শেষ কবে এমন ভয়ঙ্কর ছবি দেখেছি আমরা। শান্ত বাংলাকে অশান্ত করার এমন ঘৃণ্য চেষ্টা। আগুন জ্বলছে জাতীয় সড়কে। সারি সারি গাড়িতে শিশু, মহিলা অসুস্থ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে। জল নেই, খাবার নেই। উর্দিধারীরা অসহায়। আক্রান্ত থানা থেকে পুলিসের গাড়ি। হঠাৎ বাংলা এভাবে অশান্ত হয়ে উঠল কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবেদন করেছেন। নাখোদা মসজিদের ইমাম শান্ত হতে অনুরোধ করে বার্তা দিয়েছেন। তারপরও শুক্রবার ব্যাপক গণ্ডগোল হয়েছে। যে কোনও ধর্মেরই মানুষের এমন কাজ থেকে সংযত থাকা উচিত। কিন্তু এই বিষ ছড়ালো কে? এর শিকড় কোথায়? শুধু বাংলাই তো নয়, হাঙ্গামার খবর আসছে গোটা দেশ থেকেই। রাঁচিতে সংঘর্ষ আর আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন মানুষ। কিন্তু হঠাৎ কী হল যে বাংলা থেকে দিল্লি, দেশের বিস্তীর্ণ অংশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল? কথা ছিল ১৫ জুন পর্যন্ত দেশের কোণায় কোণায় মোদি সাহেবের ৮ বছরের সাফল্য কীর্তন চলবে অষ্টপ্রহর। দেশ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তার মধ্যেই মোদি সরকারের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই আট বছরের সাফল্য সন্দেশ ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যস্ততায়। বাজনদাররা কাড়া নাকাড়া হাতে প্রস্তুত। রাজকোষ থেকে অঢেল ব্যয়ের প্রস্তুতিও সারা। মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতির বেহাল দশা, বেকারত্ব, কৃষকের সর্বনাশ, রান্নার গ্যাসের দামের ছ্যাঁকা ভুলিয়ে দেওয়ার এই খেলায় বাধ সাধল কে! যাতে উৎসব ফিকে হয়ে বদলে গেল লজ্জাজনক সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে। কোনও বিরোধী নেতা কিংবা নেত্রী নয়তো? ৫৮ বছর আগে প্রয়াত নেহরুর ভূত ঝটকা দিয়ে গেল? না, তাও নয়! একেবারে মোদির ঘরের প্রতিভাময়ী ঝকঝকে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে পড়া মহিলাই যে এই কুনাট্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বয়স ৩৭। নাম নূপুর শর্মা। সঙ্গে আছেন নবীন জিন্দাল। সৌজন্যে গেরুয়া শক্তি। এখন বিপদে পড়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে সরকার এঁদেরই বলছে ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’! কিন্তু শাসক দলের জাতীয় মুখপাত্র, উল্কার মতো দলীয় রাজনীতিতে উত্থান যাঁর, বিপাকে পড়ে তাঁকে এভাবে সাধারণের দলে ফেলার চেষ্টা সফল হবে তো? বাস্তবে কিন্তু হচ্ছে না। তাঁকে শুধু গ্রেপ্তার করলেই চলবে না, নিতে হবে কঠোরতম ব্যবস্থা। মোদি সরকারের উপর চাপ কিন্তু ঘরে বাইরে বাড়ছেই।
দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে কান পাতলেই শোনা যায়, মোদি সরকারের গত আট বছরের কিস্সায় দিল্লিতে নুপূরের গুরুত্ব লাফিয়ে বাড়ার মুখরোচক কাহিনি। পেশায় আইনজীবী নূপুর শর্মার হাতেখড়ি প্রয়াত অরুণ জেটলির হাত ধরে। ইংরাজি ও হিন্দি, দুই ভাষাতেই কথা বলতে পারেন অনর্গল। তার জোরেই আর ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু জাতীয় মুখপাত্রই নয়, অমিত শাহের আশীর্বাদে তিনি দিল্লিতে এখন গেরুয়া শিবিরের অন্যতম মুখ। ওই যে অমিতজি ইদানীং প্রায়শই ‘ইতিহাস বদলে দেওয়ার’ কথা বলেন, সেই কর্মযজ্ঞের অন্যতম কুশীলব। স্বভাবতই ক্ষমতার অহঙ্কারে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন তিনি। কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ভোটও লড়েছেন। আর সেই সুবাদে ধর্মীয় বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার নোংরা তাস খেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের শীর্ষ মহলে তাঁর সমর্থকের অভাব নেই বলে শুধু এফআইআর করতেই লেগে গেল তিন সপ্তাহ। প্রমাণ হয়ে গেল, গ্রেপ্তার করতে মন চাইছে না সরকারের। অথচ গোটা দেশ শুধু তাঁর গ্রেপ্তারির দাবিতেই সোচ্চার নয়, চায় আরও কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। একটাই কথা সবার মুখে, বিদেশের কাছে গত ৭৫ বছরে এভাবে দেশের মাথা হেঁট করেনি আর কেউ। এমনভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়নি ভারত মাতার সম্মান। কিন্তু নূপুরকে একা দোষ দিলে তো হবে না। যে দলের ভোট রাজনীতিই বিদ্বেষ আর মেরুকরণের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে, সেখানে এই বেফাঁস মন্তব্য ও তার জেরে বারে বারে দেশজুড়ে অশান্তি তো অনিবার্য! এতে নাকি সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ক আরও সুরক্ষিত হয়। বাহ, ভারতের ভোটসর্বস্ব গণতন্ত্রের আজ কী নিদারুণ পরিণতি!
তবে মুখে যাই বলুন, যখন দেশে বিদেশে সরকারের ঢাক বাজানোর প্রস্তুতি সাড়া, তখন এই অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স মোদিজির পক্ষে মোটেই গৌরবের নয়। অর্থনীতি অনেক আগেই লাটে উঠেছে। এখন বিদেশ নীতির এমন ধ্বস্ত কঙ্কালসার চেহারাটাও বেআব্রু। ধাক্কা খেয়েছে সরকারি টাকায় ঘুরে ঘুরে বিদেশে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার খোয়াব। সৌদি আরব থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া। ইরান থেকে তুর্কমেনিস্তান। তুরস্ক থেকে মালয়েশিয়া। মুসলিম প্রধান তেল প্রাচুর্যে ভরা দেশগুলির সামনে মুখ পুড়েছে ভারতের। সবাই ডেকে ডেকে আমাদের কর্তব্যরত রাষ্ট্রদূতদের ‘চেতাবনি’ দিচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে। আর তা রুখতে বিদেশ মন্ত্রককে কার্যত ক্ষমা চাইতে হচ্ছে। এমন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পরিস্থিতি কবে দেখেছে দিল্লি। ভুললে চলবে না, শুধু দেশীয় পণ্য বিক্রি মার খাওয়াই নয়, ওই সব দেশে রুটি-রুজির প্রয়োজনে সংসার পেতে বসবাসও করছেন বহু ভারতীয়। তাঁদের নিরাপত্তার প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত। দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস গেরুয়া শাসকদলের মুখপাত্র এমন একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন যে, তাঁদের ওই সব দেশে থাকাই এখন দায়। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে কর্মরতরা কার্যত বিপন্ন। তাঁরা সবাই ফিরলে ভারত সরকার চাকরি, খাদ্য, বাসস্থানের দাবি পূরণ করতে পারবে তো!
আসলে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করতে করতে এ দলের নেতা নেত্রীরা ক্রমেই দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাচ্ছেন। সঙ্গে চব্বিশের ভোটের দিকে তাকিয়ে মেরুকরণের সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে ক্রমাগত শান দেওয়ার চেষ্টা। এও তো চূড়ান্ত দেশবিরোধী কাজেরই নামান্তর। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, নূপুর শর্মাজির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা কি দায়ের হবে? একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে ঘুরিয়ে পাকিস্তানের মতো দেশবিরোধী শক্তির হাতই শক্ত করছেন তিনি। এ তো চরম অপরাধ। অথচ এই অভিযোগে দেশের কোনও এজেন্সি তাঁকে ধরবে না। জেরা করবে না। নূপুর শর্মার বেফাঁস মন্তব্য তাই উন্নয়নকে হারিয়ে দেওয়ার তাড়নায় মেরুকরণের গেরুয়া ভোট রাজনীতিরই বিষময় ফল ছাড়া আর কিছুই নয়।
মোদিজি প্রায়শই অতীত, বিশেষত নেহরুর আমলের সব কিছুকে মুছে দেওয়ার কথা বলেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি ভুলে যান, ভারতের বিদেশ নীতির আত্মা লুকিয়ে আছে উপনিষদের‘বসুধৈব কুটুম্বকম’—এই শব্দবন্ধনীর মধ্যে। যার উপর দাঁড়িয়ে নেহরুজি রচনা করেছিলেন পঞ্চশীল নীতি। ১৯৫৪ সালের পঞ্চশীল নীতি ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছিল। সবাই সমীহের চোখে দেখত আমাদের। সেই মিলাবে, মিলিবের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে এমন ন্যক্কারজনক বিদ্বেষের বীজ বপনের রাজনীতিকে যে কোনও মূল্যে হারাতেই হবে। সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেশের আসল সমস্যা থেকে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টাকে কোনওমতেই সফল হতে দেওয়া যাবে না। দেশের মানুষকে এর বিরুদ্ধে একজোট হতেই হবে।
নরেন্দ্র মোদিজি সেবা, সুশাসন আর গরিব কল্যাণের উপরই তাঁর সরকারের ভিত্তিকে স্থাপন করার কথা দিয়েছিলেন। ‘সবকা সাথ, সবকা বিশ্বাস’ সেই প্রতিশ্রুতিরই নামান্তর। কিন্তু বাস্তবে তাঁর সরকার সেই আদর্শ থেকে আজ সরে গিয়েছে বহু যোজন দূরে। আশ্বাস শুধু কথার কথা হয়েই থেকে গিয়েছে। আজ থেকে দু’দশক আগে গুজরাত দাঙ্গার সময় তাঁকে কঠোর হাতে রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি। মোদিজির সামনে এবার শাসকের ধর্ম পালনের আরও এক সুবর্ণ সুযোগ। তাঁর সিংহাসন সুরক্ষিত থাকলেও সব ধর্মের প্রতি সমান ব্যবহার না করলে, ইতিহাস কিন্তু তাঁকে ক্ষমা ভবিষ্যতে করবে না। এটাই কিন্তু শেষ সুযোগ।