বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

হাঁড়ির হাল নিয়ে বৃহৎ,
ক্ষুদ্র দু’পক্ষই একমত
পি চিদম্বরম

রাইসিনা হিলের উপর কোণের অফিস থেকে দৃশ্যটা মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে দৃশ্যগুলো যদি প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বেছে দিতে পারেন। যেমন—চাকরি খোয়ানোর ঘটনাগুলি হাওয়া হয়ে যেতে পারে এবং ইপিএফের খাতায় সেগুলো নতুন চাকরিতে যোগদান হিসেবে নথিভুক্ত হতে পারে! ক্ষুধার্ত মুখগুলো উবে যেতে পারে এবং তার জায়গায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে দয়ার দান গ্রহণ করছে যে মানুষগুলো—মাসে পাঁচ কেজি করে খাদ্যশস্য, যা দু’মাস পাবে তারা! মেহনতি ভাগচাষির ছবিটা ফিকে হয়ে আসতে পারে এবং যে জমির মালিক চাষাবাদ করেন না তিনি কিষান সম্মান চেক জমা দিয়ে সেই ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করতে পারেন! ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং সমালোচনাকে তাচ্ছিল্য করার থেকেই এই জাদুর সৃষ্টি। 
ভারতের গড়পড়তা মানুষ পর্বতারোহীদের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন। তিনি পুরুষ অথবা নারী যাই হোন না কেন, একটা গ্রামে, অথবা একটা শহর বা নগরের নিজ মহল্লার ভিতরেই কাটিয়ে দেন। কারণ, তাঁদের দু’টো পা’ই যেন মাটিতে প্রোথিত থাকে। গড়পড়তা ভারতীয়ের দৃষ্টিভঙ্গিটা কীটের মতো—নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, দুর্বল ভাবেন আর অন্যদের দেখেন খুব উঁচু লম্বা ও শক্তিশালী। দৃষ্টিভঙ্গিটা কঠিন কঠোর, নোংরা বা কদর্য হতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যের কাছাকাছি।  
একটা সমীক্ষা করা হল
মিস্টার জওহর। আমার বন্ধু। তিনি তদন্তকারীদের একটা দল গঠন করেছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এক হাজার জন মানুষের উপর একটা সমীক্ষা করার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম। এমনকী সুরক্ষিত আবাসনের সেইসব বাসিন্দাদেরও এই সমীক্ষায় রাখতে বলেছি, যাঁরা নিজেদের ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’র মানুষ বলে জাহির করেন কিন্তু আমরা জানি 
যে বাস্তবে তাঁরা তা নন। যেসব ব্যক্তির মাসিক আয় পাঁচ থেকে তিরিশ হাজার টাকার মধ্যে, আমরা তাঁদেরকেই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ধরি। ১০০৪ জনের কাছে ৯টি প্রশ্ন রেখে উত্তর পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা তাঁদের ইমেল আইডি এবং ফোন নম্বর দিয়েছেন। কয়েকজন উত্তরদাতা তাঁদের আয় কমিয়ে দেখিয়েছেন হয়তো। কিন্তু তাঁদের আয় তিরিশ হাজারের সামান্য বেশিও যদি হয়ে থাকে তবু সেটাকে তথ্যের বিকৃতি বলা যাবে না। 
আমাদের মনে আছে, প্রথম লকডাউনটা হয়েছিল ২০২০ সালের ২৫ মার্চ। তার পরবর্তী ১২ মাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নগুলো করা হয়েছিল। ওই সমীক্ষা থেকে যা জানা গিয়েছে সেটা এইরকম:
১. উত্তরদাতা ছিলেন ১০০৪ জন। 
২. মোট ৮৮০ জন দাবি করেছেন তাঁদের আয় কমে গিয়েছে। ১১৭ জনের বক্তব্য, তাঁদের আয়ের কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাকি ৭ জন জানিয়েছেন, তাঁদের আয় বেড়ে গিয়েছে। 
৩. তবে, ৭৫৮ জন জানিয়েছেন, তাঁদের খরচাপাতি বেড়ে গিয়েছে। ১১৫ জনের বক্তব্য, তাঁদের খরচে কোনও পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে, ৯১ জানিয়েছেন তাঁদের খরচ কমে গিয়েছে। 
৪. সঞ্চয়ে কোপ পড়ার কথা স্বীকার করেছেন ৭২৫ জন। তবে সম্পত্তি কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন মাত্র ৩২৯ জন। সঞ্চয় এবং সম্পত্তি দু’টোই অপরিবর্তিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাকি উত্তরদাতারা। 
৫. যেমনটা ভাবা গিয়েছিল, ৭০২ জনকে টাকা ধার করতে হয়েছে। কিছু ব্যক্তি ঋণ নিয়েছেন ব্যাঙ্ক কিংবা মাইক্রো ফিনান্স সংস্থা থেকে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, এমনকী চিটফান্ড থেকে টাকা ধার করার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ। পরিবারের ভিতর থেকে, আত্মীয় এবং বন্ধুদের কাছ থেকেও টাকা ধার করার ঘটনা নজরে আনা হয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে একাধিক সূত্র থেকেও ঋণগ্রহণের কথা জানা গিয়েছে। ৬৫৩ জন, অর্থাৎ বেশিরভাগ ব্যক্তিই ‍টাকা ধার করেছেন সুদে। ১৭৬ জন দাবি করেছেন, নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করে দিতে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু ১৬৪ জন বলেছেন, তাঁদের কথার খেলাপ হয়ে যাবে। কবে কীভাবে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন, বাদবাকি ২৫৬ জন সেই ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন।
আমাদের ঘিরে তথ্যপ্রমাণ 
এই যে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হল, এসবই আমরা রোজ দেখছি, শুনছি এবং নিরীক্ষণ করছি। মহামারী এবং এই আর্থিক পরিস্থিতি পারিবারিক আয়-ব্যয়ের হিসেবকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। কমে গিয়েছে আয়পত্তর। খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। ধারদেনা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধ কীভাবে হবে ভেবে কূল করতে পারছেন না। বাধ্য হচ্ছেন সঞ্চয়ের সঙ্গে আপস করতে। সব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে গড়পড়তা গৃহস্থ মানেই একজন ক্লান্ত অবসন্ন ব্যক্তি। যদি না পরিবারের দু’জন রোজগেরে (দু’জনেরই আয়ে ধাক্কা লাগলেও) হন, চট করে বলে দেওয়া চলে যে একজন গড়পড়তা রোজগেরে ব্যক্তি আর্থিকভাবে ধাক্কা খেয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারটাও বুঝতে পারছে যে, তারা আরও গরিব হয়ে গিয়েছে।
মৃল চারটে প্রশ্ন ছিল আয়, ব্যয়, সঞ্চয় ও ঋণ সম্পর্কিত। ক্রমান্বয়ে যে চারটে উত্তর পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে সর্বনিম্ন সংখ্যটা হল ঋণ সংক্রান্ত। সংখ্যাটা হল ৭০২। মানে, এই পরিস্থিতে ধারদেনা করতে বাধ্য হয়েছেন ৭০২ জন, সেই সংখ্যাটা। এই সমীক্ষাটা যতজনের উপর করা হয়েছিল, ৭০২ সংখ্যাটা তার ৭০ শতাংশ। এটাতে কোনওভাবেই একটা দেশের সেই ছবি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, সম্প্রতি যেটা 
বড় মুখ করে বলা হয়েছিল, দেশটার বৃহৎ অর্থনীতি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। (১) 
গত ২০০৪-১৪ দশকে গড়পড়তা ৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছিল ভারত। (২) ওই একই সময়ে ২৭ কোটি মানুষকে দারিদ্রমুক্ত করা গিয়েছিল। আজকের হালের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হবে যে, এক‍টা শিখর থেকে বিরাট পতনই হয়েছে। সেসবই আজ ইতিহাস। 
জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস (এনএসও) ২০২০-২১ সালের জন্য জাতীয় আয়ের যে এস্টিমেট দিয়েছে আমাদের হিসেবটা তার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০২০-২১ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) পূর্ববর্তী বছরের সাপেক্ষে ৭.৩ শতাংশ কমে গিয়েছে বা মাইনাস (-) ৭.৩ শতাংশ 
হয়ে গিয়েছে। ব্যক্তিগত উপভোগ, গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন, রপ্তানি ও আমদানি—এই চারটে গুরুত্বপূর্ণ সূচকও দু’বছর আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ‘ডিমান্ড শক’ বা চাহিদায় ধাক্কা লাগার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও ব্যয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তেমন প্রয়োজন হলে টাকা ছাপাতে হবে।
এনএসও এবং লোকাল সার্ভে—‘দ্য বার্ড অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ম’—বৃহৎ, ক্ষুদ্র—মাটির উপর দু’জনেই একই ছবি দেখতে পেল। এটা একটা সুন্দর সাদৃশ্য—যেটা অর্থমন্ত্রী এবং প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকে একটা বন্ধ ইকো চেম্বারে রেখে দিচ্ছে। অর্থাৎ তাঁরাও একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। 
করণীয়, তবে তা হবে   
নির্মম বাস্তবটা এই যে, ২০১৭-১৮ সাল থেকে জিডিপি (কনস্ট্যান্ট প্রাইসে) এবং মাথাপিছু বার্ষিক আয় নিম্নগতি নিয়েছে:
সার্বিকভাবে পুরো জাতি এবং গড়পড়তা ভারতবাসী, ২০১৭-১৮ সালের যে পজিশন ছিল তারও পিছনে পড়ে গিয়েছে। অর্থনীতিটা ঘেঁটে গিয়েছে এবং তাতে ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রথম কারণ—বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নীতিগুলো (যেমন বিমুদ্রাকরণ, বিশৃঙ্খল জিএসটি)। দ্বিতীয় কারণ—কোভিড-১৯। আর তৃতীয় কারণ—অর্থনীতি সামলাতে সরকারের লেজেগোবরে অবস্থা। 
ধীরে হলেও ২০১৭-১৮-র পজিশনে ফেরা সম্ভব হতে পারে, যদি সরকার কিছু পরামর্শ নেয় এবং সেইমতো কাজটা করে। অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য এবং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সেই পরামর্শগুলো দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই), প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা এবং বিরোধী দলগুলো।
  • লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

7th     June,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ