আমাদের কম বয়সে কলকাতা ফুটবলে দলবদল ছিল একটা বড় ঘটনা। যাঁরা সেসময়ের ফুটবল অনুরাগী ছিলেন, তাঁরা অপেক্ষা করে বসে থাকতেন, বছরের শেষে তিন প্রধান অর্থাৎ ইস্ট বেঙ্গল, মোহন বাগান বা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোন ফুটবলার নিজের পুরনো দল ছেড়ে অন্য দলের জালে ধরা দেবেন। যে ফুটবলার বা ফুটবলাররা দল ছাড়তেন, তাঁদের দিক থেকে প্রধান যুক্তি থাকত ‘বেটার অফার’ তথা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে। আর ক্লাব কর্মকর্তারা, যাঁরা উক্ত ফুটবলারটিকে ধরে রাখতে চাইতেন, তাঁরা তারজন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করতেন, তার মধ্যে থাকত ‘ঘরের ছেলে’, ‘ক্লাবপ্রীতি’ ইত্যাদি আবেগেভরা শব্দরাজি। যে সব ফুটবলার অন্য ক্লাবে চলে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতেন, তাঁরা অবশ্য এসব ‘ঘরের ছেলে’-জাতীয় আবেগে মোটেও গা ভাসাতেন না। তাঁরা জানতেন যে, একজন ফুটবলারের আসলে অভিনেতার মতোই ফুটবলজীবন নেহাতই সাময়িক, দেহপটসনে ‘ফুটবলার’-ও সকলি হারায়।। তাই তাঁরা ওসব ‘টুপি’ না খেয়ে দল বদলাতেন। তারপর তাঁদের কাজ থাকত বাংলা ক্যালেন্ডারের পয়লা বৈশাখ তারিখের আশপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের ঠিক করা কোনও হোটেলে বা ডেরায় কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়া। খবরের কাগজগুলি এইসব খবর পেতে অত্যন্ত ব্যগ্র থাকত। ফলে কিছুদিন উক্ত ফুটবলারটি বা ফুটবলারদের নিয়ে গণমাধ্যমে বিরাট চর্চা হতো। আর তারপর একদিন, সক্কাল সক্কাল ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে সেই ফুটবলার সমুদয় চোখে কালো সানগ্লাস চাপিয়ে আইএফএ অফিসে গিয়ে একটি বড় চোথার তলায় সইসাবুদ করে জানিয়ে দিতেন যে, তিনি দল বদলাচ্ছেন। ক্যামেরার অসংখ্য ফ্লাশ তাঁকে ঘিরে জ্বলত, আর তিনি বাইরে এসে গণমাধ্যমের কাছে গরম গরম ‘স্টেটমেন্ট’ দিতেন, কীভাবে আগের ক্লাব তাঁকে অপমান করেছে বা ঠকিয়েছে। পকেটে সদ্য আসা অতিরিক্ত নোটের গরম উত্তাপের কথাটি অবশ্য তিনি চেপে যেতেন। বরং তিনি প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকতেন, কীভাবে ‘ঘরের ছেলে’ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর আগের ক্লাব তাঁকে মোটেও যথাবিহিত গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়নি। ফুটবলারটির পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন তাঁর সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগকারী ওই নতুন ক্লাবের কোনও নামজাদা কর্তাব্যক্তি। তাঁদের কারও নাম হয়তো জীবন-পল্টু বা গজু বসু বা শৈলেন বসু বা সুপ্রকাশ গড়গড়ি ইত্যাদি। সইসাবুদের পর কর্মকর্তারা তাঁদের ধরা ওই নতুন রুই বা কাতলার ঠোঁট থেকে ধারালো ছিপটি সযত্নে খুলে নিয়ে, তাঁদের হাতে নতুন ক্লাবের পতাকা তুলে দিতেন। তাঁরাও নতুন ক্লাবের পতাকা নাড়তে নাড়তে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে আগের ক্লাবের ও সমর্থকদের স্মৃতি ভুলে গিয়ে মুখ মুছে নিজের বাড়ি চলে যেতেন। পরের দিন থেকে নতুন জার্সি পরে সকাল সকাল আবার প্র্যাকটিসে নামা আছে যে! বছরের পর বছর দলবদলের এই উন্মাদনা প্রাক-বিশ্বায়ন যুগে কলকাতা ফুটবলকে দারুণভাবে আলোড়িত রেখেছিল।
সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে বাংলার রাজনীতি যেন কলকাতা ফুটবলের পুরনো দলবদলের সেই স্মৃতি ও উন্মাদনাকে ফিরিয়ে এনেছে। বিশ্বায়ন-উত্তর যুগের বঙ্গদেশের রাজনীতিরও বোধহয় এ এক নতুন পরিস্থিতি। বিজেপি যে কাজটা করেছে, তা হল প্রতিপক্ষের সুরজিৎ সেনগুপ্ত বা মইদুল ইসলামকে প্রথমেই ভাঙিয়ে নিয়েছে, যাতে ১৯৮০ বা ৯০-এর মতো তিনি এখন বিজেপির প্রাথমিক এজেন্ট হয়ে ওঠেন। এরপর ওই এজেন্টের কাজ হবে বিপক্ষের সাবির আলি, ডেভিড উইলিয়ামস, ভাস্কর গাঙ্গুলি বা কৃশানু-বিকাশকে নানান ভাংচি আর টোপ দিয়ে নিজের জালে তোলা। তৃণমূল থেকে যাওয়া এবং বিজেপির ধোলাইযন্ত্র তথা ওয়াশিং মেশিনে ধৌত হওয়া এই এজেন্টরূপী নব্য-চাণক্যটি দাবি করেন যে তিনি নির্বাচন নাকি খুব ভালো বোঝেন। শতকরা-দশকরা-গুসকরা ইত্যাদি হিসেবে তিনি খুব দড় এবং রাজ্যের নানান পরিসংখ্যান তাঁর নাকি কণ্ঠস্থ! শুধু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তিনি নিজে যখন নির্বাচন লড়েন, তখন প্রত্যেকবার তাঁর প্রায় জামানত জব্দ হওয়ার উপক্রম হয়।
নব্য এই ‘মোল’ তথা এজেন্টের হাত ধরেই তৃণমূলের কার্তিক শেঠ, স্বপন সাহা রায়, অনিরুদ্ধ কোলে, সুযশ বেরা, লক্ষ্মণ বেলেলরা এখন বিজেপিতে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের হাতে পতাকা তুলে দিচ্ছেন কারা? না স্থানীয় কোনও বাঙালি টুটু বসু বা পল্টু দাশরা নয়। জিএফসি অর্থাৎ গুজরাত ফুটবল ক্লাব থেকে আগত পরিযায়ী কর্মকর্তাদের দল এই আয়ারাম-গয়ারামদের হাতে সহাস্যে পতাকা তুলে দিচ্ছেন। এইসব কর্তার কারও নাম অমিত গড়গড়ি বা জগৎপ্রতাপ গজু বা কৈলাস বল। গুজরাতি এই গজু-গড়গড়িদের কোলে বা বুকে মুখ গোঁজা তৃণমূলে এতদিন ধরে থেকে সাবোতাজ করা বা গট আপ খেলা কানাই-বলাইদের সহাস্য পোজ দেওয়া দেখে জনগণের মনে হচ্ছে, দুধের শিশুরা যেন সব হামাগুড়ি দিয়ে সেই কবে মেলায় হারিয়ে যাওয়া ‘ফিডিং বোতল’-টি অবশেষে এতদিনে খুঁজে পেল! পাশে ‘চাণক্য’ নয়া সেই মনোরঞ্জন বা তরুণ দে হাসিমুখে যেন টুটু বসুর হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের দোলনায় দোল খাচ্ছেন। চাণক্য এজেন্টের মুখে রয়েছে ‘পরিবারতন্ত্র’র বিরুদ্ধে জোরালো বাণী। অদৃশ্য কড়ে আঙুলে কিন্তু নিজের সন্তানেরই ছোট্ট, কচি হাতটি চেপে ধরা। চান্স পেলেই দিলীপ ঘোষ বা শমীক ভট্টাচার্যদের গলাধাক্কা দিয়ে, নয়া গুজরাতি ‘বস’-দের পর্যাপ্ত তেল ও উপঢৌকন দিয়ে, সুবে বাংলার মসনদে বসে পড়ার বারো হাত কাঁকুড়ের অলীক খোয়াব দেখেছেন, এই ট্র্যাভেল এজেন্ট নয়া কুণ্ডু ব্রাদার্স অ্যান্ড সন্স।
কিন্তু কেন দল বদলাচ্ছেন তৃণমূলের এইসব বিজয় দিকপতি বা রঘু নন্দী বা কৃষ্ণগোপাল চৌধুরিরা? মানুষ সেটা বুঝতে পারছেন। কেউ যাচ্ছেন নিজের দুর্নীতির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে না পেরে। কেউ যাচ্ছেন নিজের লোভের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে না পেরে। কেউ যাচ্ছেন নিজের চরিত্রের স্খলনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে না পেরে। আবার কেউ বা যাচ্ছেন নিজের নষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে
না পেরে। কিন্তু এগুলো সবই মানুষের স্বাভাবিক নিয়তি। নিয়তি বা ‘কর্মা’ আবার জীবনে ফিরে
আসে। এঁদেরও আসবে। অচিরেই আসবে। কারণ, মিথ্যা হল খরগোশের মতো। সে দৌড়ে, লাফঝাঁপ দিয়ে, অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মধ্যে হয়তো
আগে চলে আসে। মিথ্যাকে তখন আপাত-ভাবে
মনে হয় জয়ী। সে-ই যেন জিততে চলেছে। কিন্তু খরগোশ জানে না, একটু দেরিতে হলেও পেছনে আসছেন ওই কচ্ছপ-রূপী সত্য। কচ্ছপ একটু
ধীরে সুস্থে মন্থর গতিতে আসছে। কিন্তু সে তো স্বয়ং সত্য। ফলে এই দৌড়টাতেও বরাবরের মতো সেই কচ্ছপ-ই জিতবে। জিতবে সত্য।
কারণ ফুটবলের সঙ্গে রাজনীতির দলবদলের একটা মুখ্য ফারাক আছে। ফুটবলের দলবদলের প্রাথমিক কথাই হল, ফুটবলাররা অন্য ক্লাবে গেলেও ক্লাবের সমর্থকরা দলবদল করেন না। সুরজিৎ সেনগুপ্ত থেকে কৃশাণু দে হয়ে বাইচুং ভুটিয়ার মতো বিখ্যাত, লক্ষ লক্ষ ‘ক্রাউড পুলার’রা হাজার চেষ্টাতেও সমর্থকদের দল বদল করাতে পারেননি। সেটাই ফুটবলের মজা। আবার রাজনীতির থেকে প্রত্যাশা এই যে, সমর্থকরা দলবদল চাইলেই করতে পারেন, তাতে দোষের কিছু নেই। পরশু যিনি সিপিএমের ভোটার ছিলেন, আজ তিনি তৃণমূলের ভোটার হতেই পারেন। কোনও দোষ নেই। বা কাল যিনি বিজেপির ভোটার ছিলেন, আজ তিনি কংগ্রেসের ভোটার হতেই পারেন। তাঁর এই ‘বদল’ ভোলবদল নয়, বরং পুরনো দলটির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ। কিন্তু রাজনীতির কারবারির থেকে প্রত্যাশা এই যে, শত প্রলোভনেও তিনি দল বদলাবেন না। বড়জোর নৃপেন চক্রবর্তী বা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যেতে পারেন। বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নতুন দল গড়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, সত্যিকারের রাজনৈতিক হিম্মত কাকে বলে। ফলে রাজনীতির কারবারিরা যদি ফুটবলারদের মতো আচরণ করেন, জনগণ তখন তাঁকে সেই সাবেক যুগোস্লোভিয়া থেকে আসা ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ চিরিচ মিলোভানের যাবতীয় ফুটবলারদের সম্পর্কে বলা বিশেষণটির মতো ভাবে। মিলোভানের বলা সেই বিশেষণটি অর্থাৎ ‘দেহপোজীবিনী’ শব্দতে কঠোরতা ছিল, হয়তো অতিশয়োক্তিও ছিল, কিন্তু আজকের রাজনীতির দলবদলুদের দেখে কী বলতেন বিখ্যাত কোচ মিলোভান?
প্রিয় দলবদলুরা, প্রিয় কার্তিক-কৃষ্ণগোপাল-কেষ্ট মিত্ররা, আপনারা খরগোশ হয়ে চলে গেলেন, যান। কিন্তু কচ্ছপ শিগগিরই পেছনে পেছনে আসছে। তার কামড়ের জোর কিন্তু সাংঘাতিক। আপাতত আপনারা যান। জিএফসি তথা গুজরাত ফুটবল ক্লাব আপনাদের ‘টোকেন’ নিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তৃণমূলের একজন সামান্য কর্মী হিসেবে বলতে পারি, আমাদের ঘরে আছেন স্বয়ং দিয়েগো মারাদোনা। তাঁকে কোনওদিন জিএফসি নিতে পারবে না। আপাতত তিনি মারাদোনার বুয়েনেস এয়ার্সের কলোনির মতোই, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের টালির চালের নীচে ওয়ার্ম-আপ করছেন। হালকা স্ট্রেচিং, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ আর অল্প গা-ঘামানো। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা হলে আমাদের মারাদোনা স্বয়ং নীল-সাদা জার্সি পরে মাঠে নামবেন। মারাদোনা মাঠে নামলে কী হয়, এবং কতটা হৃদকম্পন ওঠে, কিছুদিন আগে আপনাদের ‘চোর’ বলা এবং এখন আপনাদের নামে জয়ধ্বনি দেওয়া বিজেপি সমর্থকরা অন্তত জানেন। তাই আমাদের অসাধারণ মারাদোনা যখন তাঁর সাধারণ সতীর্থদের নিয়ে মাঠে নামবেন, গোটা রাজ্য জুড়ে কিন্তু ধ্বনি উঠবে, ‘ভাগ-বিজেপি-ভাগ’। নাপোলির সঙ্গে বা রিয়েল মাদ্রিদের সঙ্গে কি কোনওদিন কুমারটুলি বা ভ্রাতৃ সংঘরা জিততে পারে? আদৌ সম্ভব?
লেখক রাজ্যের মন্ত্রী (মতামত ব্যক্তিগত)