বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
দেশ
 

মোদির গ্যারান্টি আজও আসেনি দ্বারকানগরে

সমৃদ্ধ দত্ত, ভোপাল: ‘উনুনের মধ্যে মিরচি ফেলেছিস নাকি?’ বাহাদুর প্রসাদ ঘুমের মধ্যে ধমক দিচ্ছে বউকে। সুনীতা বাঈ অবাক। লোকটা পাগল নাকি! উনুন তো নেভা। একটু ছাইচাপা আগুন রেখে দিতেই হয় রোজ। এই ঠান্ডায় একটু ওম হয়। তাই বলে সেই উনুনে লাল মিরচি দেব কেন? 
বাহাদুর প্রসাদ গজগজ করছে। ঘরে দুই ছেলে, আট বছরের ছেলে কৈলাস, আর দেড় বছরের বিঘ্নেশ। সমস্যা হল, চারজনই কাশছে। চোখ জ্বালা করছে। আর সেই কারণেই বাহাদুর প্রসাদ ভেবেছে, ভুল করে সুনীতা বুঝি উনুনের মধ্যে শুকনো লঙ্কা দিয়েছে। আর থাকা যাচ্ছে না। বাহাদুর বলল, উনুন বাইরে রেখে আয়। 
সুনীতা উঠল। কাশতে কাশতে বলল, উনুনে কিছুই নাই, কী সব বলো! উনুন খুলে বাইরে রাখতে গিয়ে সুনীতা দেখল, ছোটাছুটি চলছে। প্রবল হইচই। অনেকে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। এরা কারা? কী হয়েছে? সুনীতার চোখেও হঠাৎ যেন লঙ্কার গুঁড়ো যেন ঢুকে যাচ্ছে। গলাতেও। শ্বাস নিতে পারছে না। দুই ছেলে নেতিয়ে পড়েছে। দেড় বছরের বিঘ্নেশ নড়ছে না। বাহাদুর দিশাহারা। বাইরে বউ শুয়ে ছটফট করছে। নিজের বুকেও খুব কষ্ট। ২ ডিসেম্বর, ১৯৮৪। রাত আড়ইটে। এক বালতি ঠান্ডা জল রাখা ছিল। সেটা ঢেলে দিল সুনীতার শরীরে। সুনীতার দেহ কেঁপে উঠল। তবে সে চোখ মেলে তাকায়। ‘ছোটুকো হাসপাতাল লেনা পড়েগা...’ এটুকু বলে হামিদিয়া হাসপাতালের দিকে ছুটছে বাহাদুর। ততক্ষণে জানা গিয়েছে, ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস লিক করেছে। আর দ্বারকানগরের মানুষ টুপ টুপ করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে... মারা যাচ্ছে... অন্ধ হয়ে যাচ্ছে...। হামিদিয়া হাসপাতালে ভিড়। ছোটুকে এক সেকেন্ড পরীক্ষা করেই ডাক্তার বলল, ‘ইয়ে তো মর গয়া। ইয়েহিঁ পে ছোড় দো।’ বাবা বলেছিল, না, আমি ছোট বেটাকে নিয়ে যাব। আজ ভয়াবহ স্মৃতিটা হাতড়াচ্ছেন কৈলাস—‘আমাদের তখন হাসপাতালে ওষুধ দিচ্ছে, চোখে ড্রপ দিচ্ছে। কিন্তু আমার যে ভাইকে হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল মরে গিয়েছে, সে আসলে মরেনি জানেন! হাসপাতালের পিছনে একটা জায়গায় স্তূপ করে বাচ্চাদের দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমার ভাইকেও দেওয়া হতো। কিন্তু আমরা রাজি হইনি। নিয়ে এসেছিলাম মায়ের কাছে। বেঁচে আছে। আজও। শুধু কথা বলতে পারে না ভালো করে।’ এভাবেই অনেক জীবন্ত বাচ্চাকেও মৃত ভেবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনের ৮ বছরের কৈলাস কুশওয়ার চোখে আজ ৪০ বছর পরও ভীতি। দ্বারকানগরে এক নম্বর গলির বাড়িতে বসে বলছিলেন, ‘যে কোনও বাড়িতে যান। একই কাহিনি। ২৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। ব্যস!’ 
ভোপাল স্টেশনকে বাঁদিকে রেখে রেললাইন বরাবর যেতে হবে। রেলওয়ে কলোনি ছাড়িয়ে ওই যে পরপর সরু ৮ ফুটের গলিগুলো একটি করে মহল্লায় ঢুকে যাচ্ছে, এই হল দ্বারকানগর। ১৯৮৪ সালের সেই গ্যাস দুর্ঘটনার সবথেকে বড় আক্রান্ত জনপদ। অসহ্য গরমের খাঁ খাঁ করা দুপুরে এক নম্বর গলির একটি বাড়ির সামনে এক বৃদ্ধা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। সোজা তাকিয়ে আছেন। ভ্রম হতে পারে। কারণ, তাকিয়ে থাকলেও আসলে কিুছই দেখছেন না। কারণ সন্তরি দেবীর চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি আসলে অন্ধ। গ্যাসের জেরে। 
 পাঁচটি গলি এই এলাকায়। প্রতিটি গলিতে দু’দিকে সারিবদ্ধ ঘর। প্রতিটি ঘরে গ্যাসপীড়িতদের অসংখ্য কাহিনি। প্রতিটি ঘরে দেওয়ালে একটা-দুটো-তিনটে-চারটে করে ফটোফ্রেম। গ্যাস কাণ্ডে মৃত। ভোপাল স্টেশনের সে সময়ের গ্যাংম্যান থাকা প্রতাপ সিং ভালো করে কথা বলতে পারেন না। কেঁপে যায় কণ্ঠ। বললেন, ‘নাইট ডিউটি ছিল। ম্যাড্রাস মেল চলে গেল। একটু ঘুম আসছিল। ডিপটি স্টেশন মাস্টার গোমেজ সার ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, আরে সিং, গ্যাস লিক হুয়া হ্যায়... তুমহারে মহল্লাকে বহোৎ ভাগা দৌড়ি চুল রহি হ্যায়। ট্রেন ভি বন্ধ হো গই। সেটা শুনে আমি ছুটলাম। ঘরের দরজা খোলা। কেউ নেই। আশপাশে সবাই পালাচ্ছে। আমাকে হাত ধরে টানছে। চলে যেতে বলছে। আমার চোখ গলা সব বুজে গেল। কিন্তু পালাব কোথায়? বিবি, বাচ্চা কোথায় গেল? পুলিস এসে জোর করে গাড়িতে তুলে নিল। নিয়ে গেল দূরে নেহরু নগরে।’ প্রতাপ সিংয়ের স্ত্রী রাজকুমারী যাদব ছিলেন গর্ভবতী। সেই গ্যাসকাণ্ডের পর থেকে তাঁর গর্ভপাত হওয়া যেন বাৎসরিক এক অভিশাপ। তিনবার সন্তান এসেছে। তিনবারই মৃত্যু হয়েছে গর্ভে। একমাত্র ছেলে রূপেশ বললেন, ‘আমাদের কথা আর কারও মনে নেই। ভোট আসে। ভোট যায়। আমাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া আর হয় না। ৪২ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। ওখানেই শেষ। চাকরি নেই। রাস্তাঘাট নেই। ওই দেখুন জমি। ওখানে সকলেই যে যেমন পারে সব্জি ফলিয়ে বাজারে বিক্রি করে। সেচের জল নেই। নর্দমার জল দিয়ে চাষ করি। কী করব?’ নর্দমা, পুতিগন্ধময় জঞ্জালপূর্ণ পরিবেশ, আর বেকারত্ব। দ্বারকানগরের অভিশাপ। অসংখ্য মানুষকে প্রতি সপ্তাহে আজও রেল হাসপাতালে ইঞ্জেকশন নিতে যেতে হয়! ৪০ বছর ধরে চিকিৎসা চলছে। দ্বারকানগর আজও সুস্থ হল না। মোদির গ্যারান্টি দ্বারকানগরে প্রবেশ করেনি!

6th     May,   2024
 
 
অক্ষয় তৃতীয়া ১৪৩১
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ