সমৃদ্ধ দত্ত, লখনউ: কে বলল দূরত্ব ২ কিমি? ২ লক্ষ কিমি বলা হলেও অতিশয়োক্তি হবে না। হজরতগঞ্জ হল লখনউয়ের ধর্মতলা। শহরের এহেন জমজমাট এপিসেন্টারকে পিছনে রেখে বিধানসভা মার্গ ধরে এগলে বিধানসভা ভবন। তার ঠিক উল্টোদিকের ঠিকানার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বিখ্যাত সেলেব্রিটি অথবা কর্পোরেট কর্তার মেয়ের বিয়ে। রাস্তায়, ভিতরে, গেটের সামনে, গাছের নীচে গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। ফরচুনার, ইনোভা কিংবা মার্সিডিজের নীচের কোনও ব্র্যান্ডের যেন প্রবেশ নিষেধ। গেট পেরলে উজ্জ্বল পোস্টার, কাট আউট, ব্যানার, থ্রি-ডি স্ক্রিন। এই হল বিধানসভা মার্গে রাজ্য বিজেপির সদর দপ্তর। এখানে ওখানে জটলা। একের পর এক মেকশিফট ঘর। কোনওটি টিভি চ্যানেলের স্টুডিও। কোনওটি পুলিসের বুথ। একটি করে গাড়ি ঢুকছে, একঝাঁক যুবক জয়ধ্বনি দিয়ে ছুটে যাচ্ছে নেতা বরণে। মিডিয়া সেন্টারকে কেমন দেখতে? তিনটে পাঁচতারা হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হল ঢুকে যাবে।
ঠিক ২ কিমি দূরে বিক্রমাদিত্য রোডের অন্য ভবনে সেই সময় এক অলস বিকেল। গেট আগলে দু’জন সিকিওরিটি গার্ড। যে কেউ প্রবেশ করুক, কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। হাই তুলে বলবেন, ‘যাচ্ছেন যান, কেউ কিন্তু নেই।’ ঢুকেই সামনে হা হা করা মাঠ। আসলে অ্যাম্ফিথিয়েটার। মাঠে তিন-চারটে চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় আড্ডার মুডে থাকা গুটিকয় নিস্তরঙ্গ মানুষের অন্তহীন পান চিবানো ও চা খাওয়া। লাগোয়া ভবনের করিডরের শেষ ঘরে একাকী বসে যিনি কোথায় কত ভোট পড়েছে, সেই শতকরা হার ফোনে সংগ্রহ করে সামনে রাখা ডেস্কটপে লিখে রাখছেন, সেই আশিস কুমার যাদবকে দেখে কে বলবে, একদা মুখ্যমন্ত্রীর ওএসডি ছিলেন! হেসে বলবেন, আসুন আসুন। অলক্ষে বেল টিপবেন। জলের গ্লাস আর চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকে অতিথি সৎকার করবে ভাবলেশহীন এক তরুণ। বড় বড় কাট আউট নেই। রঙিন পোস্টার, ব্যানার, গ্লোশাইনও না। কয়েকটি স্তম্ভে লাগানো রয়েছে গ্রাম্য এক যুবক নেতার ছবি। ছবির নীচে লেখা, নেতাজি অমর রহে। যুবক বয়সের ছবি মুলায়ম সিং যাদবের। অতএব এই হল সমাজবাদী পার্টির অফিস। সন্ধে হয়েছে। সব আলো জ্বলেনি। কে বলবে, ভোট চলছে উত্তরপ্রদেশে? আর এই দল বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ! দুই দলের পার্টি অফিসের চাঞ্চল্য, উৎসাহ, উত্তেজনা এবং ঔজ্জ্বল্যের মধ্যে তো ২ লক্ষ কিমি দূরত্ব!
উত্তরপ্রদেশে লোকসভা ভোটের ফল এই দুই দৃশ্যের নিরিখে কেউ কেউ বিচার করতেই পারেন। দু’হাজার ওয়াটের ভেপার ল্যাম্পের পাশে যেন ৫০ ওয়াটের বাল্ব! কিন্তু এটাই বিভ্রম। কুয়াশার মতো ধাঁধার সামনে উপলব্ধি হয় যে, জীবনের জলছবিতে সব দৃশ্য স্বচ্ছভাবে উদ্ভাসিত হয় না। বহু চাক্ষুষের অন্তরালে থেকে যায় জাদুবাস্তবতার অলক্ষে এক রহস্যঘেরা অলীক বাস্তবতা। এটা যেমন জীবনের ক্ষেত্রে সত্যি, ঠিক তেমই হয়তো গণতন্ত্রের জন্যও। উত্তরপ্রদেশের ভোটে এই বিভ্রমের প্রতিতুলনার আড়ালে দু’টি শব্দ দুলছে পেন্ডুলামের মতো—বেরোজগারি ও মেহঙ্গাই।
কীভাবে বোঝা গেল? অতীব স্মার্ট, আধুনিক, ঝকঝকে এবং হাই ভোল্টেজ ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র এবং যুব মোর্চার সভাপতি ধনঞ্জয় শুক্লার মুখে সংশয়। কেন? তিনি সিলেবাস অনুযায়ী প্রতিটি সাবজেক্ট সম্পর্কে নিখুঁত সাফল্যের পাঠক্রম শোনালেন। বললেন, ‘আয়ুষ্মান কার্ড, উজ্জ্বলা গ্যাস, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা এবং গরিব কল্যাণ প্রকল্পের বিনামূল্যে রেশন তো আছেই। তার সঙ্গে গ্রামের চার প্রধান সমস্যার সমাধান—শিক্ষা, পানীয় জল, রাস্তা এবং বিদ্যুৎ।’ তারপর সংযোজন, ‘দেখুন উন্নয়ন তো হয়েছে। এবার জনতা যা মনে করবে!’
সেকি? এরকম সন্দেহ কেন? তাহলে কি আশঙ্কা আছে আপনাদের?
শুক্লা বললেন, ‘ভোটের কথা কে বলতে পারে? তবে আমরা ৮০ আসনের মধ্যে অন্তত ৭০ তো পাবই। আমাদের স্লোগান, বিকাশ, বিকাশ এবং বিকাশ।’ বুঝলাম, বিকাশ-বিকাশ-বিকাশ! রামমন্দির কোথায় গেল? মনে পড়ার ভঙ্গিতে ধনঞ্জয় শুক্লা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, রামমন্দিরও!’ বিজেপি উত্তরপ্রদেশেই রামমন্দির ভুলে যাচ্ছে!
যতটা অনিশ্চয়তার কালো মেঘ বিজেপির সদর দপ্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেল, ততটাই নিশ্চিন্ত মনোভাব আশিস যাদবের কণ্ঠে। সমাজবাদী পার্টির নিস্তরঙ্গ আলো-আঁধারিতে বসে আশিস যাদব রহস্যময় হেসে বললেন, ‘চল্লিশের বেশি বিজেপি পাবে না!’
সে কী? তাহলে তো সরকারই হবে না!
আশিস যাদব বললেন, ‘হবে না-ই তো!’
অটোচালক হুসেনের কথা মনে পড়ল। অশোক রোড ধরে যেতে যেতে বলছিলেন, ‘গ্র্যাজুয়েট হয়ে অটো চালাচ্ছি! বেরোজগারির থেকে মন্দির মসজিদ বড়? হতে পারে!’