বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এ নরেন সে নরেন নয়!
মৃণালকান্তি দাস

বিশ্বকে মানবতার মূল্য শিখিয়েছিলেন স্বামীজি...
তারিখটি ছিল ৯/১১। শিকাগো ভাষণের বর্ষপূর্তিতে স্বামী বিবেকানন্দকে স্মরণ করে এমনই মন্তব্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি বলেছিলেন, মানবতার মূল্য বুঝতে আজও ১৮৯৩ সালের সেই বক্তৃতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী বেলুড় মঠের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে থাকা স্বামীজির বাণী সংযুক্ত করেছিলেন নিজের টুইটে।
সেদিন মোদিজির মুখে শোনা গিয়েছিল এমন সব কথা, যার সঙ্গে তাঁর কৃতকর্মের কোনও মিল খুঁজে পাবেন না। স্বামীজির বাণী স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস এই সুন্দর পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এককালে। যার দৌলতে হিংসার দাপট দেখেছে বিশ্ব। বহু সভ্যতা ধবংস হয়েছে। রক্তের বন্যা বয়েছে। গোটা বিশ্ব নৃশংসতা চাক্ষুষ করেছে। তবে মানব সভ্যতা ওই ইতিহাস পেরিয়ে এসেছে। আজ অনেক ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা।’
ভাবুন কী ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার!
এই সেই প্রধানমন্ত্রী, যাঁর জমানায় ঘটে গিয়েছে দিল্লির ভয়াবহ দাঙ্গা। অসম, উত্তরপ্রদেশে থামে না রক্তপাত। বাংলায় বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসেও কম উস্কানি ছিল না তাঁর ভাষণে। ‘সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস’ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বঙ্গবাসী। গতবছর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই বলেছিলেন, এক নরেন্দ্র (দত্ত) যে একবিংশ শতকের ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পূরণ করছেন আর এক নরেন্দ্র (মোদি)। ‘গরিবের মসিহা’, ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পথ প্রদর্শক’, ‘দেশের চৌকিদার’, ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ রদে দৃঢ়সঙ্কল্প নেতা’, ‘লাদাখ-লে-তে সেনার সামনে শৌর্যের প্রতিমূর্তি’ আবার ‘অযোধ্যায় রামলালার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণামে ভক্তি ভাবে চূর’— বর্ণনা অফুরান। ক্ষমতাবানের ভজনা ও স্তুতি এ দেশের রাজনীতিতে গা-সওয়া। কিন্তু মোদিজি এবং তাঁর বাহিনী কতটা বিবেকানন্দ চর্চা করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিবেকানন্দের বেদান্ত খুব সহজ, সরল। মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশসাধনই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। সব কাজের মাধ্যমে এই সুপ্ত দেবতার ক্রমবিকাশ ঘটবে। শুদ্ধ কাজ চাই, অলস চিন্তা নয়। এই ‘শিবত্ব’ই জগতের সব কিছুকে যুক্ত করেছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে, বহুরূপে সম্মুখে তোমার, সেই দেবতাকে ছেড়ে অন্য কোথায় ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াও! শিবের অন্বেষণ জীবের ভিতরেই করতে হবে। বলতেন স্বামীজি। বিবেকানন্দ ছিলেন এই তত্ত্বের সিদ্ধপুরুষ। ‘সেবা’ তাঁর কাছে ‘মুক্তি’র উপায়। তিনি বলতেন, সেই সময়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে আমরা মাথা বিকিয়ে দিয়েছিলাম, ফলস্বরূপ ভয়ানক দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা নিয়েছিলাম। আত্মশ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস বলে কিছু ছিল না। দেশ ছিল লজ্জিত, আত্মগ্লানিতে দীর্ণ। স্বামীজির কর্মে ভারত জেগে উঠেছিল নতুন এক ধর্মে। সে ধর্ম কাউকে পাপী বলে না।
বেলুড়ে এসে একাধিক রাত কাটিয়েও এই শিক্ষা এখনও রপ্ত করতে পারলেন না দেশের প্রধানমন্ত্রী! গোটা দেশকে বিকিয়ে দিয়ে কোন দেবতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছেন তা মোদিই জানেন। কৃষকদের উপর দিনের পর দিন আক্রমণ তাঁকে কোন ‘শিবত্ব’-এর খোঁজ দেয়, তা প্রধানমন্ত্রীই জানেন। মন্দির গড়া আর দেশের সম্পদ বেচাই যদি হয় তাঁর ধর্ম, তাহলে ইতিহাস একদিন বলবে, নরেন্দ্র মোদির কর্মই দেশকে ফিরিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতাপূর্বের লজ্জা, আত্মগ্লানি। তাঁর দেশের সম্পত্তি বেচা আর পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে মাথা বিকিয়ে দেওয়া একই। 
১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩। সে দিন স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম মহাসভায় দুই ব্যাঙের গল্প বলেছিলেন। কুয়োর ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের এক সত্যি উপকথা। সমুদ্রের ব্যাঙ কুয়োয় এসে পড়েছে। কুয়োর ব্যাঙ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আসছ হে?’ ‘সমুদ্র থেকে।’ এ কথা শুনে কূপমণ্ডূক বললে, ‘কত বড়ো তোমার সমুদ্র? আমার কুয়োর মতো বুঝি?’ সমুদ্র থেকে আসা ব্যাঙ তো অবাক। বললে, ‘ভাই রে, সমুদ্রের সঙ্গে কি কুয়োর তুলনা চলে?’ কুয়োর ব্যাঙ অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করল না, রেগে গেল। শেষে বলল, ‘যাও যাও। আমার কুয়োর থেকে কোনও কিছুই বড় হতে পারে না। মিথ্যেবাদী তুমি। যাও বেরিয়ে যাও।’ গল্পটা শুনিয়ে বিবেকানন্দ বললেন, ‘এই হল সব সমস্যার মূল। আমি হিন্দু। আমার নিজের ছোট্ট কুয়োয় বসে ভাবি গোটা পৃথিবীই বুঝি আমার কুয়োর মতো ছোট।’
না, গোটা পৃথিবী কুয়োর মতো ছোট হতে পারে না। কিন্তু সঙ্কীর্ণমনা ধর্মধ্বজীরা তা-ই ভাবেন। শুধু ধর্মধ্বজীরাই বা কেন, উগ্র জাতীয়তাবাদীরাও তাই ভাবেন— তারপর নিজেদের নিরাপদ ক্ষুদ্র স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে উদার মানুষদের ঘাড় ধরে মিথ্যেবাদী বলে কোতল করতে চান। দেশের মানুষকে ভয় দেখাতে চান।
তাকিয়ে দেখুন, গত কয়েক বছরে ভারতীয় রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এবং, তা মূলত সাঙাতদের পাইয়ে দেওয়ার খেলায় পরিণত হয়েছে। ‘দেশ সেবার প্রবক্তা’ মোদি জমানায় ব্যাঙ্কে সুদের হার কমেছে ভীষণ ভাবে। দেশের সব সংস্থাকে বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করার ভয় তো তাঁরই সৃষ্টি। ভারতীয় অর্থনীতির নতুন জীবনাদর্শ নিয়ে আমরা সতত দুশ্চিন্তায় ভুগছি। পেট্রল, রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া। অনিশ্চিত আশঙ্কায় মধ্যবিত্ত একেবারে ভালো নেই। মোদির মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে বড় কর্পোরেট সংস্থা। গরিবের জন্য বরাদ্দ শুধুই গালভরা স্লোগান। মোদি জমানায় ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। আধপেট খাবার খেয়ে রাত কাটায় গরিব ভারত। আর মোদিজি? জাতীয়তাবাদের গল্পে বিভোর করে রেখেছেন গোটা দেশবাসীকে। অবিশ্রান্ত মিথ্যাভাষণ ‘দৈববাণী’ হয়ে উঠছে।
বেলুড়ে এসে মোদিজি কি শুনেছিলেন স্বামীজির সেই অমোঘ বচন: তাঁর চেয়ে সেরা কেউ হতেই পারে না। এই আত্মরতি মানুষকে সঙ্কীর্ণ করে, হিংসুটে উন্মাদবৎ করে তোলে। এই আত্মরতি উদগ্র দেশপ্রেমীদের যুদ্ধবাজ করে তোলে, এই আত্মরতি ধর্মোন্মাদদের সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। এই আত্মরতি আসলে নিজের সম্পর্কে এক রকম নিরাপত্তাহীন হীনতার বোধ থেকে জেগে ওঠে। হয়তো তাই। নাহলে রোমের বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন আটকে দিল মোদিজির বিদেশমন্ত্রক? একরাশ ক্ষোভ উগরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা গেলেন, তবে আমাকে কেন রোম যেতে দেওয়া হল না? প্রতিহিংসাবশতই আমাকে আটকানো হল। এই সফরের সঙ্গে দেশের সম্মান জড়িত ছিল।’ আসলে আত্মরতিপরায়ণ মানুষ নিজেকে জগৎসেরা বলে ভাবতে ভালোবাসেন। অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন।
স্বামীজিকে গোঁড়া বলে দখল করা কিংবা নিতান্ত ধর্মভাবুক বলে বাতিল করা— দু’টিই ওই কুয়োর ব্যাঙের দৃষ্টি। এই কুয়োর ব্যাঙরাই হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে জোরদার করার জন্য হিন্দুধর্ম ও হিন্দুর সংস্কৃতিকে একটি অসহিষ্ণু, পিতৃতান্ত্রিক, বৈচিত্র্য-বিরোধী ও হিংস্র চেহারা দিয়ে একটি ক্ষমতাস্পর্ধী ‘হিন্দু’ জাতি গড়ে তুলতে চায়। সমস্ত দেশজুড়ে এক অখণ্ড হিন্দু জাতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এরাই তো মারমুখী হিন্দুত্বকে শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছেন। এরাই তো বলে, এটা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দেশ। সংখ্যালঘুরা এমন ভাব কোরো না, যেন এটা তোমাদেরও দেশ। যদি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারো, তা হলে অবশ্যই এখানে থাকবে। কিন্তু কোনও রকম বাড়াবাড়ি, ট্যাঁ ফোঁ চলবে না। আশ্চর্যের কথা কী জানেন, বিদেশে আমরা সংখ্যালঘু হিসেবে যখন এই ব্যবহার পাই, তখন একবাক্যে তাকে জাতিবিদ্বেষ বলে নিন্দে করি। কিন্তু সংখ্যালঘু মানুষ যখন পুরুষানুক্রমে পশ্চিমবঙ্গবাসী, যখন তাঁর নাগরিকত্ব ভারতীয়, আর মাতৃভাষা বাংলা, তখন? তখন এই বিশেষ বিদ্বেষ-বিষ কার? সংখ্যালঘুর না সংখ্যাগুরুর? অমিত শাহরা কী বলবেন জানি না।
তবে স্বামীজি বলতেন: আমরা মানব-জাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই— যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে। আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই...
এই যে ধর্মের ছাঁচ ভাঙা বিবেকানন্দ, তিনি কিন্তু গভীর ভাবে স্বদেশব্রতী। তিনি চান না হিন্দুরা ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করুন। বস্তুতপক্ষে তিনি যে কোনও মানুষেরই ধর্মনাশের বিপক্ষে। মুসলিম বা খ্রিস্টানদের হিন্দুভাবাপন্ন হতে হবে এমন কথাও তিনি বলেন না। বলবেনই বা কেন? রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য তিনি। রামকৃষ্ণদেব তো ইসলাম ও খ্রিস্টান এই দুই পন্থাতেও সাধনা করেছিলেন। দেশের বহুত্বকে তিনি অবজ্ঞা করেননি। হয়তো তাই জাতি ও ধর্ম নিয়ে বৈষম্যের সামান্যতম ইঙ্গিত, কোনও রকমের গোঁড়ামি স্বামীজি বরদাস্ত করতে পারতেন না। কঠোর স্বরে তিনি বলতেন, ‘আমি সন্ন্যাসী। যাদের পতিত বলে মনে করা হয়, আমি সেই মেথরদের সঙ্গেও বসে খেতে পারি। ভগবানের ভয় করি না, কারণ এতে তাঁর অনুমোদন আছে। শাস্ত্রের ভয় করি না, কারণ এতে শাস্ত্রও অনুমতি দিয়েছে। তবে আপনাদের ও আপনাদের সমাজের একটা ভয় আছে বটে! আপনারা তো আর ভগবান ও শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু জানেন না। সব স্থানে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবের মধ্যেও আমি ব্রহ্মের প্রকাশ দেখতে পাই। আমার দৃষ্টিতে উঁচু-নিচু ভেদ নেই!’’
মুখে যাই বলুন— মোদিজি, অমিত শাহদের স্বামীজির সেই মহান ধর্মের দুয়ারে পৌঁছতে ঢের পথ বাকি!

7th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ