বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এই মুহূর্তে দলের মাতব্বররাই মমতার টার্গেট
তন্ময় মল্লিক

মেঘের চোখ রাঙানির সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ভেজা জামাকাপড় গায়েই শুকচ্ছে, আবার ভিজছে। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। তবুও ভিড় পাতলা হয়নি এতটুকু। উল্টে তিনি মঞ্চে উঠতেই আশপাশে দাঁড়ানো লোকজন পিল পিল করে সভাস্থলে ঢুকে পড়ায় পিঁপড়ে গলার রাস্তাটাও হয়ে গেল বন্ধ। এর নামই কি মমতা-ম্যাজিক? কেন বারবার তাঁর সভায় আছড়ে পড়ে জনস্রোত? কারণ বৃষ্টির মধ্যেও মাটি কামড়ে বসে থাকা কর্মীরাই যে তাঁর চোখে ‘দলের সম্পদ’! আর যারা দলের চেয়েও নিজেদের বড় ভাবে কিংবা দলকে ভাঙিয়ে যাদের আঙুল ফুলে হয় কলাগাছ, তারাই ‘দলের আপদ’। সম্পদ’ ও ‘আপদে’র ফারাকটা তিনি খুব ভালো করে বোঝেন। তাই তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম একুশের প্রকাশ্য সভা। ‘জনসুনামি’ ছিল প্রত্যাশিত। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার আদর্শ প্ল্যাটফর্ম। সেই মঞ্চে দলের মাতব্বরদের দিলেন হুঁশিয়ারি। বুঝিয়ে দিলেন, লক্ষ্য ২০২৪ হলেও পঞ্চায়েত ভোটই ‘পাখির চোখ’।
এবারের সভায় বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর বাস ও চারচাকা গাড়ি গিয়েছে। এমনটা প্রতি বছরই হয়। তবে বিশেষত্বটা হল, তৃণমূলের বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মী এবার ট্রেনে কলকাতায় গিয়েছিলেন। ফলে হাওড়া ও শিয়ালদহগামী প্রতিটি ট্রেনেই ছিল উপচে পড়া ভিড়।
তৃণমূল নেতৃত্ব ২১ জুলাইয়ের প্রচারের সময় পেট্রল, ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ইস্যু করে ট্রেনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল দু’টি। এক কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি মানুষের সামনে তুলে ধরা। দুই, সভায় যাওয়ার 
খরচ কমানো। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’ নীতি মেনে বহু বিধায়ক, সভাধিপতি, এমনকী মন্ত্রী পর্যন্ত ট্রেনে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাতে লাগাম পড়েছিল চাঁদা তোলায়। নেতৃত্বের দাবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছ’মাসের মধ্যে নতুন তৃণমূল উপহার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এটা সেই ‘নতুন তৃণমূল’ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর জন্য বিরোধীদের সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্রটি কী? এককথায়, তোলাবাজি। বিভিন্ন প্রকল্পের বেনিফিসিয়ারির কাছ থেকে টাকা আদায় ও দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা কিছু নেতার পেশা। তারজন্যই দেশের মধ্যে সর্বাধিক জনমুখী প্রকল্প নেওয়া সত্ত্বেও বিরোধীরা কিছু আসনে জেতে। এর সবটাই তৃণমূলের নেগেটিভ ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার নজর দিয়েছেন সেই নেগেটিভ ভোট কমানোয়। তাই বারবার চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে দিয়েছেন হুঁশিয়ারি।
পুরো দমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দুয়ারে সরকার’ চালু করেছিলেন? উত্তর, পরিষেবা দেওয়ার কাজে স্বচ্ছতা নিয়ে আসা। নেপোয় দই খাওয়ার রাস্তা বন্ধ করাই 
ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কারণ সেই সময় বাংলা আবাস যোজনা থেকে শুরু করে সমস্ত প্রকল্পের জন্য নেওয়া হচ্ছিল কমিশন। বেনিফিসিয়ারিকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এমনকী, মৃতদেহ সৎকারের জন্য সরকারের ‘সমব্যথী’ প্রকল্পে দেওয়া দু’হাজার টাকাতেও ভাগ বসাচ্ছিল। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা প্রকল্পে সুবিধা প্রাপকদের একটা বড় অংশ উপরে তৃণমূল করলেও তলায় তলায় বিরোধী হয়ে যাচ্ছিল। 
বেনিফিসিয়ারির দেওয়া কমিশন আর ঠিকাদারের পার্সেন্টেজে ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে যাচ্ছিলেন কিছু নেতা। দু’বেলা হাঁড়ি চড়ত না এমন অনেক নেতাই হয়ে গিয়েছেন বাড়ি-গাড়ির মালিক। তাঁদের জন্যই কালিমালিপ্ত হচ্ছিল তৃণমূল। ‘দুয়ারে সরকার’ ছিল সেই দুর্নীতি রোখার প্রথম পদক্ষেপ। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই ‘দুয়ারে সরকার’ মানুষের অভাব অভিযোগ দূর করার ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি করেছে। তাতে পরিষেবা দেওয়ার বিনিময়ে টাকা কামানোর রাস্তা সঙ্কুচিত হলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। শিল্পীভাতা থেকে বার্ধক্যভাতা সমস্ত ধরনের অনুদানের জন্যই লাগে পঞ্চায়েতের সুপারিশ। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগায় এক শ্রেণির জনপ্রতিনিধি। আবেদনপত্রে সই করার আগেই উভয়পক্ষের মধ্যে পাকা হয়ে যায় ‘ডিল’।
ঘর খুঁজে দেওয়ার জন্য দালালরা এক মাসের ভাড়া দাবি করেন। নতুন ঘরে ঢোকার আগেই দালালকে বুঝিয়ে দিতে হয় তাঁর প্রাপ্য। যে কোনও সরকারি প্রকল্পের অনুদান পাওয়ার জন্য একইভাবে দিতে হয় ‘দালালি’। এক্ষেত্রে কিছু জনপ্রতিনিধি বা দলের মাতব্বররাও নেয় প্রথম মাসের অনুদানের টাকা। 
ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকলেই তা তুলে নেতার বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়। তবে, ব্যাঙ্কে টাকার ঢোকার খবরটা আবেদনকারীকে পৌঁছে দেয় সেই মাতব্বর। অধিকাংশ জেলায় চলে এই প্রথা। কিন্তু প্রতিবাদ হয় না। কারণ চুক্তি না মানলে মাসিক ভাতা পাওয়া অনিশ্চিত। তাই কেউ ঘাঁটাতে চায় না।
কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দলের মাতব্বরদের দিলেন এমন হুঁশিয়ারি? সেটা বোঝার জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটা ঘটনাই যথেষ্ট। রামনগর-১ ব্লকে রাজ্য সরকারের মানবিক প্রকল্পের পেনশন প্রাপকের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা দেখে প্রশাসনের সন্দেহ হয়। তদন্ত করে দেখা যায়, এই প্রকল্পে এমন ৩০০ জন পেনশন পাচ্ছেন, যাঁরা সম্পূর্ণভাবে সুস্থ। অর্থাৎ ভুয়ো সার্টিফিকেট দাখিল করে টাকা নিচ্ছে। বাতিল হয়েছে তাদের পেনশন।
দলের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রীর হুঁশিয়ারি বিরোধীদের সমালোচনার অস্ত্র হবে, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেননি। লাখো মানুষকে সাক্ষী রেখে জানিয়ে দিয়েছেন, পরিষেবাই তাঁর ভোটে জেতার হাতিয়ার। তাই তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, তৃণমূল সরকার যতদিন, বিনা পয়সায় রেশন, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ততদিন। কেন্দ্রের ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ ও রাজ্যের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি এই সব প্রকল্প বন্ধ করবেন না। কারণ তিনি জানেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির যুগে এইগুলিই গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ‘লাইফ লাইন’। 
নেগেটিভ ভোট কমানোর একটাই রাস্তা, মাতব্বরদের টাইট দেওয়া। এই মুহূর্তে সেটাই 
তৃণমূল নেত্রীর লক্ষ্য। তাই দলকে ভাঙিয়ে টাকা কামানোর রাস্তা বন্ধ করতে চাইছেন। মমতার দাওয়াই, ‘তৃণমূল কংগ্রেসের নামে কেউ যদি টাকা তোলে বা বদমায়েশি করে তাহলে তাদের সোজা থানায় নিয়ে গিয়ে ধরিয়ে দিন।’ বলাই বাহুল্য, তাঁর এই 
হুঁশিয়ারি সাধারণ মানুষকে মাতব্বরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাবে।
জলপাইগুড়িতে শহিদ দিবসের প্রস্তুতি সভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, দাদা-দিদিদের ধরে আর পঞ্চায়েতের টিকিট হবে না। গাড়ি ছেড়ে মানুষের কাছে সাইকেল নিয়ে যেতে হবে। মানুষের সার্টিফিকেট সঙ্গে থাকলেই মিলবে টিকিট। বৃহস্পতিবার ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে সে কথা ফের জানিয়েছেন অভিষেক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও শোনা গেল সেই একই সুর। তৃণমূল নেত্রী জানিয়ে দিলেন, সাইকেল, রিকশ নিয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।
একই দলের নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। তবুও তা চর্চার জায়গা করে নিয়েছে। কারণ অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে আদি ও নব্যের একটা বিভাজনরেখা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, নিজেরা লড়াই করেই শেষ হয়ে যাবে তৃণমূল। কেউ কেউ আবার পিসি-ভাইপোর আড়াআড়ি বিভাজনে তৃণমূলের শেষের শুরু পর্যন্ত দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু একুশের সভা তাঁদের হতাশ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেকের ভাষণে তাঁরাও বুঝতে পারছেন, তৃণমূলের উপরতলায় কোনও দ্বন্দ্ব বা বিভাজন নেই। তৃণমূল কংগ্রেস একটা সুতোয় বাঁধা। আর লাটাইটা রয়েছে নেত্রীর হাতেই।

23rd     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ