বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের
সমন্বয়েই শরৎ ঋতু
জয়ন্ত কুশারী 

পুব আকাশে নিত্যদিন বিরাজ করেন জ্যোতির্ময় সূর্যদেব। তাঁরই নিত্য লীলায় আসে দিন। আসে রাত্রি। আলো-আঁধারীর আবর্তনে জীবের জীবনযাত্রাতেও আসে বৈচিত্র্যের স্বাদ। দিবাভাগের কর্ম ক্লান্ত ব্যস্ততার পরে বিশ্রামের বিরতি নিয়ে আসে রাত্রি। এইভাবেই কেটে যায় দিন। দিনের পর মাস। মাসের পর বছর। এ তো গেল, সাধারণ মানুষের জীবনধারা। 
কিন্তু ক্রান্তদর্শী প্রাজ্ঞ ঋষিরা এর মধ্যেই দেখতে পেলেন তিথি, নক্ষত্র, বার, পক্ষ, আর অয়নকে। এল পূর্ণিমা, অমাবস্যা, প্রতিপদ প্রভৃতি ষোলোটি তিথি। এল কৃত্তিকা প্রমুখ সাতাশটি নক্ষত্র। রবি ইত্যাদি সাতটি বার। হল পক্ষের পরিবর্তন। অয়নের অতিক্রম। এল শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ। একে একে  উত্তরায়ণ আর দক্ষিণায়ন এসে পড়ে। ধরিত্রীর বুকে যেমন উত্তরায়ণ পর্বের পরবর্তী অধ্যায়ে আবির্ভূত হয় দক্ষিণায়ন। ঠিক তেমনই সূর্যদেবের জীবনের দুটি পর্বের অবস্থা ও অবস্থানগত পরিবর্তনের প্রতীক এই অয়নদ্বয়ের পরিবর্তন। 
যিনি এই ধরণীর দিন ও রাত্রির নিয়ামক। যাঁর কিরণে প্রতিভাত হয় দিনের আলো। আর অস্ত গমনের পরে দিনান্তে নেমে আসে রাতের আঁধার। সেই ভাস্করদেবের জীবনপথও পরিবর্তিত হল দুটি ভিন্ন পথে। বিশ্ববিধাতার অমোঘ বিধানকে শিরোধার্য করেই। মাঘ থেকে আষাঢ় —এই ছয় মাস উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ হল দেবতাদের দিনের বেলা। সেই উত্তরায়ণের দিনগুলিতে উত্তরাভিমুখী হলেন সূর্যদেব। সূর্যদেবের এই সময়ের দিনগুলি কাটে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সংজ্ঞা দেবীর সঙ্গে। শ্রাবণ থেকে পৌষ এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন। দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত্রিবেলা। দক্ষিণায়নের আগমনে দেব দিবাকর তাঁর তেজোদীপ্ত বীর্যবর্তাকে পরিতৃপ্ত করতে ছায়া দেবীকে করলেন জীবনসঙ্গিনী।  তপন তেজের উগ্র প্রখরতা প্রশমিত হল শান্ত স্নিগ্ধ ছায়ার আচ্ছাদনে। রাতের আঁধারের ঘন ছায়ায় গভীর নিদ্রামগ্ন হলেন দেবতারা। 
এল ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি। দক্ষিণায়নের এই বিশেষ অন্তিম তিথিটি স্বাভাবিক নিয়মে অমাবস্যা হলেও এটি ‘মহালয়া’ নামে  বেশি পরিচিত। শাস্ত্রে বিশেষ এই পক্ষটিকে ‘অশ্বযুক্ কৃষ্ণপক্ষ’ বলা হয়েছে। সপ্ত অশ্ববাহিত রথেই সূর্যের গমনাগমন। এই পক্ষের সঙ্গে সূর্যের সম্পর্কটি যে নিবিড়, তা ‘অশ্বযুক’ শব্দটির ব্যবহারে স্পষ্ট হয়। ‘অশ্ব’ কথাটি এখানে সূর্যেরই দ্যোতক। মহালয়া শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখা যায়, এই ভাবে। মহান্ আলয়ঃ যত্র ইতি মহালয়ঃ। স্ত্রীলিঙ্গে আ যোগে মহালয়া। উক্ত পুরাণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মহান্ শব্দে ঋষিগণ বা পিতৃগণ। আলয়ঃ শব্দে রৌদ্রতীর্থ। সূর্যের তেজ ও আলোয় বিশ্ববাসী পান প্রাণের স্পর্শ। সেই প্রাণের স্পন্দন পেতে পিতৃগণ বা ঋষিগণ এসময় হন রৌদ্রতীর্থগামী। দক্ষিণাভিমুখী। যা সূর্যের এ সময়ের গতিপথ। 
আবার মহালয়া শব্দটির ব্যুৎপত্তি অন্যভাবেও করা যায়। মহতো  পিতৃপক্ষস্য লয়ঃ যত্র ইতি মহালয়ঃ। স্ত্রীলিঙ্গে আ যোগ করলে মহালয়া শব্দটি পাই। অর্থাৎ অশ্বযুক্ কৃষ্ণপক্ষের বা পিতৃপক্ষের অবসান যেখানে বা যে তিথিতে। এই কথার প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্নও কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবে  এসে যাবে। যার (যে তিথির) অবসান আছে তার (সেই তিথির বা পক্ষের) উদয়ও নিশ্চয় আছে? উত্তরে শাস্ত্র বলছে, ভাদ্র কৃষ্ণা প্রতিপদ হল উক্ত পক্ষের উদয়তিথি। মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষে (আশ্বিনের শুক্ল প্রতিপদ থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত) যেমন দেবীপূজন পিতৃপক্ষেও তেমন পিতৃপূজনের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। 
শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পক্ষযুগল ও তাদের পুজো-পদ্ধতির প্রয়োগগত দিকগুলির মধ্যে অনেকক্ষেত্রে ফারাক আছে। ফারাক আছে উভয়ের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও। পিতৃপক্ষটি কৃষ্ণপক্ষবিহিত। তাই একে অশ্বযুক্ কৃষ্ণপক্ষ বলা হয়। দেবীপক্ষটি শুক্লপক্ষীয় হওয়ায সঙ্কল্পবাক্যে শুক্লপক্ষ কথাটি উল্লেখ করা হয়। বাবা বেঁচে থাকলে পিতৃর পক্ষে যে পিতৃপূজন অর্থাৎ শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যাবে না। দেবীপুজোর ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। রীতি অনুসারে পিতৃপূজন বা শ্রাদ্ধ-তর্পণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ দিকটি বেছে নেওয়া হয়েছে। দেবী দুর্গার পুজোর জন্য শাস্ত্র উত্তর অথবা পূর্ব দিকটি নির্দিষ্ট করেছে। এরকম অনেক অমিল থাকলেও মিলও রয়েছে বহু ক্ষেত্রে। যমন, পিতৃ ও দেবী দুর্গার পুজো তিথি মেনে হয়। তাই এদের তিথিকৃত্য বলা হয়েছে। শারদীয়া দুর্গা পুজোর সাতটি কল্পের কথা বলা হয়েছে দুর্গোৎসব তত্ত্বে। সামর্থ্য ও  অভিরুচি অনুযায়ী যে কোনও একটি কল্প  অবলম্বন করে এই পুজো করা যায়। পিতৃপূজনের ক্ষেত্রে এই পক্ষেও ছয়টি কল্পের যে কোনও একটিকে অবলম্বন করে শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যায়। 
শাস্ত্র বলছে ‘অশ্বযুক্ কৃষ্ণপক্ষে তু শ্রাদ্ধং কুর্যাৎ দিনে দিনে।’ অশ্বযুক্ কৃষ্ণপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষে প্রতিদিন পার্বণ বিধিতে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার কথা বলা হয়েছে। অসমর্থ হলে ‘ত্রিভাগহীনং’ অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে মহালয়া পর্যন্ত শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যায়। তা না হলে ‘সার্ধং বা’ অর্থাৎ অষ্টমী থেকে মহালয়া পর্যন্ত এই শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যায়। নইলে ‘ত্রিভাগংদ অর্থাৎ একাদশী থেকে মহালয়া পর্যন্ত এই শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যাবে। না পারলে ‘সার্ধমেবা’ অর্থাৎ ত্রয়োদশী  থেকে মহালয়া পর্যন্ত এই শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যেতে পারে। তাও না পারলে মহালয়ার দিন মহালয়া নিমিত্তক শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা যাবে। ‘... ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ম্।’ পিতৃপিতামহ এবং ত্রিভুবনের সকল প্রাণী আমার দেওয়া জলে তৃপ্ত হোন। এই আবেদন পৌঁছে দেওয়া হয় বিশ্ববাসীর কাছে। পক্ষকাল ধরে কোটি কোটি কণ্ঠে এই প্রার্থনা। প্রার্থনা সমবেতভাবে হলে তা ব্যর্থ হয় না। বিশ্বকল্যাণ কামনায় দেবী দুর্গার কাছে আমরা সমবেত হই দেবীপক্ষে। পথ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য একটাই এই পক্ষযুগলের। লক্ষ্য এক রেখে পথ দুটির সংমিশ্রণ করেছিলেন ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র। যা একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস বলা যায়।  কোটি লক্ষ বানর সেনা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে লঙ্কায় উপস্থিত হলেন শ্রীরামচন্দ্র। 
 ‘কোটিলক্ষৈর্মহাবাহুর্লক্ষ্মণেন সমন্বিতঃ।’ লঙ্কার জল, স্থল, বৃক্ষ, প্রাকার বানরেরা ঘিরে থাকল। শ্রীরামচন্দ্র সুদৃঢ়া লঙ্কাপুরী দেখে ভাবতে লাগলেন, দুর্গাদেবীর আরাধনা ছাড়া শত্রুকে জয় করতে পারব না। ‘ন বিনারাধনং দেব্যাঃ শত্রুং জেতুং ক্ষমো ভবেৎ।’ তাঁর কৃপা ছাড়া ত্রিলোক বিজয়ী বীরও তৃণবৎ শক্তিহীন। কিন্তু এই দক্ষিণায়নে দেবী নিদ্রিতা। অকালে দেবীকে কি প্রকারে পুজো করি? এরূপ চিন্তা করে শ্রীরামচন্দ্র পিতৃরূপিণী দেবীকে অর্চনা করতে সঙ্কল্প করলেন। আজ পিতৃ ( অপর ) পক্ষের প্রতিপদ তিথি। আজ থেকে অমাবস্যা (মহালয়া) পর্যন্ত ‘পার্বণেনৈব বিধিনা’ পার্বণ বিধিক্রমে পিতৃরূপিণী জয়দায়িনী দেবীর অর্চনা করব। ‘প্রবৃত্তোপরপক্ষশ্চ প্রতিপত্তিথিরদ্য তু’। এটা স্থির করে লক্ষ্মণকে বললেন, আজ পার্বণ শ্রাদ্ধ করব। লক্ষ্মণ! ‘করিষ্যে পার্বণ শ্রাদ্ধমপরাহ্নেদ্য ভক্তিতঃ।’ একথা সকলেই মেনে নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র দেবীকে চিন্তা করে পার্বণ শ্রাদ্ধ করলেন। 
এই পিতৃপক্ষেই অবশ্য আরমৃভ হয় দুর্গাদেবীর মহাপুজোর প্রথম কল্প।  অর্থাৎ কৃষ্ণা নবম্যাদি কল্প। ভাদ্রীপূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত যে পুজো তা-ই প্রথম কল্প কৃষ্ণা নবম্যাদি কল্প। ‘আর্দ্রায়াং বোধয়েদ্ দেবীম্।’ অর্থাৎ আর্দ্রা নক্ষত্রযুক্ত নবমীতে দেবীর বোধন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এই মহাপুজোর সাতটি কল্প। (১) কৃষ্ণানবম্যাদি কল্প। (২) প্রতিপদাদি কল্প। শুক্লা প্রতিপদ থেকে মহানবমী পর্যন্ত। (৩) ষষ্ঠ্যাদি কল্প। শুক্লা ষষ্ঠী থেকে মহানবমী পর্যন্ত। ( ৪) সপ্তম্যাদি কল্প। সপ্তমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত। (৫) মহাষ্টম্যাদি কল্প। মহাষ্টমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত। (৬)  কেবল মহাষ্টমী। (৭) কেবল মহানবমী । 
লেখক সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা আকাদেমির অধ্যক্ষ

6th     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ