বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সরকারকে কোনও
ধন্যবাদ নয়

৩১ আগস্ট কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিস (সিএসও) তাদের তরফে জাতীয় আয়ের পরিমাপ ঘোষণা করেছে। জিডিপি সংখ্যাটি সত্যিই ভালোলাগার: ২০.১ শতাংশ। একটা প্রত্যাশা ছিল যে ‘আমরা জনগণ’ এই সংখ্যা এবং সরকারের কেরামতি দেখে গলে যাব। প্রশংসা করুন মিডিয়া এবং জনগণের (কিছু ভক্তকে বাঁচান), তারা সংখ্যা দেখে বিভ্রান্ত হতে রাজি নয় এবং দ্রুত সত্য উপলব্ধি করেছে। সত্যিটা এই যে ২০২১-২২ প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার (২০.১ শতাংশ) একটা পরিসংখ্যানের মায়া মাত্র। কারণ যে বেস বা ভিত্তির উপর এটা গণনা করা হয়েছে সেটা ছিল নজিরবিহীনভাবে কম—মাইনাস (-) ২৪.৪ শতাংশ, সংখ্যাটা ২০২০-২১ প্রথম ত্রৈমাসিকের। মাস কয়েক আগে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ ডঃ গীতা গোপীনাথ যেটাকে ‘গাণিতিক বৃদ্ধি’ বলে বর্ণনা করেছেন।

মানুষ যা পেতে পারে
তৎসত্ত্বেও আমরা অবশ্যই ২০.১ শতাংশ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানাব। কারণ, অসংবেদী ও দায়িত্বকর্তব্যপালনে অনাগ্রহী একটা সরকারের অধীনেই দেশ এবং জনগণ কী করতে পারে, এই ঘটনা সেটাই দেখিয়ে দিল। ত্রৈমাসিকের (এপ্রিল-জুন ২০২১) গোড়ার দিকে কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ঢেউ এলে রাজ্য সরকারগুলো অর্থনীতির ঝাঁপ বন্ধ না করে তাদের মতো সঙ্কট মোকাবিলা করেছিল। তাতে মোদি সরকারের অবদান বলতে, অক্সিজেনের সরবরাহ ও বণ্টনে বিরাট এক ব্যর্থতা: সরবরাহ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ মারাত্মক কম হওয়ার ফলে বহু মানুষের প্রাণ চলে গেল (মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটা সরকারিভাবে যা নথিবদ্ধ হয়েছে তার অন্তত দশগুণ বলেই মনে হয়)।
গৃহস্থ পরিবারগুলো এবং তাদেরকে পরিষেবা দেয় এমন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফে পণ্য ও পরিষেবা উপভোগের জন্য শেষেমশ যে ব্যয় করা 
হয়ে থাকে অর্থনীতির পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘প্রাইভেট ফাইনাল কনজাম্পশন এক্সপেনডিচার’ (পিএফসিই)। এই যে ২০.১ শতাংশ বৃদ্ধির হারের কথা বলা হল, তার পিছনে রয়েছে জনগণের পিএফসিই-র বিরাট অবদান। পণ্য ও পরিষেবার জন্য জনগণ প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৭ লক্ষ ৮৩ হাজার ৬১১ কোটি টাকা খরচ করেছে। মহমারীর প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গত বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে। এবারের বৃদ্ধির পরিমাণটা ওই সময়ের ব্যয় ১৪ লক্ষ ৯৪ হাজার ৫২৪ কোটি টাকার থেকে অনেকখানি বেশি। 

প্রকৃত ভিত্তিকাল
ফাইনাল কনজাম্পশন এক্সপেনডিচার আরও একটা আছে। সেটা সরকারের। সরকারের তরফে ব্যয়টা যদি পিএফসিই-র সঙ্গে যোগ্য সংগত করত তাহলে কত ভালো হতো কল্পনা করুন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, প্রথম ত্রৈমাসিকে সরকারের তরফে ব্যয়ের পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় কমে গেল। অঙ্কটা আগের বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ছিল ৪ লক্ষ ৪২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। সেটা এবছরের অনুরূপ সময়ে নেমে এল ৪ লক্ষ ২১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, প্রথম ত্রৈমাসিকে সরকারের যা অবদান ছিল তা ‘নেতিবাচক’। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ করেনি, অথচ বৃদ্ধির চারটে ইঞ্জিনের একটা হল এটা। নিট রপ্তানির পরিমাণ গত বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ছিল ৩৪ হাজার ৭১ কোটি টাকা, এবছর তা কমে হয়ে গিয়েছে মাইনাস (-) ৬২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ২০.১ শতাংশ, গাণিতিক যদিও, তার জন্য আমরা দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাব, সরকারকে কোনওরমক ধন্যবাদ নয়। সরকার খরচ করার সাহস দেখাতে ব্যর্থ হল। টাকার অভাব তার কারণ হলে ধার করেই খরচ করার সাহস দেখাতে হতো। সমাজের একেবারে নীচে রয়ে গিয়েছে যে ২০-২৫ শতাংশ পরিবার তাদের হাতে কিছু নগদ অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো। তাহলে পিএফসিই ব্যাপক হতে পারত। বেড়ে যাওয়া বেসরকারি ব্যয়ের সঙ্গে বর্ধিত সরকারি ব্যয় মিলে এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে তুলত যাতে বৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ অতিক্রম করত। আর এইভাবেই ঢেকে দেওয়া যেত গত বছরের মাইনাস (-) ২৪.৪ শতাংশ পতনের ক্ষত। ২০২১-২২ প্রথম ত্রৈমাসিকের সংখ্যাগুলো অর্থনীতির ভয়ানক কিছু দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। মহামারীর বছর বা ২০২০-২১ সালটা প্রকৃত বেঞ্চমার্ক নয়, বরং তার আগের বছরটা, মানে ২০১৯-২০ সাল। সে-বছরের বার্ষিক উৎপাদন স্বাভাবিকের মধ্যেও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। আমরা কি এখনও সেখানেই আছি? উত্তর হল—না। বিশেষ সংখ্যাগুলোর দিকে তাকানো যাক: অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলো ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের উৎপাদন স্তরে পৌঁছয়নি। এই ক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদনের পরিমাণ, এমনকী, ২০১৮-১৯ সালের থেকেও নেমে গিয়েছে। একমাত্র তারকা পারফর্মারের নাম কৃষি। 
সংখ্যাগুলো থেকে চাকরি-বাকরি খোওয়া যাওয়ার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়—পর্যবেক্ষক, সমীক্ষক এবং সিএমআইই-র রিপোর্টেও তা বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সরকার তা কোনওভাবে মানছে না। অর্থনীতির ধারাবাহিক পতনের কারণে ২০১৯-২০ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি চলে গিয়েছে। এই পতনের জন্য দায়ী নিম্নমানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা। ২০২০-২১-এর মহামারীতে চাকরি খোওয়া গিয়েছে আরও বেশি। চলতি সালে সেই চাকরি ফেরত পায়নি মানুষ। এটাও মনে রাখতে হবে, চাকরির বেশিরভাগটা অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং ছোট ও মাঝারি শিল্প-বাণিজ্যে (এমএসএমই)। সিএসও-র এখনকার এস্টিমেটের ভিতরে অসংগঠিত এবং এমএসএমই ক্ষেত্রের পারফর্ম্যান্সটা অনুপস্থিত।

দিশাহীন ও ভীরু 
ইংরেজি V আকৃতির রিকভারিটা প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার তরফে একটা একঘেঁয়ে ধরনের মোচড়। ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হার ৫.১ শতাংশ থেকে যখন মাইনাস (-) ২৪.৪ শতাংশে নেমে যায় তখন সেটা বোঝাতে V বর্ণের বাম বাহুর ঝোঁক আঁকা হয় এবং ছোট ইতিবাচক বৃদ্ধির ঝোঁক বোঝাতে আঁকা হয় ডান বাহুটি। ছোট আকারের বৃদ্ধির ঝোঁকটা পরের পর ত্রৈমাসিকে থেকে গেলে ডান বাহুটা ঊর্ধ্বমুখীই হয়, তবে খুব ধীরগতির। এর মধ্যে ভাবনাচিন্তার ছাপ কিছু নেই। আসল প্রশ্নটা হল, জিডিপি স্তর মহামারী-পূর্ব অবস্থায় ফিরবে কবে, অর্থাৎ যেটা ২০১৯-২০ সালে রেকর্ড করা হয়েছে? রিকভারি বা বৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারটা ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু আমি এটাকে বলে থাকি দিশাহীন ও ভীরু পদক্ষেপ। একটা পোঁ-ধরা কাগজের ১ সেপ্টেম্বর সংস্করণে ‘খরচ করো সরকার, ধার করো এবং খরচ করো’ শিরোনামে সম্পাদকীয় দেখে আমি যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত। এই পরামর্শটাকে আমি এনডোর্স—অর্থাৎ পৃষ্ঠাঙ্কিত, অনুমোদন ও সমর্থন করলাম। অর্থনীতির দ্রুত পুনরুত্থানের এটাই হল পথ। 

                                                                                                                                                     লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

6th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ