বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

গেরুয়া ভারতে মিডিয়ার
স্বাধীনতা! অলীক নয় তো?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

কৌতূহলী চোখগুলো তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। কানাঘুষো চলছে, ‘ম্যাডামকে প্লেনে উঠতে দেয়নি!’ তারপরই প্রশ্ন, ‘কেন?’... ‘কে এই মেয়েটা?’... ‘কী করেছে?’ ...‘টেররিস্ট নাকি?’ প্রশ্নগুলো কানে এসে ধাক্কা মারছে, আর শামুকের মতো গুটিয়ে যাচ্ছেন রানা আয়ুব। টেররিস্ট নন। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক। গত ২৯ মার্চের আগে তেমন কেউ চিনত না মেয়েটিকে। ওয়াশিংটন পোস্ট হাতেগোনা যে ক’জন পড়েন, তাঁদের কেউ কেউ জেনেছিলেন নামটা—নরেন্দ্র মোদির ভয়ানক সমালোচক। ব্লগে, কলামে ঢালাও কটাক্ষ তাঁর ভারতের বিজেপি সরকারকে। এর বেশি কিছু নয়। মুম্বই বিমানবন্দরের ঘটনা সেলিব্রিটি করে দিল এক সাংবাদিককে। লোকে দেখল, রানা আয়ুব বাথরুমে গেলেও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে ইমিগ্রেশন অফিসার। আয়ুব বলছেন, ‘আমার পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস সব আপনাদের কাছে। পালাতে পারব? তাহলে আমাকে এভাবে পাহারা দেওয়ার কারণ কী?’ উত্তর দেননি ইমিগ্রেশন অফিসার। রানা আয়ুবের বিরুদ্ধে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। ইডির সমন আছে। যদিও সেই সমন ই-মেলে এই মহিলা সাংবাদিকের কাছে পৌঁছনোর আগে বহু মিডিয়া গ্রুপে ভাইরাল... এমনই তার গোপনীয়তা। আয়ুব তারপরও সহযোগিতা করেছেন, ১২ ঘণ্টা জেরা সামলেছেন। কিন্তু দেশ ছাড়তে পারেননি। 
কী করেছিলেন আয়ুব? প্রথমত, লিখেছিলেন একটি বই, ‘গুজরাত ফাইলস: অ্যানাটমি অব আ কভার আপ’। তার জন্য গুজরাত ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। রেকর্ড করেছিলেন ২০০২ সালের দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার পুলিস অফিসার, আমলা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বয়ান। দ্বিতীয়ত, প্রবীণ এক মুসলিম নাগরিককে অটোরিকশয় তুলে নিয়ে গিয়ে বেদম মার এবং জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করার প্রতিবাদে টুইট। যোগী আদিত্যনাথের পুলিস অবশ্য সে জন্য আয়ুব সহ তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআরও করেছে। তৃতীয়ত, হিজাব বিতর্কে মন্তব্য। সেবারও এফআইআর হয়েছে। করেছে কর্ণাটক পুলিস। অর্থাৎ দু’টি রাজ্যে এফআইআর, আর দু’জায়গাতেই শাসক বিজেপি। 
রানা আয়ুব সত্যিই দোষী? অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দু’পক্ষই তাঁদের যুক্তির পক্ষে জোর সওয়াল করবে। কিন্তু কোথায় একটা যেন খটকা লেগেই থাকবে... বিজেপিই তাঁর বিরুদ্ধে এমন খড়্গহস্ত কেন? আর শুধুই কি রানা আয়ুব? নরেন্দ্র মোদি জমানায় একের পর এক সাংবাদিককে দাঁড় করানো হয়েছে কাঠগড়ায়। দায়ের হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। রাস্তাঘাটে ‘দুষ্কৃতী’রা ঘিরে ধরেছে, শাসিয়েছে, মেরেছে। তাই আন্তর্জাতিক সমীক্ষা যখন ভারতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিপন্ন বলে ঘোষণা করে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে না। পরিসংখ্যানটা কিন্তু রীতিমতো উদ্বেগজনক। বিশ্ব সংবাদ স্বাধীনতা সূচক (ডব্লুপিএফআই) অনুযায়ী, ১৪২ নম্বর থেকে আট ধাপ নীচে নেমে গিয়েছে মোদির ভারত। অর্থাৎ, ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১৫০। আর সেটা হয়েছে এক বছরের মধ্যে। সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। প্রথম তিনটি পিলার হল, প্রশাসন, আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থা। সাংবাদিকরা এই তিন স্তম্ভের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধন করেন। সরকারের ভুল-ত্রুটি, অর্থনীতি, মানুষের চাওয়া-পাওয়া ফুটে ওঠে তাঁদের প্রতিবেদনে। তাই কোনও সরকার যদি মিডিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, তা কখনও গণতন্ত্রের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়। আন্তর্জাতিক মহল বলছে, এমনটাই হচ্ছে ভারতে। এখানে হাতরাসের নৃশংস ধর্ষণ নিয়ে কলম ধরার জন্য জেলে যেতে হয়েছে সিদ্দিক কাপ্পানকে। পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার চার্জশিট দিয়েছিল পুলিস। জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কাপ্পানের লেখা ৩৬টি প্রতিবেদন। আশ্চর্যের বিষয় হল, চার্জশিটে কিন্তু একবারও বলা হয়নি যে, তাঁর খবর মিথ্যা। বরং দাবি করা হয়েছিল, কাপ্পান প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, যা সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর। ২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে জেলে আসিফ সুলতান। অপরাধ? কাশ্মীরের অশান্তি নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। প্রতিবাদ করেছিলেন প্রশাসনিক ব্যর্থতার। তাই জেলই তাঁর ঠিকানা। জামিন পেয়েছেন। তাও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ‘সরকার’ জানিয়েছে, পাবলিকের নিরাপত্তার খাতিরে গ্রেপ্তার করে রাখা হবে আসিফকে। এছাড়াও রয়েছেন মির ফয়জল বা শ্যাম মীরা সিং। ত্রিপুরার অশান্তি নিয়ে সোশ্যাল মাধ্যমে পোস্ট করায় তাঁরাও মোদি জমানায় রাষ্ট্রদ্রোহী। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বা আরএসএফের দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর ড্যানিয়েল সম্প্রতি বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর তাঁর দল এবং মিডিয়া হাউসগুলির মধ্যে একটা ভালোরকম সমঝোতার ব্রিজ তৈরি হয়েছে। ভারতে অধিকাংশ বড় সংবাদমাধ্যমের মাথাতেই প্রভাবশালীরা বসে আছেন। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলে সেই খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল সরকারের বিরুদ্ধে লিখবে না। যারা লিখবে, তাদের উপর পড়বে কোপ। বিজেপির বিশ্বাস, তারা দলের সঙ্গে ভক্তদের সম্পর্ক নষ্ট করছে। তাই বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলেই এই দেশে দেশদ্রোহী হয়ে যেতে হয় বা মর্মান্তিক পরিণতি হয়। উদাহরণ? গৌরী লঙ্কেশ।’ 
সূচক অনুযায়ী রাশিয়া ও চীনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ভারত। ওই দু’টি দেশের সংবাদ স্বাধীনতার হাল অবশ্য আরও শোচনীয়। তালিকায় ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রয়েছে ১৫৫ নম্বরে, আর কমিউনিস্ট চীন ১৭৫। অনলাইন মিডিয়া হলে তাদের জন্য এখন পর্দার আড়ালে থাকে অভিনব ‘ফায়ারওয়াল’। সরকারের অপছন্দের কোনও প্রতিবেদন আর প্রকাশিত হয় না। কিংবা তার মেয়াদ থাকে মেরেকেটে এক ঘণ্টার। তারপর স্রেফ উধাও হয়ে যায় খবরটা। বিশ্বে প্রায় ৩০০ সাংবাদিক এখন জেলবন্দি। ভারতে সংখ্যাটা ১৩। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গিয়েছেন একজন সাংবাদিক। মোদি সরকার অবশ্য এসব মানতে নারাজ। আরএসএফের এই সমীক্ষা নিয়েও তাদের বিস্তর আপত্তি আছে। আর তাই এই দাবি ‘মানছি না, মানব না’। আন্তর্জাতিক মহল অবশ্য এই ওজরে গা করছে না। তাদের কাছে ভারতের মুখ যা পোড়ার পুড়েছে। গুপ্তচরবৃত্তি চলছে সাংবাদিকদের উপর। ফোনে হানা দিচ্ছে পেগাসাস। কথপোকথন, মেসেজ চলে যাচ্ছে এজেন্সির ভল্টে। তারপর শুরু হচ্ছে ঘুঁটি সাজানো। গণতন্ত্রের এই স্তম্ভই তখন হয়ে উঠছে গণতন্ত্রের ‘বিষ’। 
এই পরিস্থিতিতে একটাই প্রশ্ন ওঠে, স্বৈরাচারী শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতা কতটা নিরাপদ? ২০২০ সালের ইউনেস্কোর রিপোর্টই বলছে, সাংবাদিকতা করার বিপদ বিচার করলে বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে আসে ভারত। তার আগে আফগানিস্তান, মেক্সিকো, সিরিয়া, সোমালিয়া এবং ইয়েমেন। এই সব রাষ্ট্রে গলা টিপে খুন করা হয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে। আইনকে ব্যবহার করা হয় তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে। নির্দেশনামা জারি হয়, যেমন বলব, ঠিক তেমন খবর করতে হবে। এমন কিছু লেখা বা দেখানো যাবে না, যাতে রাষ্ট্রের কূটনীতি বা সম্মানে আঘাত লাগে। তাই চালাও প্রোপাগান্ডা। শাসকের নজরে ভালো সাজতে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। অন্যায় চলছে চলুক। কিচ্ছুটি বলা যাবে না, শোনা যাবে না, লেখাও যাবে না। সাংবাদিকদের হতে হবে গান্ধীজির নয়া তিন বাঁদর। তাঁদের বাজাতে হবে সরকারের ঢাক। 
সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসে সাংবাদিকরা। মধ্যবিত্ত পরিবার, সামান্য চাকরিজীবী। শাসকের পাহাড়প্রমাণ চাপ নেওয়ার মতো ক্ষমতা খুব বেশি নাগরিকের থাকে না। রানা আয়ুবের মতো মহিলাদের অশ্লীল মিম বা বিকৃত ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সোশ্যাল মাধ্যমে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখলেই বাজারি করে দেওয়া হয় তাঁকে। নেপথ্যচারীরা এতটুকু ভয় পায় না। তাদের বিশ্বাস, মাথার উপর ছাতা আছে। সেই ছাতা সবচেয়ে শক্তিশালী। লাগাতার আঘাতে কেউ ভেঙে পড়ে, কেউ জলাঞ্জলি দেয় আদর্শকে। আর তারপরও সোজা মেরুদণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকলে নজরদারি কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা। 
স্বাধীনতাহীনতাই যে এযুগের সংবাদমাধ্যমের নিয়তি। আর ক্যাচলাইন? এখন একটাই—চুপ! গণতন্ত্র চলছে!

10th     May,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ