সমৃদ্ধ দত্ত, মুম্বই: পালাচ্ছে কামারউদ্দিন। এই মাত্র ক্রস রোডের দিকে দৌড়ল। সিক্সটি ফুট রোডের নর্দমা লাফ দিয়ে পেরল নবকান্ত সিকরে। তড়িঘড়ি মেশিনরুম বন্ধ করে ওয়াদি গলির ছপ্পনওয়ালা চওলের শাটার নামিয়ে রাজেন্দ্রন মাহিম জংশনের ফুট ওভারব্রিজের দিকে চলে গেল। এত তৎপরতা কেন? এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাভিতে অবশ্য এসব জলভাত। খুব একটা হেলদোল দেখা গেল না নিত্যদিনের চেনা জীবনযাপনে। অপরাধের আঁতুড়ঘরে চোর-পুলিস খেলা আকছার। কী হয়েছে? শেঠ ওয়াদি গলির আদর্শ ক্রীড়া সার্বজনিক নবরাত্রোৎসব মণ্ডল আসলে একটা পাড়ার ক্লাব। ভরদুপুরে বারান্দায় কয়েকজন বসে নির্লিপ্ত হয়ে ধারাভির রুটিন প্রত্যক্ষ করতে করতে চা-সিগারেট খাচ্ছে। হঠাৎ যেন একটা আতঙ্ক দেখছি? বেশ কয়েকজন পালাচ্ছে। পুলিসের রেইড নাকি? সন্ধ্যাকাল নামক স্থানীয় একটি সংবাদপত্র থেকে চোখ সরিয়ে নন্দকুমার ভাওয়ারকর হেঁকে বললেন, ‘আরে ও আব্দুল... কী হয়েছে রে?’ আব্দুল এতক্ষণ ওই অন্ধকার গলির মধ্যে ছিল নাকি? বোঝাই যায়নি। মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘মিটার ম্যান আয়া হ্যায়। ইসিলিয়ে।’ নন্দকুমার বললেন, ‘ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ইনসপেক্টর এসেছে। কারা কারা বিল জমা দেয়নি, তাদের লাইন কাটবে। এই চক্কর চলে মাঝেমধ্যেই।’ আধ ঘণ্টা পর কামারউদ্দিন ফিরে এল। অল ক্লিয়ার। মিটার ম্যান চলে গিয়েছে। আপাতত কিছুদিনের স্বস্তি। কিন্তু বিল না মিটিয়ে কতদিন বাঁচবে? কামারউদ্দিন বলল, ‘কী করব আমরা? সাপ্লাই একদম কমে গিয়েছে। বাজার নেই। ব্যবসা মন্দা।’ কামারাউদ্দিন সেলাই মেশিনের কারবার করে। ধারাভির ঘরে ঘরে ওই ৭ ফুট, ৮ ফুট, ১০ ফুটের ঘরগুলিতে আট-দশটা করে মেশিন চলে। মেয়েরা আর ছেলেরা সারাদিন ধরে জামাকাপড় সেলাই করছে। কামারউদ্দিন, নবকান্ত কিংবা রাজেন্দ্রনরা মূল্যবৃদ্ধি ও চাইনিজ মালের দাপটে পিছু হটে যাচ্ছে ব্যবসায়। নবকান্ত বললেন, ‘মোদিজি মেহঙ্গাইটা কমাতে পারছেন না কেন? আমরা সরকারের থেকে কিছু চাই না। খেটে খেতে হবে।’ নন্দকুমার বললেন, ‘ডালের দাম ২০০ টাকা! আমরা পারব কীভাবে?’
বদলের অপেক্ষায় দিন গুনছে ধারাভি। মোট ৫টা সেক্টর। তিন রকম করে ঘর। পুরসভার মালিকানা। চওল মালিকের থেকে ভাড়া নেওয়া ঘর, আর ঘর কিনে প্রকৃত মালিক। বিখ্যাত ধারাভি বস্তি আদানি গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে। আদানি গোষ্ঠী পুনর্বাসন প্রকল্প করবে। ঘরে ঘরে আশা-আশঙ্কা। কার কাছে কাগজ আছে, কার কাছে নেই! ফর্ম এনে সই করানো হচ্ছে। এখনই জানা যাচ্ছে, সবাই এখানে ঘর পাবে না। মুম্বই শহরতলির বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। তাহলে রোজগার? দোকান মেশিন সাপ্লায়ার সব তো ধারাভিতে! মাহিম জংশনে নেমে বাঁদিকে লম্বা ফুটব্রিজ এসে যে রাস্তায় নামছে, সেখান থেকে শুরু ধারাভি। বস্তির ভোট কোনদিকে? প্রভাকর পোড়ে মুম্বই পুরসভার কর্মী। বললেন, ‘ভোট যাকে দেব, তার কাছেই যাবে তো? নাকি যেখানে বোতাম টিপব, সেটাই বিজেপিতে? এর আগে মোদিজিকে দিয়েছি। এবার এখান থেকে শিন্ধের শিবসেনা। আর দিচ্ছি না। মোদিজি তো বোল বচ্চন হয়ে গিয়েছেন। জুমলারাজা। এবার জিতে এলে সরকারি কর্মীদের ওয়াট লাগাবেন!’ কেন? প্রভাকর নাকি শুনেছেন, ‘মোদিজি পে কমিশন বন্ধ করে দেবেন।’
কুট্টি ওয়াদি লেনের সামনে সাদা শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরা লোকটি লাইনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে মোবাইলে ভিডিও দেখছে। ঘোড়ার ভিডিও। ঘোড়া নড়ছে, হাঁটছে, মাথা দোলাচ্ছে। ক্রস রোডের গলির গলি তস্য গলিতে রইস ভাইয়ের বিরিয়ানি হল ধারাভির সেরা ব্র্যান্ড। অতএব লাইন দিয়ে কিনতে হয়। ঘোড়ার ভিডিও দেখা রাজন পিল্লাই বিরিয়ানি নিতে এসেছেন। সত্তরোর্ধ্ব। রেসকোর্সে কাজ করতেন। এখন অবসর। কাজ কী ছিল? ঘোড়াকে বোঝা। রেসের কয়েকদিন আগে থেকে ঘোড়ার মনমর্জি আর এনার্জি বুঝতে রাজন পিল্লাই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আজ অবসরের পরও তাঁর কদর আছে। রেসকোর্স থেকে পাঠানো হয় ঘোড়ার ভিডিও। তাঁর মতামতের জন্য। ৪৫ বছর ধরে ধারাভিতে থাকা রাজন পিল্লাই বললেন, ‘মারাঠি মুসলিমদের ভোট এবার উদ্ধব থ্যাকারের কাছে।’ মারাঠি মুসলিম আবার কারা? উত্তর মহারাষ্ট্র এবং মুম্বইয়ে মারাঠি মুসলিমদের বাস। তাঁদের সঙ্গে উত্তরের অন্য মুসলিমদের ফারাক হল, এঁরা উর্দু বলেন। মারাঠি নয়। কিন্তু তাঁদের কালচার, সামাজিক আচার কিন্তু মারাঠি। এই অংশ এবং সিংহভাগ মুসলিম সমাজ এবার উদ্ধব থ্যাকারের সঙ্গে, যা এতকাল ছিল অবিশ্বাস্য। হিন্দুত্ববাদী বালাসাহেবের আক্রমণের টার্গেট ছিল দুই গোষ্ঠী। মুসলিম এবং মুম্বইয়ের বহিরাগতরা। সেই শিবসেনার এবারের অন্যতম ভরসা কিন্তু এঁরাই। ধারাভির এই অংশের সব সমস্যার মুশকিল আসান কে? শিবসেনার নেতা মুত্তুভাই! সাউথ ইন্ডিয়ান মানুষ শিবসেনার নেতা? হ্যাঁ। ধারাভিতে কোনও অঙ্ক মিলবে না। সম্ভবত মুম্বই দখলের সব অঙ্ক এবার মোদিরও মিলবে না। মনে করা হচ্ছিল মুম্বইয়ে থ্যাকারেরাজ শেষ! কে বলল? চেম্বুর, ওয়াডেলা, মাহিম, ধারাভি... মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’র সেনাপতি এখানে থ্যাকারে পদবীর।
আবার দৌড়ের শব্দ। নন্দকুমার চিৎকার করলেন, ‘ওয়ে সেলিম আমার টাকাটা দিলি না!’ সেলিম সরু গলিতে অদৃশ্য হতে হতে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘দে দেঙ্গে ভাউ। মামু আ রাইলে!’
পালাচ্ছে সেলিম। মামু মানে বিট কনস্টেবল। সেলিম রিচার্জের দোকানের আড়ালে পুরিয়া বিক্রি করে। তাই যদি আজও পুলিস ধরে!
আমচি মুম্বইয়ের চিরন্তন আইডেন্টিটি ধারাভি একই রয়ে গেল!