যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া দুইটি পরস্পর বিরোধী কর্তব্যের চাপে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন অর্জুন। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি কর্তব্য বলিতেছে, ‘যুদ্ধ কর।’ পারিবারিক কর্তব্য দাবি করিতেছে, পিতামহ, গুরু, আত্মীয়-স্বজনকে মারা উচিত নহে। যাঁহারা পূজার পাত্র, ভীষ্ম দ্রোণ, তাঁহাদের বধসাধন কেবল অন্যায় নহে, অত্যন্ত বেদনাদায়কও বটে। সমস্যা এই—কর্তব্যের মধ্যে বিরোধ। একটা কর্তব্য পালন করিতে গেলে, অন্যটা সম্ভব হয় না। কোন্টা শ্রেয়, করা উচিত, তাহা অর্জুন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। তাই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন, বিষাদিত হইয়াছে তাঁহার চিত্ত। জীবনে সকলেরই সমস্যা এই, একটা দিক রাখিতে গেলে, অন্যটি ছাড়িতে হয়। অর্থ উপার্জন করিতে যে ভয়ানক খাটুনি, তাহাতে শরীর থাকে না, আবার শরীর রাখিতে গেলে অর্থাভাবে না খাইয়া মরিতে হয়। বিদ্যালাভের যোগ্যতা ছিল। কিন্তু সংসারের প্রয়োজন মিটাইতে বিদ্যালাভ হইল না। শ্রীরামচন্দ্রের সমস্যা—প্রজারঞ্জন করিতে গেলে স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করিতে হয়, স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য করিতে গেলে প্রজারঞ্জন হয় না। স্বাধীনতা লাভ করিতে গেলে ভারত দ্বিখণ্ডিত করিতে হয়, দেশের অখণ্ডতা রাখিতে গেলে স্বাধীনতা লাভ হয় না। সর্বত্রই এই দ্বন্দ্ব। কিসে আমাদের কল্যাণ, তা বুঝিতে না পারিয়া জীবন হয় সমস্যাসঙ্কুল এবং বিষাদময়। অর্জুনের রথের সারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের জীবনরথের সারথিও তিনি। তাঁহার বাণী শুনিতে পাই না আমরা, সংসারের কোলাহলে বধির বলিয়া। সকল মানবের প্রতিনিধি অর্জুন আমাদের হইয়া শুনিয়াছেন সেই বাণী। শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের কৃপায় কুরুক্ষেত্রের কোলাহলে সেই বাণী আজিও হারাইয়া যায় নাই। শ্রীকৃষ্ণার্জুনের এই রোমাঞ্চকর অদ্ভুত পূত-সংবাদই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। গীতার আঠারোটি অধ্যায় যেন আঠারোটি সিড়ি; বিষাদ হইতে মোক্ষে উর্ত্তীণ হইবেন, তবেই গীতা-মায়ের শান্তিময় ক্রোড়ে পৌঁছানো যাইবে। মৃত্যুর পর মুক্তিলাভ গীতার লক্ষ্য নহে, এই জীবনেই মোক্ষের অবস্থালাভ, ইহাই আদর্শ। এই জীবনে যিনি মুক্তি পাইয়াছেন, পরলোকে তিনি তো মুক্তি পাইবেনই। ডাক্তার যেমন রোগীকে জিজ্ঞাসা করে—ওষুধ ঠিকমতো খাইয়াছ কিনা? রোগ সারিয়াছে কিনা? গীতার শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করিলেন—তুমি সব মনোযোগ সহকারে শুনিয়াছ তো? তোমার অজ্ঞানতাজনিত মোহ দূর হইয়াছে কিনা? রোগী কেমন অনুভব করিতেছে, সেইটাই বড় কথা। অর্জুন বলিলেন—আমার মোহ দূর হইয়াছে, সংশয় চলিয়া গিয়াছে, ফিরিয়া পাইয়াছি কর্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান। এখন তোমার উপদেশ মতই কাজ করিব—
“নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎপ্রাসাদান্ময়াচ্যুত।
স্থিতোঽস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।।”
ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র শুনিলেই কাজ হইবে না, তদনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। শিক্ষালাভ করিলেই মানুষ হয় না, আধুনিক বিজ্ঞানের নৃশংস প্রয়োগে জগৎ প্রায় ধ্বংসের কিনারায় আসিয়াছে।
মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘গীতা-ধ্যান’ থেকে