বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মহোৎসবে অমৃত কোথায়?
মৃণালকান্তি দাস

ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকা কখনওই হিন্দুদের আপন, শ্রদ্ধার হয়ে উঠতে পারে না। লিখেছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর।
কেন? ১৯৪৭-এর আগস্টে আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর যুক্তি ছিল, ‘তিন’ শব্দটাই অশুভ, এবং তিন বর্ণবিশিষ্ট জাতীয় পতাকা নিশ্চিতভাবেই খুব খারাপ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে। দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে জাতীয় পতাকার রং কী হওয়া উচিত ছিল? গেরুয়া? সেই আরএসএস আর তার রাজনৈতিক সন্তান বিজেপি এত বছর পর শেখাচ্ছে দেশপ্রেম কী, কীভাবে দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখাতে হবে! তাঁদের রাজনীতি যে ‘নেশন’-এর সাধনা করে, তার কেন্দ্রস্থলে সর্বজনীনতা নেই, বর্জন আছে। যে ‘নেশন’-এর মূল চালিকাশক্তি বৈর, তাকে শক্তির ভাষাতেই কথা বলতে হয়। দমন করবার শক্তি, ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার শক্তি। ঘরের শত্রুকেও, বাইরের শত্রুকেও। তাই তো অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ভীতি জাগাতে না পারলে প্রীতিও পাওয়া যায় না...।
প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত-ভাবনাটি উঠে এসেছে গোলওয়ালকরের ‘বাঞ্চ অব থটস’-এর পৃষ্ঠা থেকে। তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষী বয়ানে ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, এই দেশে মুসলিমদের যদি থাকতে হয়, তবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই থাকতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য মেনে। স্বাধীনতার আগে থেকেই স্বাধীন দেশের যে কল্পনা জাতীয়তাবাদী নেতারা করছিলেন, সেই ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী ভারতের সঙ্গে গোলওয়ালকরের ভারত-ভাবনার বিরোধ প্রত্যক্ষ। মোদির ভারতযাত্রা সেই পথই অনুসরণ করে। ভাবতে অবাক লাগে, সেই মোদি কি না আজাদি কা মহোৎসবে ‘অমৃত’-এর খোঁজ করছেন!
এই সঙ্কটকাল নিয়ে সুনির্দিষ্ট উপলব্ধি রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের কতগুলি বিশেষ সংস্কার, আমাদের জাতের কতগুলি লোকাচার, এইগুলির দ্বারা সীমাবদ্ধ করে আমাদের স্বজাত্যের অভিমানকে অত্যুগ্র করে তোলার উপায়কে আমি কোনওমতে ন্যাশনাল শিক্ষা বলে গণ্য করতে পারি না। জাতীয়তাকে আমরা পরম পদার্থ বলে পূজা করি না...। প্রাচীন ভারতের তপোবনে যে মহাসাধনার বনস্পতি একদিন মাথা তুলে উঠেছিল এবং সর্বত্র তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে সমাজের নানা দিককে অধিকার করে নিয়েছিল, সেই ছিল আমাদের ন্যাশনাল সাধনা। সেই সাধনা যোগসাধনা। যোগসাধনা কোনও উৎকট শারীরিক মানসিক ব্যায়ামচর্চা নয়। যোগসাধনা মানে সমস্ত জীবনকে এমনভাবে চালনা করা যাতে স্বাতন্ত্রের দ্বারা বিক্রমশালী হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য না হয়, মিলনের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠাকেই আমরা চরম পরিণাম বলে মানি। ঐশ্বর্যকে সঞ্চিত করে তোলা নয়, আত্মাকে সত্যে উপলব্ধি করাই আমরা সফলতা বলে স্বীকার করি...।’ আজ ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে বলতে আমরা কি কবিগুরুর সেই পরামর্শ ভুলে যাব?
১৯৪৭-এ মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে দেশভাগ ও স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু হিন্দুত্বের সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও সর্বনাশী তত্ত্বে ও প্রয়োগে দেশ হয়তো একদিন ভাগ হয়ে যাবে মহল্লায় মহল্লায়। দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের মোড়কে আর আড়ালে, হিন্দুত্বের অছিলায় যা চলছে, তা নির্ভেজাল ঘৃণার কারবার। এই ঘৃণা কোনও ব্যক্তির মানসিকতা নয়, এটি একটি ক্ষমতাদখলের ভাবাদর্শ। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা ও কর্মপন্থায় পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে জাতি-উৎকর্ষের মোহ এবং ‘অপর’-কে ঘৃণা। ‘চার অধ্যায়’-এ অন্তুর মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘তোমরা যাকে পেট্রিয়ট বলো, আমি সেই পেট্রিয়ট নই।’ অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষ যখন দেশভক্তির আধার হয়, যখন প্রতি পলে দেশের ভিতর ও বাইরে দুশমন চিহ্নিত করে ভয়াবহ আর্থিক অবস্থাকে আড়াল দেওয়ার চাতুরী চলতে থাকে, তখন ধর্মসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমের জোয়ার চাগিয়ে ওঠে। 
জাতীয়তাবাদের মুশকিল হল, জাতির একটা ‘শত্রু’ দরকার। যার বিরুদ্ধতার মাধ্যমেই জাতির একাত্মতা তৈরি হয়। হিন্দু ও মুসলিমের স্বার্থ আলাদা, অতএব তারা আলাদা দু’টি জাতি, এ দাবির মধ্যে একটা ‘স্বাভাবিকতা’ নিশ্চয়ই ছিল ও আছে। মহারাষ্ট্রে অ-মারাঠিভাষী অপর, অসমে বাঙালি অপর, দক্ষিণ ভারতে হিন্দিভাষী অপর— যে কোনও খণ্ডজাতীয়তার দাবিতেই সেই ‘স্বাভাবিকতা’র বাস। উদারপন্থার দায় না থাকলে এই স্বাভাবিকতায় গা ভাসানো যায়। উদারপন্থীরা জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলেন না, সেই শূন্যস্থান পূরণ করে উগ্র (হিন্দুত্ববাদী) জাতীয়তাবাদ। যে কোনও প্রশ্নকে সে দেশদ্রোহ বলে দেগে দেয়। আজকের শাসকরা বোঝাতে চান, জাতীয়তা বস্তুটির ধারক-বাহক শুধু তাঁরাই। তাঁদের মতের সঙ্গে এ-দিক ও-দিক অমিল হলেই সেটা অ্যান্টি-ন্যাশনাল।
আজ ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ এটাই মন্ত্রের মতো শেখানো হচ্ছে। অতীতে আমরাই সেরা ছিলাম, এই কথাটাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারলে বর্তমানের খামতিগুলিকে ঢেকে রাখা যায়, তেমনই সেই অতীতের দোহাই দিয়ে চালিয়ে যাওয়া যায় হরেক অন্যায়। কিন্তু কে বলবে, সেই শ্রেষ্ঠত্ব তো পড়়শিকে সবক শেখানোর পেশি আস্ফালনের শ্রেষ্ঠত্ব নয়, তাতে সব ধর্মের মানুষের এক হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান ছিল। নাগপুরের জাতীয়তাবাদ সেই কথাটা ভুলিয়ে দিতে চাইবেই। গেরুয়া শিবির জানে, ধর্মই আফিম। সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে তীব্র বেকারত্বের জ্বালা, মূল্যবৃদ্ধি সহ যাবতীয় সমস্যা ভুলিয়ে রাখা সম্ভব।
এ দেশের শাসকরা আজ বহুত্বকেই সমস্ত দিক খর্ব করে গোটা দেশ ও তার সমাজকে একটি একমাত্রিক আধিপত্যের ছাঁচে ঢালতে বদ্ধপরিকর। চরম এককেন্দ্রিকতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে তাঁরা শুধু বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলিকে নানাভাবে দমন ও পীড়ন করতে তৎপর নন, সামগ্রিকভাবে রাজ্যের স্বাধিকারও খর্ব করে কেন্দ্রের দাপট বাড়াতে চান। তাঁরা মনে করেন, সর্বশক্তিমান কেন্দ্রীয় সরকারই দেশের শক্তি ও সামর্থ্যের পক্ষে জরুরি এবং যথেষ্ট। বিপুল এক ক্রোধ বিধ্বংসী ভঙ্গিমায় দ্রুতসঞ্চারী এখন, তারই ছায়ায় ঢাকা পড়ছে মাতৃভূমির আকাশ। যে আকাশে মিশছে আবিলতার গন্ধ। হুঙ্কার, আরও হুঙ্কার, আরও তীব্র হুঙ্কার— এই যখন সমাজমানসের চিত্র হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেখানে আর যাই হোক, সত্যের জায়গা থাকে না।
উগ্র জাতীয়তাবাদ আমাদের প্রসারের পথ 
আগলে ধরতে চেয়েছিল ১০০ বছর আগেও, কিন্তু পারেনি। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসেছিলেন বিভ্রান্তির মোহমায়াজাল কাটাতে। আজ আবার নতুন অবকাশে নতুন করে বিভ্রান্তির মধ্যে এই সুবিশাল ভারতীয় জনগোষ্ঠী। আজ হয়তো রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা রয়েছে, তাঁর শতাব্দীপ্রাচীন নিবন্ধগুলি সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিচ্ছে।
ভারতের জন্মের সময় নেহরু, আম্বেদকরদের মত ছিল, ‘কমপোজিট কালচার’ (বহুত্ববাদ) এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ছাড়া ভারতভূমির প্রতিটি অধিবাসীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে বসবাসকারী মানুষ (‘টেরিটোরিয়ালিটি’ বা ভূমি-পরিচিতি) নাগরিক অধিকারে মণ্ডিত হবেন, সেটাই হবে গণতন্ত্র। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, কিন্তু গণতন্ত্র আছে— এমন কোনও অভিমুখে ভারত মোটেই হাঁটবে না। আজাদি কা অমৃত মহোৎসবের জাঁক দেখে যেন ভুলে না যাই, এ দেশের বহু মানুষ শুধু তাঁদের ধর্মপরিচয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মাথার উপরে একটি খাঁড়া নিয়ে দিনযাপন করছেন। সংখ্যাগুরুবাদের খাঁড়া। দেশভাগের সময় থেকেই খাঁড়াটি বিরাজমান ছিল, কিন্তু দূরে ছিল। তাকে প্রতিহত করার নানা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচও অনেকখানি কার্যকর ছিল। আজ দূরত্ব ঘুচেছে, রক্ষাকবচ সরে গিয়েছে। শাসক শিবিরের রকমারি মঞ্চ থেকে ‘ওদের শেষ করা’র হুঙ্কার ধ্বনিত হচ্ছে, আর সেই হুঙ্কারের থেকেও কর্ণভেদী ও হিংস্র হয়ে উঠছে ক্ষমতার অধীশ্বরদের প্রগাঢ় নীরবতা, যে নীরবতায় হিংসার কারবারিরা বিপুল প্রশ্রয় পাচ্ছে, পেয়ে আসছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বিশেষণটি এখনও বহাল আছে, যদিও সুবিধা বুঝলেই হয়তো সংখ্যাগুরুর দাপট তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করবে।
যে সব নীতির উপর দাঁড়িয়ে এ দেশ নিজেকে নির্মাণ করেছিল, গেরুয়া রাজনীতি আজ সযত্নে সেগুলিকে উল্টে-পাল্টে ভেঙে দিয়েছে। যতই হম্বিতম্বি করুন তাঁরা, তথ্যপ্রমাণ পাল্টে ফেলে, ধ্বংস করে, ইতিহাসটা আবার নতুন করে না লেখা পর্যন্ত আমরা জানি, বিজেপির পূর্বসূরিরা স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে কতটাই প্রান্তিক ছিলেন। সাভারকরের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতারা দেশের স্বার্থের উপরে রেখেছিলেন নিজের ও দলের স্বার্থকে। ঠিক যেমন করেছিলেন কট্টর মুসলিম নেতারা। বাস্তবিক, ভারত নামক দেশটাকে পঙ্গু হয়ে জন্মাতে হয়েছিল এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘায়ে, আর জন্মমুহূর্তেই তাকে ঘোর অসুখ বলে মেনে নিতে হয়েছিল। আজ সেই ধর্মরাজনীতিরই ধারক-বাহক-প্রচারক আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সেই মোদিজি আজাদি কা অমৃত মহোৎসব উদযাপন করবেন কী করে?
আজাদি মানে তো শুধু ‘লেফ্ট রাইট লেফ্ট’ নয়!

28th     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ