বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পার্টি ম্যান দিলীপ, হতে
পারলেন না ‘ইয়েস ম্যান’
তন্ময় মল্লিক

ফের সেই অঙ্ক। গেরো থেকে কিছুতেই বেরনো যাচ্ছে না। তবে এবার অঙ্কটা একটু অন্য রকম। ৩ থেকে বেড়ে ৭৭, নাকি ১২১ থেকে কমে? কোন দিক থেকে ৭৭-এর অঙ্ক কষা হবে, সেটা বিজেপির অন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অনেকে বলছেন, এই অঙ্কের উপরেই নাকি দাঁড়িয়ে আছে দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ! ৩ থেকে শুরু হলে বঙ্গ-বিজেপির ইতিহাসে দিলীপবাবুর নাম  জ্বল জ্বল করবে। আর ১২১ থেকে নামলেই ঘাড়ে চাপবে ব্যর্থতার যাবতীয় দায়। তবে নাড্ডাজি তড়িঘড়ি দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে দিলীপবাবুকে একদিন ‘ওয়েটিং রুমে’ ফেলে রাখায় অনেকেই বলছেন, মোদি-অমিত শাহ জুটি অঙ্কটা ১২১ থেকেই শুরু করতে চাইছেন। দলের ভালো-মন্দ চুলোয় যাক, দেশজুড়ে জারি রাখতে হবে ‘টিম মোদি’ তৈরির প্রয়াস।
বঙ্গ বিজেপির লড়াইয়ের অভিমুখ একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। ইডি, সিবিআইয়ের পর এবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ‘ললিপপ’ দিয়ে কর্মী-সমর্থকদের ভোলানো যায়, কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা সরকারের গায়ে আঁচড় কাটা যায় না। সেটা গেরুয়া শিবিরের নেতারা খুব ভালো করেই জানেন। তাই এবার লড়াই দলের নিয়ন্ত্রক হওয়ার।
বঙ্গ বিজেপিতে এখন এই লড়াইটা তীব্র হলেও শুরু হয়েছিল বছর তিনেক আগেই। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে বোঝা গিয়েছিল, এরাজ্যে দ্রুত 
উঠে আসছে বিজেপি। পরের বছর লোকসভা ভোটে শাসক দলের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছিল। সেই সাফল্য দিলীপ ঘোষের না মুকুল রায়ের, তা 
নিয়ে শুরু হয়েছিল দড়ি টানাটানি। দিলীপবাবুর আরএসএস ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও দিল্লির আশীর্বাদের হাত ছিল মুকুলবাবুর মাথায়। তাতে বিজেপির আদি নেতা কর্মীরা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কারণ আদর্শগত কারণে যাঁরা বিজেপি করেন তাঁরা সব সময় চান, 
সঙ্ঘ ঘরানা থেকে উঠে আসুক নেতৃত্ব। অথচ মোদি-অমিত শাহ জুটি বরাবর ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটেছে। তার কারণটা কী?
নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের পার্টি ও সরকার পরিচালনার ধরনটা দেখলেই কারণ স্পষ্ট হবে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে লড়ার অনেক আগেই নরেন্দ্র মোদি একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। প্রথমে গুজরাতকে ‘উন্নয়নের মডেল’ হিসেবে দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁরই কৃতিত্বে গুজরাত এগিয়েছে বলে ফলাও করে প্রচার করে বোঝাতে চেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশের হাল তিনি বদলে দেবেন। ক্ষমতা দখল নিশ্চিত হতেই তৈরি করেছিলেন ছাঁটাইয়ের তালিকা। সেই তালিকার উপরে ছিল লালকৃষ্ণ আদবানির নাম।
নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় আদবানিজির নাম নেই শুনে চমকে গিয়েছিল গোটা দেশ। তখন মোদি-ভক্তদের সাফাই ছিল, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে প্রবীণ আদবানিজিকে অন্য দপ্তর দিলে তাঁকে ‘অসম্মান’ করা হবে। তাই তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। মোদিজি তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে ‘গুরুদক্ষিণা’ দেবেন। তখন মানুষ সেকথা বিশ্বাসও করেছিলেন। কারণ নরেন্দ্র মোদি তখন শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, সওয়া শো কোটি ভারতবাসীর ‘আবেগ’। তবে, এখন দেশের মানুষ বিলক্ষণ বুঝেছেন, প্রশ্ন আর কৃতিত্ব ভাগাভাগি তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের। তাই একদা বিজেপির ‘লৌহ মানব’ আজ ‘কাঠের পুতুল’।
আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক হওয়ায় মোদিজি খুব ভালো করেই জানেন, দল ও সরকার পরিচালনায় সঙ্ঘকে গুরুত্ব দিলেই রয়েছে কর্তৃত্ব খর্বের প্রবল আশঙ্কা। পদে পদে পড়তে হবে প্রশ্নের মুখে। তাই ক্ষমতা দখলের দিন থেকেই তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে সঙ্ঘকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। এই মুহূর্তে কেন্দ্রের সরকারে রাজনাথ সিং ও নীতিন গাদকারি ছাড়া সঙ্ঘ থেকে উঠে আসা তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতা নেই।
শুধু কেন্দ্রেই নয়, বিভিন্ন রাজ্যেও অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ‘টিম মোদি’ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সঙ্ঘমুক্ত বিজেপি গড়াই তাঁদের লক্ষ্য। তাই অধিকাংশ রাজ্যেই তাঁরা অন্য দল ভাঙিয়ে নেতা এনে টিম তৈরি করছেন। অসমে কংগ্রেস থেকে হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে ভাঙিয়ে এনে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভাঙিয়ে কেন্দ্রের মন্ত্রী করেছেন। আগামী দিনে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী প্রজেক্ট করে মধ্যপ্রদেশের নির্বাচন লড়ার সম্ভাবনা প্রবল। পশ্চিমবঙ্গেও সেই ছকেই তাঁরা তৃণমূলকে ভেঙেছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, অক্সিজেনের অভাবে ‘শ্বাসকষ্টে’ ভোগা লোকজনদের নিয়ে টিম তৈরি করে নবান্নের ১৪ তলায় ওঠা যায় না।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিভিন্ন রাজ্যে ‘টিম মোদি’র মুখ কারা হচ্ছেন? যাঁদের গায়ে সঙ্ঘের নামগন্ধ নেই। তাতে লাভ কী? প্রথম লাভ, তাঁরা খুব ভালো ‘ইয়েস ম্যান’ হবেন। উঠতে বললে উঠবেন, বসতে বললে বসবেন। কোনও প্রশ্ন তাঁরা করবেন না। দ্বিতীয় লাভ, কোনও ভুল ত্রুটি হলে তাঁরা সঙ্ঘের কর্তাদের কাছে গিয়ে নালিশ ঠুকবেন না। তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় লাভ, পরিকল্পনা সফল হলে তা হবে মোদি-অমিত শাহের ‘মাস্টার স্ট্রোক’। আর ফেল করলে দায় 
চাপবে রাজ্য নেতাদের ঘাড়ে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে সেই চেষ্টাই চলছে।
নির্বাচনে হারার পর সব দলই ব্যর্থতার মধ্যেও সাফল্য খোঁজার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা। এখানেও বিজেপি প্রথমে ৩ থেকে ৭৭ হওয়াটাই তাদের সাফল্য বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু দলের ব্যাটন আদি না নব্যদের হাতে থাকবে, তা নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হতেই খেলাটা ঘুরে যাচ্ছে।
বিজেপির একাংশ বাংলায় হারের জন্য দিলীপ ঘোষকে কাঠগড়ায় তুলতে চাইছে। তাদের যুক্তি, লোকসভা ভোটে প্রায় সওয়া একশো বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থাকলেও এবার জিতেছে মাত্র ৭৭টি আসনে। আসন সংখ্যা এত কমল কেন? এর জন্য তাঁরা দিলীপবাবুকেই দায়ী করছেন। তথাগত রায় তো এক সাক্ষাৎকারে খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, দিলীপ ঘোষ ফেল করেছেন।
বিজেপিতে তথাগতবাবুর তেমন গুরুত্ব না থাকলেও তাঁর এই মন্তব্য দলের ‘আদি’ নেতা কর্মীদের রক্তচাপ বাড়াচ্ছে। রাজ্য সভাপতির ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দিলীপ ঘোষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। তাতে ইন্ধন দিচ্ছে দিল্লি। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের জন্যই এরাজ্যে সিপিএমকে হটিয়ে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হয়েছে, সেটা দিল্লির নেতারা কিছুতেই মানতে চান না। উল্টে তাঁকে পদে পদে হেয় করা হচ্ছে। দিল্লি চাইছে, তিতিবিরক্ত হয়ে দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দিন।
রাজ্যে ক্ষমতা দখল নিশ্চিত, এই বার্তা কর্মীদের দেওয়ার জন্য চারজন সাংসদকে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী করা হল। কিন্তু, দিলীপবাবুর কথা ভাবা হল না। এবার রাজ্য থেকে চারজনকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হল। কিন্তু সেখানেও তাঁকে জায়গা দেওয়া হল না। উল্টে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে একদিন বসিয়ে রাখা হল। অপদস্থ করার এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর কী হতে পারে? নির্বাচনে ফল প্রকাশের পর প্রায় আড়াই মাস অতিক্রান্ত। এখনও বিজেপি নেতৃত্ব হারের কারণ কী, তা প্রকাশ্যে আনেনি। তবে, বিজেপির সাধারণ কর্মী সমর্থকরা কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, এবারের ভোটে দিলীপ ঘোষের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল দলবদলু নেতাদের। রাজ্যে ১৮টি লোকসভার আসন পাওয়ার পিছনে ‘বালাকোট ফ্যাক্টর’ কাজ করলেও দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বকে অস্বীকার করা যায় না। রাজ্যের যেখানেই কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানেই তিনি ছুটেছেন। কিন্তু, বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে ‘সাইড’ করে দিয়ে দলবদলুদের নিয়ে দিল্লির মাতামাতি 
কর্মী-সমর্থকবা ভালোভাবে নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, এরাজ্যে বিজেপি হাওয়া ওঠার পর তৃণমূলের নেতারা দল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন। অধিকাংশেরই ইমেজ ভালো ছিল না। তাই রাজ্যজুড়ে তাঁদের দলে নেওয়ার ও টিকিট দেওয়ার প্রতিবাদ হয়েছিল। পার্টি অফিস ভাঙচুর, আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু, দিল্লি পিছু হটেনি। তাই দলবদলুদের প্রার্থী করায় বহু আসন হাতছাড়া হয়েছে।
তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি জনসভায় সুর করে ‘দিদি অ দিদি’ কটাক্ষ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বিশেষ করে মহিলারা। 
বিজেপির দিল্লির নেতৃত্বের নির্বাচনী পর্যালোচনা বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা এখানেই। দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না।’ কিন্তু, বিজেপির দিল্লি নেতৃত্ব সেটাই করে দেখাতে চাইছেন। কারণ তা না হলে পণ্ড হবে বঙ্গে ‘টিম মোদি’ তৈরির যাবতীয় পরিকল্পনা।

17th     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ