বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বিজেপির ‘ফুটো নৌকা’য় চাপছে না কেউই
তন্ময় মল্লিক

সকাল দেখলেই বোঝা যায়, দিনটা কেমন যাবে। এই প্রবাদবাক্য রাজনীতিতে খাটলে বলতেই হবে, ২০২৪ সালটা বিজেপির জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। দল ভাঙাগড়ার যে খেলা শুরু হয়েছে, তাতে রয়েছে তেমনই ইঙ্গিত। ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুসারে লোকসভা নির্বাচনের এখনও দেরি বছর আড়াই। তার আগে আছে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচন। তা সত্ত্বেও এখন থেকেই সব দলের নজর লোকসভা ভোটের দিকে। তাই রাজনৈতিক দলগুলি ঘর গোছাতে নেমে পড়েছে। জাতীয় রাজনীতির মাঠে তৃণমূল কংগ্রেস তরুণ হলেও প্লেয়ার তুলছে টপাটপ। স্থায়ী কোচ না থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসে নাম লেখাচ্ছেন কানাইয়া কুমারের মতো ‘নামকরা স্ট্রাইকার’। কিন্তু বিজেপিতে ‘ব্র্যান্ডেড কোচ’ থাকলেও কেউ ওই টিমে যেতে চাইছে না। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রিত্বের কুর্সি থেকে ঘাড়ধাক্কা খাওয়া অমরিন্দর সিংও নয়। ‘ফুটো নৌকায়’ কে আর চাপতে চায়!
অনেকে বলেন, সম্ভাবনার শিল্পের নাম হল রাজনীতি। জয়ের সম্ভাবনা যাচাই করেই নেতারা পদক্ষেপ করেন। বিপদের গন্ধ পেলেই দল বদলের জন্য উসখুস করেন। খুঁজতে থাকেন দল ছাড়ার অজুহাত। দল পাল্টানোর সময় নেতারা মুখে নীতি, আদর্শ এবং উন্নয়নের কথা যতই বলুন না কেন, আসল হল অঙ্ক। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অঙ্ক। লাভের পাল্লা যে দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা থাকে, সেদিকেই ঝোঁকেন নেতারা। কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তুলে নেন নতুন দলের পতাকা। 
এখানে তাৎপর্যপূর্ণ হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতারা দল বদলে প্রধান প্রতিপক্ষ শিবিরে যোগ দেন। বছরের পর বছর যে রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে আসা দলে যাওয়াটা সাধারণ মানুষ মোটেই ভালোভাবে নেন না। তবুও তাঁরা যান। সম্ভাবনার জটিল অঙ্ক কষতে গিয়ে তাঁরা সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল।
মোদি-অমিত শাহদের দম্ভের বিস্ফোরণ সাধারণ মানুষ বাংলার নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করলেও বিজেপির জোট সঙ্গীরা তা টের পেয়েছিলেন অনেক আগেই। তাই কংগ্রেসকে হারানোর জন্য একদিন যাঁরা নরেন্দ্র মোদির হাত ধরেছিলেন তাঁরাই বিজেপি ছেড়ে একে একে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার করলে কপাল পুড়বে তাঁদেরও। কারণ সরকারি সিদ্ধান্তে সম্মতি থাক বা না থাক, বিজেপির কৃতকর্মের দায় চাপবে তাঁদের ঘাড়েও। তাই কখনও পিছন থেকে ছুরি মারার অভিযোগ তুলে, আবার কখনও নয়া কৃষি আইনের প্রতিবাদে বিজেপির হাত ছেড়েছেন জোট সঙ্গীরা। 
শিবসেনা, শিরোমনি অকালি দলের মতো বিশ্বস্ত জোট সঙ্গীরাও বিজেপির সঙ্গে থাকতে পারেনি। গন্ডগোল শুরু হয়েছে বিহারেও। বিশেষ প্যাকেজ ও স্পেশাল স্ট্যাটাসের দাবি ফের খুঁচিয়ে তুলেছেন নীতীশ কুমার। জোট সঙ্গীরাও বুঝতে পারছেন, কৃষি আইন, পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে সাধারণ মানুষ বিজেপির উপর বেজায় ক্ষুব্ধ। বিজেপির পাশাপাশি তাঁরাও দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছেন। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে কেন্দ্রের কাজের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইবে। ২০২৪ সালে বিজেপির ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা যত ক্ষীণ হবে গেরুয়া শিবিরের উপর জোট শরিকদের চাপ ততই বাড়বে। যে কোনও মূল্যে তারা জোট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিকল্প হওয়ার সুযোগ যাদের সামনে সবচেয়ে বেশি ছিল, সেই দলটির নাম কংগ্রেস। কিন্তু, কংগ্রেস এখন কার্যত নাবিকবিহীন নৌকা। এত বড় একটা পার্টিতে কোনও স্থায়ী সভাপতি নেই। সোনিয়া গান্ধী ঠেকনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। তার উপর তাঁর বয়স হয়েছে। অন্যদিকে, গান্ধী পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে রাহুল নেতার আসন পেলেও তাঁর ধারাবাহিকতা নেই। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। একের পর এক ভুলভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কংগ্রেসের অন্দরে বাড়ছে ক্ষোভ বিক্ষোভ। এর ফলে কংগ্রেসের শক্তঘাঁটিও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে বহু রাজ্যেই কংগ্রেস ভাঙছে। কিন্তু বাংলার নির্বাচনের পর কোনও বড় নেতা বিজেপিতে যেতে চাইছেন না। উল্টে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছেন। কারণ বাংলার নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনার পর থেকেই মোদি বিরোধী প্রধান মুখ মমতা। এটা শুধু তৃণমূল সমর্থকরাই নয়, মনে করছেন কংগ্রেস ও বিজেপির নেতারাও। তাই সুস্মিতা দেবের মতো মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রীও যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। সেই বার্তা পৌঁছে গিয়েছে সুদূর গোয়াতেও। তাই গোয়ার দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী তথা সাতবারের বিধায়ক লুইজিনহো ফেলেইরো কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। অভিজ্ঞ লুইজিনহোও বিশ্বাস করেন, বিভেদের রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাতের আন্তরিক ইচ্ছা একমাত্র মমতারই আছে।
ত্রিপুরায় তৃণমূল পা রাখতেই কংগ্রেস এবং সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ভাঙছিল বিজেপিও। তা দেখে আতঙ্কিত বিজেপি সরকার ত্রিপুরায় মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ 
করে দিয়েছে। তবে, এভাবে তৃণমূলকে আটকাতে যাওয়ায় বিজেপির বিপদ আরও বাড়াচ্ছে। 
ত্রিপুরার সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছেন, বিজেপি তৃণমূলকে ভয় পাচ্ছে।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে বঙ্গে যাঁরা সম্ভাবনার অঙ্ক কষে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই তৃণমূলে ফেরার জন্য দু’পা বাড়িয়ে রয়েছেন। সেই তালিকায় নাকি বিজেপির ২৫ জন বিধায়কও রয়েছেন, জানিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি নেতারা তাঁর এই দাবিকে অবশ্যই ফুৎকারে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু বিজেপির রানিং এমপি তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় আর সেটা পারছেন না। উল্টে গেরুয়া শিবিরের প্রায় কেউই আর সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। 
বিজেপি বিধায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্ডিত বলে যাঁর খ্যাতি সেই অশোক লাহিড়িকে নিয়েও তৈরি হয়েছে সন্দেহের বাতাবরণ। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অর্থনীতির ব্যাপারে গোপনে পরামর্শ দিতে সম্মত হওয়ায় বিজেপি শিবিরের রক্তচাপ বেড়েছে। তার উপর অসুস্থতা এবং বয়সের কারণে অমিত মিত্র নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না। সুতরাং অনেকেই দুই আর দুইয়ে চার করে অঙ্ক মেলাতে চাইছেন। যদিও অশোকবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পেশাদার অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরামর্শ দিতে চান। তবুও দূর হচ্ছে না সংশয়। 
ঘটনা পরম্পরা বলছে, ২০২৪ সালে বিজেপির পালে হাওয়া লাগার তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উল্টে লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বিজেপি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমনকী বিজেপির সঙ্গ ছাড়লে সিবিআই, ইডির খপ্পরে পড়ার প্রবল আশঙ্কা সত্ত্বেও কেউ ছাড়ছেন জোট, কেউ ছাড়ছেন দল। এরপরেও যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকের আবার ‘মন’ বিজেপিতে নেই। আছে শুধু শরীর। 
মাস চারেক বাদেই পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচন। এই সময়ে অমরিন্দর সিংকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরানোটা কংগ্রেসের জন্য মাস্টার স্ট্রোক, নাকি ব্যুমেরাং সেটা বলবে সময়। তবে, অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরেও তাঁর বিজেপিতে না যাওয়ার ঘোষণায় রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে জোর চর্চা। অমরিন্দর জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কংগ্রেস ছাড়ছেনই, কিন্তু বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন না।
সাধারণত রাজ্যে কোনও শক্তিশালী আঞ্চলিক দল না থাকলে কংগ্রেস এবং বিজেপি একে অপরের বিকল্প হয়ে থাকে। সেই বিচারে কংগ্রেস ছাড়লে অমরিন্দর বিজেপিতে যাবেন বলে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন। আর অমিত শাহের সঙ্গে তাঁর দেখা করতে যাওয়ার কথা চাউর হতেই প্রায় সমস্ত টিভি চ্যানেল জানিয়ে দিয়েছিল, অমরিন্দরের বিজেপিতে যোগদান পাকা। কিন্তু তেমনটা ঘটল না।
বাংলায় দল ভাঙিয়ে ফায়দা তুলতে পারেনি বিজেপি। অমরিন্দর সিংকে নিয়ে পাঞ্জাবেও ফায়দা তোলার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও অমিত শাহ তাঁকে সময় দিয়েছিলেন। অমরিন্দর হাতে পদ্মফুল তুলে নিলে গেরুয়া শিবির কিছুটা স্বস্তি পেত। কিন্তু অমরিন্দর জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপিতে যাচ্ছেন না।
কিন্তু কেন অমরিন্দর পিছিয়ে এলেন? অনেকে বলছেন, নয়া কৃষি আইন, রান্নার গ্যাস, পেট্রপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খোঁচায় বিজেপি এখন ‘ফুটো নৌকা’। সেই নৌকায় চাপলে সলিল সমাধি অনিবার্য। বুঝেছেন অমরিন্দর। তাই মুখ্যমন্ত্রীর গদি খোয়ালেও বিজেপিতে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেন না।

2nd     October,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ