন্য সবরকমে তৈরি গান্ধী পরিবারের অপছন্দের ক্যান্ডিডেট শশী থারুর। সব মিলিয়ে অবিজেপি পক্ষের প্রধান শক্তি কেন্দ্রে চলছে ডামাডোল। কংগ্রেস বরাবর এককভাবে ক্ষমতা দখলের পক্ষে। বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানের পরই গান্ধী পরিবার অহমিকা ছেড়ে বেরতে বাধ্য হয়। রাজি হয় জোট-রাজনীতি মেনে নিতে। তৈরি করে বিজেপি-বিরোধী ইউপিএ। কিন্তু সেখানে যাওয়ার স্বস্তি বোধ করেনি সবাই। এনডিএর মতোই, তা থেকে একাধিক দল বেরিয়েও গিয়েছে নানা সময়ে, এবংবিধ কারণে। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় উদাহরণ তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেসের মূল সমস্যা হল—সাংগঠনিক শক্তি তলানিতে গেলেও, বহুজন গ্রাহ্য মুখের আকাল হলেও, জোটের নেতৃত্ব ছাড়ার মতো উদার নয়। এমনকী, আপাত ছোট শরিকরা উপযুক্ত মর্যাদা পায় না। একাধিক ক্ষেত্রে জনস্বার্থের রাজনীতিকে ছাপিয়ে ওঠে গান্ধী পরিবার কিংবা তাদের মিত্রস্বার্থের রাজনীতি।
এমনই আবহে বিরোধী শিবিরে শুরু হয়েছে জোড়া তোড়জোড়—মোদি-শাহের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার এবং বিজেপির বিরোধিতায় কংগ্রেসের অগ্নিপরীক্ষা গ্রহণের। ২৫ সেপ্টেম্বর চৌধুরী দেবীলালের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে হরিয়ানায় এক রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে এককাট্টা হতে চায় বিরোধীরা। পরিচিত সমস্ত বিরোধী মুখের সঙ্গে আমন্ত্রিত মোদির মিত্র নবীন পট্টনায়েকও। কংগ্রেসকেও শামিল করার চেষ্টা চলছে। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে এই তৎপরতা। এমন কৌশল জ্যোতি বসুর আমল থেকে এপর্যন্ত অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু আজও কেন তা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি? অবিজেপি দলগুলিকে দ্রুত এবং নিরপেক্ষভাবে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে সেইমতোই। এর একমাত্র সমাধান হল—স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধান মিলিয়ে—জনস্বার্থকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া। হাত তুলে জানাক কোন কোন দল তাতে একবাক্যে রাজি, তবেই বোঝা যাবে মহাজোটের আকাঙ্ক্ষা আদৌ কতটা আন্তরিক।

14th     September,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ