দেখ, ঐ গঙ্গার বুকে মেঘে ঢাকা চাঁদের কিরণ পড়েছে—গঙ্গা, তারপর বনানী, তারপর আকাশ। এই চাঁদের কিরণ, আকাশ, গঙ্গা, সব কয়েকটি একত্র হয়ে বড় শোভা হয়েছে! কি এক ভাব প্রাণে খেলছে, প্রকাশ করতে পাচ্ছি না। সে ভাবটি কি? বড় ভাল লাগছে, যেন কোন অতীতের স্মৃতি, কোন হারান-যুগের অস্পষ্ট ছায়া এসে হৃদয়ে পড়্ছে। যখন গঙ্গার সলিল-কণা-পূত সমীরণ এসে শরীর স্পর্শ করছে, তখনই তোমার কথা মনে পড়ছে—এ যেন তোমার পরশ। বড় স্নিগ্ধ, অতি মধুর—এমন জ্যোৎস্নাপুলকিত যামিনী, ভাগীরথী দুকূল প্লাবিত করে প্রবাহিতা হচ্ছেন। মৃদুমৃদু বাতাস বইছে, তুমি এ তুলসী-কাননে বেড়াতে একবার এসো না। তুমি ভালবাস বলেই ত’ তোমার জন্য তুলসী কানন করেছি। একবার এসো না! দোষ কি? অবশ্য সব এখনও পরিষ্কার করতে পারিনি, একখানি তো পরিষ্কার আছে। এস, একবার তুলসী-কাননে এস। আমি না হয় তোমার ভক্ত নই, কিন্তু তুলসী ত’ তোমার অতিপ্রিয়া। আমার জন্য তুমি তুলসীকেও দেখ্তে আসবে না? সত্যই আমি এমনি হতভাগ্যই বটে! যার জন্য তুমি তুলসীকেও আর ভালবাস না, তুলসী-কাননে আস না। অথবা তুমি তুলসী-কাননে নিত্য সন্নিহিত—আমি অন্ধ, আমি তোমায় দেখতে পাই না। মনে করেছিলাম, তুলসী-কানন করলাম্, একদিন না একদিন তুমি দেখতে আসবে আর আমি তোমায় সে সময় দেখে নেবো। কিন্তু আমার সে আশা পূর্ণ হোলো না। তুমি এলে না, কিম্বা তুমি এলেও আমি তোমায় দেখতে পেলাম না। এসব কথা খুব রঞ্জিত করে বলছি না, সত্যই আমি তোমায় চাই। কিন্তু ঠিক পাচ্ছি না, তোমাকে পেলে আর কিছুর বাসনা তো থাক্বে না! কৈ তা হয়েছে? কখনও মনে হয় যেন কোন উপদেষ্টা আস্বেন, তিনি তোমার সাধন-ভজন শিখিয়ে তোমায় দেখিয়ে দেবেন। তাই কি? তিনি কবে আসবেন? কোথায় দর্শন পাবো? কেমন করে চিন্বো? তাই যদি হয়, দাও তাঁকে পাঠিয়ে দাও, আর দেরী করো না। আমি তাঁর চরণে সব স’পে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। হে করুণাময় গুরু! বলো প্রভু, নাথ! আবার কার কাছে উপদেশ নেবার জন্য যাবো? কে আমায় সমাধি-ভূমিতে চিত্তের স্থিতিলাভের উপায় বলে দেবেন, অথবা ওসব ভাবনার কি প্রয়োজন আছে—বসে বসে রাম রাম করি, তোমার যা ইচ্ছা হয় কর। রাখ রাখ, মার মার, যেটি তোমার প্রাণ চায় তাই করো, আমি তোমার দাসানুদাস, সেবক। তুমি যেটি করবে, সেটিই আমার ভাল—এ বিশ্বাস দৃঢ় থাকে না। এ বিশ্বাস যাতে দৃঢ় হয়, সেই উপায় তুমি আমাকে বলে দাও। অথবা তুমি আমায় কি বলবে, আমার যা চাই, আমার জন্য যা করার প্রয়োজন তুমি সবই করছ। আমি দেখতে পাচ্ছি না বলেই তুমি নীরবে আছ একথা হতে পারে না।
‘শ্রীওঙ্কারনাথ-রচনাবলী’(১৪ খণ্ড) থেকে