মিত্রোঁ মোদিজি, ভোটের সময় আপনি বাংলায় এসে বাংলায় কথা বলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে ভয়ঙ্কর ব্যুমেরাং হয়েছিল, তা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। অবশ্য আপনি ইচ্ছে করলেও কোনওদিন ভুলতে পারবেন না বাঙালির এই ধাক্কা। ভোটের লাগিয়া বাঙালি সাজিনু অনলে পুড়িয়া গেল। হ্যাঁ, বাংলার মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে আপনার স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন হয়েছে আর এক উৎপাত! এখানে আপনার পার্টি বিজেপির কোন্দল দেখে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে একটি প্রবাদ, ভিক্ষে চাই না মা, কুকুর সামলা।
মিত্রোঁ, রাজ্য বিজেপিতে যে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার খবর কী আপনি রাখেন? ভোটের সময় এসে রাজ্য বিজেপিকে আপনি পাম্প দিয়ে বাঘ বানিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ভোটের ফলপ্রকাশের পর সেই পাম্পের হাওয়া বেরিয়ে পড়েছে। এখন তাকে দেখলে চুপসানো বেড়াল ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। কেউ কেউ অবশ্য ম্যাও ম্যাও স্বরে হালুম ডাকের চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাতে কি আর বাঘের চরিত্র প্রকাশ পায়! আর এখন তো রাজ্যের পার্টি পুরোপুরি নরক গুলজার! টাকা ছড়িয়ে ভোট আদায়ের প্রক্রিয়া বানচাল হওয়ার পর বিজেপির ঘরে অশান্তির তীব্র আগুন। এ বলছে, তুই দল থেকে বেরো। আবার ও বলছে, তুই ভাগ। এক নোংরা সংস্কৃতির নগ্ন খেলা দেখছেন রাজ্যের মানুষ। তারই ফল বিজেপির ঘরে হু হু করে ভাঙন।
মিত্রোঁ, দুর্যোধন কৃষ্ণের কাছ থেকে অক্ষৌহিণী সেনা নিয়েও মহাভারতের যুদ্ধ জয় করতে পারেননি। সেখানে ভাড়াটে সেনা দিয়ে আপনি রাজ্য দখলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন মোহভঙ্গকারীদের শুধু যে ঘর ওয়াপসি শুরু হয়েছে তা নয়, আগমার্কা গেরুয়া সেনারাও শিবির ভেঙে ‘মায়ের কাছে’ আশ্রয় পেতে উৎসুক হয়ে উঠেছেন। বেশকিছু আসন নিয়েও রাজ্য বিজেপি এখনও পর্যন্ত যথাযথ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের একটি সদর্থক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার ধারেকাছেও বিজেপি বিধায়কদের দেখা যাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে কী, এখনও পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তাতে মুখচুন করে বসে থাকা ছাড়া বিজেপির আর কিছুই করার নেই। প্রতিটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মমতা একের পর এক পালন করে চলেছেন। রাজ্যের মানুষের পাশে তিনি বিপদে আপদে এসে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য এবং তাঁদের একটা সুস্থ জীবনযাপনের জন্য মমতা সচেষ্ট। এর কোনওটাই কিন্তু ১৫ লক্ষ টাকা গল্পের গুলতানি নয়, চমকের রাজনীতি নয়। তাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ৫০০ টাকা নিয়ে বিজেপি নেতাদের মশকরা করা ছাড়া আজ আর কিছুই করার নেই। অস্তিত্ব বজায় রাখতে তাঁদের এখন আন্দোলন খুঁজতে হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেট্রলের উপর থেকে কর কমানোর দাবি নিয়ে পথ অবরোধ করতে হচ্ছে, জেলায় জেলায় মিছিল করতে হচ্ছে।
মিত্রোঁ মোদিজি, আপনি বাড়িয়ে চলেছেন তেলের দাম, আর বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায় হল কি
না তেলের কর কমানো! অর্থাৎ আপনার ভাগের কড়ি আপনি সবটা গিলে খাবেন, আর আত্মত্যাগ করতে হবে রাজ্যগুলিকে! যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় কেন্দ্র অনেকটা অভিভাবকের মতো। কিন্তু কেন্দ্রের মাৎস্যন্যায় নীতিতে রাজ্যগুলির বেহাল অবস্থা হয়েছে। গেরুয়া রাজ্যগুলি যে সুবিধা পায়, বিরোধী রাজ্যগুলি সেই সুবিধা পায় না।
বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ তো একেবারে অসত্য নয়। মিত্রোঁ, আর একটি প্রসঙ্গ উঠে আসবেই। সেটা হল নোটবন্দি তথা আপনার একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপের পাঁচ বছর পূর্তি। ডিমনিটাইজেশনের অভিশাপ তো এখনও আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এই ভুলে কার সুবিধা হয়েছে, এখন মানুষ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেন। একটাও কালো টাকা ধরা পড়েনি। অথচ এই কৌশলে কাদের কালো টাকা সাদা হয়ে গেল, তার সবটুকু জানা যায়নি। তবে কয়েক বছরের মধ্যে বহু শিল্পপতির বার্ষিক আয় দ্বিগুণ, পাঁচগুণ হয়ে গিয়েছে, এটা আমরা দেখেছি। দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, সেদিনের ‘ভুল’ কি তবে আপনার ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল? কান পেতে শুনুন, দেশের মানুষের সেই ‘মন কি বাত’।
ডিমনিটাইজেশনের সেই ভয়ঙ্কর কালো দিনগুলি আমরা পেরিয়ে এসেছি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশের ৫০০ এবং হাজার টাকার নোট বাতিল করে দিয়ে আপনি মানুষকে বিপন্ন করে তুললেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনি ৮৭ শতাংশ টাকাকে অচল করে দিয়ে দেশকে এক বিশাল গাড্ডার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে যেন দেশের অর্থনীতির বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল মত্ত এক হাতি। সেই মত্ততার কোনও অভিমুখ ছিল না, বুদ্ধিমত্তা ছিল না, কোনও নৈতিক পরিকল্পনাও ছিল না। তার ফল চরমভাবে ভুগতে হয়েছিল দেশের নিচুতলার মানুষকে। তাঁরা প্রথমদিকে সেদিন উল্লসিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, আপনি বুঝি সত্যিই কালো টাকার শিকারে বেরিয়েছেন। কিন্তু অচিরেই তাঁদের ভুল ভাঙল, বুঝতে পারলেন, আসলে সবই ছায়ার খেলা! এসব বুঝতে বুঝতেই টাকার লাইনে দাঁড়িয়ে অর্থচিন্তায় কত মানুষের প্রাণ গেল। লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়লেন রাস্তার উপরেই। এর কোনও পরিসংখ্যান আপনার কাছে নেই, মিত্রোঁ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মৃতদের মধ্যে একজনও বড়লোক ছিলেন না। আপনার সিদ্ধান্তে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দেশের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলেছিলেন, এটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা দেশে যেটুকু কালো টাকা হার্ড ক্যাশ রূপে আছে, তার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। বাকিটা রয়ে গিয়েছে রিয়েল এস্টেট, সোনা, অ্যাসেট ইত্যাদি রূপে। আপনার লক্ষ্য ছিল কালো টাকা উদ্ধার, জাল টাকার বিনাশ এবং ক্যাশলেস ইকোনমি। কালো টাকা উদ্ধার হয়নি, জাল টাকার ব্যাপারেও কোনও তথ্য মেলেনি।
আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই দেওয়া এক সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ডিজিটাল লেনদেন বাড়লেও নোট লেনদেন কিন্তু তুলনায় আরও বেড়েছে। সুতরাং সেই লক্ষ্যও পূরণ হয়নি।
প্রতিবারই আপনি একটা এমন খেলা দেখানোর চেষ্টা করেন যে মনে হয়, আপনি ভোজবাজির খেলা দেখাতে নেমেছেন। সব কাজে গিমিক দেখানোর নেশাটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটা খেলা মাত্র। কিন্তু আপনার প্রতিটি খেলাই শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে ট্রাজেডি হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লকডাউন ঘোষণা করে দেশের কোটি কোটি মানুষকে বিপন্ন করে তুললেন। পথের মধ্যেই শত শত মানুষের প্রাণ গেল। কোনও পরিকল্পনা নেই, কোনও সুষ্ঠু ভাবনাচিন্তা নেই। অগ্রপশ্চাৎ না ভাবার কারণে এক একটি সিদ্ধান্তের জন্য শত শত মানুষকে প্রাণ দিয়ে তার মূল্য চোকাতে হয়েছে।
অথচ মিত্রোঁ, আপনি অনায়াসে বলে যান দেশের মানুষকে আপনি ব্যাঙ্ক, বিমা এসব চিনিয়েছেন। আপনি জনধন প্রকল্প নামে একটি অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছিলেন গরিবের নামে। তার কিন্তু অনেকগুলি আজ মৃত বা নিষ্ক্রিয়। আপনি দাবি করেছেন, আপনার সময়ে ব্যাঙ্কে কর্মীসংখ্যা বেড়েছে। এটাও একটা ভুল তথ্য। আপনার সময়ে দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের সবথেকে কুৎসিত চেহারা হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণ করে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে একটা অহেতুক জটিলতা তৈরি করেছেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের সংগঠনই বলছে, এখন সেই সেক্টরে কর্মীসংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
অবশ্য এসব শুনে অনেক ভবি ভুলে যান। যেখানে যুক্তির অবকাশ থাকে না, সেখানে হয়তো প্রাপ্তির তাগিদটা বা প্রত্যাশা বেশি থাকে। তাই এসব মৃত্যুর কথা কঙ্গনাজির মনে আসেনি। তাই তিনি গদগদ হয়ে বলে দিতে পারেন, ২০১৪ সালে দেশের স্বাধীনতা এসেছে। শহিদের রক্তকে এভাবে অপমান করার স্পর্ধা দেখানোর পর, অপমান করার পরও তাঁর কোল ভরে ওঠে অসংখ্য সরকারি পুরস্কার ও সম্মানে। তখনই বোঝা যায়, উদ্দেশ্য এবং বিধেয় এক জায়গায় মিলে গেল। তবে, আপনার আমলে স্বাধীনতা এসেছে বললেই যদি পদ্মশ্রী পাওয়া যায়, তাহলে একদিন লোক হামলে পড়ে বলবেন, আপনিই স্বাধীনতার রূপকার। সেই বিকৃতির পুরস্কার হিসেবে দেখা যাবে ঘরে ঘরে পদ্মশ্রী। অন্ন দিতে না পারেন, মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি না করতে পারেন, কিন্তু পদ্মশ্রী দেওয়ার ক্ষমতাটা তো আপনারই হাতে!
মিত্রোঁ, শুধু নিজের ‘মন কি বাত’ বলাটাই সংস্কৃতি নয়। দেশের মানুষের ‘মন কি বাত’ও আপনার শোনা দরকার। নাহলে বুঝবেন কী করে, কী আছে তাঁর মনের ভিতর? অহং কাটিয়ে সেটা শোনার চেষ্টা করাটাও শাসকের কাজ।