জানতে, অজানতে বা ভ্রান্তে যে কোন ভাবে তাঁর নাম করলেই তার ফল হবেই হবে। যেমন কেউ তেল মেখে নাইতে যায়, তারও যেমন স্নান হয়, আর যাকে ঠেলে জলে ফেলে দেওয়া যায়, তারও স্নান হয়, আর কেউ ঘরে শুয়ে আছে, তার গায়ে জল ফেলে দিলে তারও তেমনি স্নান হয়। মানুষের দেহটা যেন হাঁড়ি আর মন বুদ্ধি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলো যেন জল, চাল ও আলু। হাঁড়ির ভিতর জল, চাল ও আলু দিয়ে তার নীচে আগুন জ্বেলে দিলে যেমন সেই জল চাল ও আলুগুলো তেতে ওঠে এবং তাদের গায়ে হাত দিলে যেমন হাত পুড়ে যায় অথচ সে শক্তিটা তাদের নয় আগুনের। সেই রকম মানুষের ভিতর ব্রহ্মশক্তি যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ মানুষের মন, বুদ্ধি প্রভৃতি কাজ করে এবং সেই শক্তির অভাব হলেই আর চোখ, কান, নাক প্রভৃতি কাজ করতে পারে না। বাড়ির ছাদের জল যেমন বাঘ মুখো অথবা অন্য রকম নল দিয়ে পড়ে, কিন্তু সে জল তাদের নয় আকাশের, সেই রকম সাধু ভক্তদের মুখ দিয়ে যে সব সত্য ও স্বর্গীয় তত্ত্ব প্রচারিত হয়, সে সব তাঁদের নিজের নয়—ঈশ্বরের। সকলের অসাক্ষাতে যিনি ভগবান দেখছেন বলে অধর্মাচরণ না করেন তিনিই যথার্থধার্মিক। জন শূন্য মাঠের মাঝে যুবতী সুন্দরীকে দেখে ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে যিনি তার প্রতি কুদৃষ্টি না করেন, তিনিই প্রকৃত ধার্মিক, আর যিনি কেবল প্রকাশ্যে ধর্মানুষ্ঠান করেন, তিনি ঠিক ধার্মিক নন। অন্ধকারের (যেখানে কেউ দেখছে না) ধর্মই ধর্ম, আলোর (সকলের সামনে প্রকাশ্যে) ধর্ম ঠিক নয়। শ্রীরঙ্গদেশে এক অশিক্ষিত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি প্রত্যহ গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় পাঠ করতেন আর অনবরত কাঁদতেন। গীতার সমস্ত শব্দ তিনি শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না এবং অর্থও বুঝতেন না। এজন্য সকলে তাঁকে উপহাস করতো। কিন্তু তিনি তাদের উপহাস বা নিন্দার প্রতি কর্ণপাত না করে আপন মনে প্রতিদিনই পাঠ করতেন ও পুলকে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করতেন। একদিন শ্রীগৌরাঙ্গদেব তার কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাপু! কোন অর্থে তোমার এত আনন্দ হয়? তিনি বললেন, “গুরুর আজ্ঞায় আমি গীতা পাঠ করি এবং যতক্ষণ পাঠ করি, ততক্ষণ দেখি শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনের রথে বসে তাঁকে উপদেশ দিচ্ছেন। তাই আমার আনন্দ হয়।” শ্রীগৌরাঙ্গদেব তাকে আলিঙ্গন করে বললেন, “তুমিই গীতার সারমর্ম বুঝেছ।” ঘূর্ণির ভিতর চিক্ চিক্ করে জল যায় দেখে পুঁটি মাছগুলো আনন্দে তার ভিতর ঢুকে যায়; কিন্তু তারা আর বের হতে পারে না, একেবারে প্রাণে মরে। সংসারেও বাহ্য চাকচিক্য দেখে লোকে তার ভিতর ঢুকে মারা পড়ে। ঘুর্ণির মত সংসারে ঢোকা সহজ, কিন্তু বের হওয়া দায়। ভিজে দেশলাই হাজার ঘসলেও জ্বলে না, কেবল ধোঁয়া ওঠে, কিন্তু শুকনো দেশলাই একটু ঘসলেই দপ করে জ্বলে ওঠে। ভক্ত শুকনো দেশলাইয়ের মত, হরির প্রসঙ্গ হওয়ামাত্র তার প্রাণে প্রেমাগ্নি জ্বলে ওঠে। কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত মানুষের প্রাণ ভিজে দেশলাইয়ের মত, হাজার হরির কথায়ও উত্তপ্ত হয় না।
সুরেশচন্দ্র দত্তের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ’ থেকে