অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস জানিয়েছে, গত অর্থবর্ষে দেশের সাতটি প্রধান রাজনৈতিক দল তিন হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছে। আরও উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, এই টাকার ৬৬ শতাংশের বেশি এসেছে অজানা সূত্র থেকে। মোট সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ৩,২৮৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে অজানা সূত্রে প্রাপ্ত ২,১৭২ কোটি টাকা। সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের কাছে যে অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে প্রকাশ, গত অর্থবর্ষে বিজেপির সংগ্রহের পরিমাণ ১,৯১৭ কোটি টাকা। তালিকায় তারপরেই আছে তৃণমূল কংগ্রেস (৫৪৫ কোটি টাকা), কংগ্রেস (৫৪১ কোটি টাকা), সিপিএম (১৬২ কোটি টাকা), এনসিপি (৭৫ কোটি টাকা), বিএসপি (৪৩ কোটি টাকা), সিপিআই (২ কোটি টাকা)। উল্লেখ্য যে, ১,১৬১ কোটি টাকা বিজেপি একাই পেয়েছে অজানা সূত্রে! অঙ্কটি অন্য যেকোনও দলের মোট সংগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি।
ভারতের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং রাজনীতির অর্থায়ন। এই ব্যাধিই রাজনৈতিক দলগুলিকে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধা দিচ্ছে। তছনছ হয়ে যাচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা। খাতাকলমে পঞ্চায়েত/পুরসভা থেকে বিধানসভা ও লোকসভার নির্বাচন হচ্ছে বটে কিন্তু তাতে মানুষের মতামত এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকছে সামান্যই। আরও পরিতাপের বিষয়, নির্দিষ্ট দলের প্রতীকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কতক্ষণ সেই দলের পক্ষে থাকবেন, তারও নিশ্চয়তা নেই। কারণ দেখা যায়, শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরেই কিছু নির্বাচিত সদস্য অন্য দলে গিয়ে ভিড়ছেন। যে-দলের মুণ্ডপাত করে একজন প্রার্থী ভোট নিয়েছেন, জেতার দু’দিন বাদে সেই দলেই ভিড়তে এতটুকু লজ্জিত হচ্ছেন না। ব্যাপারটা ফেলা থুতু চেটে খাওয়ার মতো জঘন্য জেনেও কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এই অপরাধ করছেন স্রেফ ক্ষমতার লোভে। সামান্য গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরসভা থেকে শুরু করে বিধানসভা এবং লোকসভা পর্যন্ত প্রায় সমস্ত সদনই এই ধরনের গদ্দারে ভরে গিয়েছে। তাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে বোর্ড বা সরকার ফেলে দেওয়া হচ্ছে কিংবা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক ভারসাম্য। এর পিছনে বিপুল পরিমাণ টাকার খেলা যে চলে তা একটি সংগত অনুমান। তাই ভোটে কালো টাকার খেলা বন্ধের দাবিতে নাগরিক সমাজ বহুদিন যাবৎ সরব। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন সমস্ত ধরনের দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ইলেক্টোরাল বা নির্বাচনী বন্ড স্কিম ঘোষণা করেন। ৩ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তি মারফত কেন্দ্র জানায়, ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ও ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড কিনে যেকোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা তার পছন্দের রাজনৈতিক দলকে অর্থসাহায্য করতে পারবে। এই বন্ড কারা এবং কী উদ্দেশ্যে কিনছে তা গোপন থাকছে। কোনও পার্টিকে অন্যভাবে ২০ হাজার টাকার কম প্রদানেও দাতার পরিচয় প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়। সম্ভবত, অন্যকোনও দেশে এমন আজগুবি ব্যবস্থা নেই। নাগরিক সমাজ এই নয়া ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে গোড়াতেই প্রশ্ন তুলেছিল। জবাবে জেটলি দাবি করেন, বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনী চাঁদা প্রদানের ব্যবস্থাটি অনেক স্বচ্ছ হবে। নির্বাচনে অর্থের ব্যবহারে আসবে স্বচ্ছতা।
২০১৮ সালের মার্চ থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্ক তাদের ২৯টি অনুমোদিত শাখা থেকে ১০,২৪৬ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করেছে। নিম্ন অর্থমূল্যের বন্ড বিক্রি হয়েছে খুব কমই। ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড বিক্রি হয়েছে ৯৩.৫ শতাংশ। রাজনৈতিক দলগুলি কী বিপুল পরিমাণ টাকা বৈধভাবে অথচ সর্বৈব গোপনে সংগ্রহ করছে, সেটি এখানেই স্পষ্ট। এই অদ্ভুত ব্যবস্থার ফায়দা আসলে তুলছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। কোনও সন্দেহ নেই, তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। অন্য দলগুলিরও ভাঁড়ারে একই পদ্ধতিতে অল্পস্বল্প ঢুকছে বলে তারা উচ্চবাচ্য করছে না। কিন্তু এই ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে দেওয়া উচিত কি? প্রশ্নটি নাগরিক সমাজের। নির্বাচন কমিশনের যাচাই করে দেখা উচিত, রাজনীতিতে, সর্বোপরি নির্বাচন ব্যবস্থায় কালো টাকার খেলা এতে আদৌ কমেছে, নাকি বেড়েছে? এই ব্যবস্থা ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে কাল হতে যাচ্ছে না তো?